মিলির ছেলেটা হঠাৎ করেই মারা গেল। মাত্র ছ'মাস বয়স হয়েছিলো ছেলেটার।
ছেলেটা জন্মাবার আগে মিলির দুবার মিসক্যারেজ হয়। অনেকেই এরপর বলেছিলো কোনো বেবি না নিতে। কিন্তু তবুও ও ছেলেটাকে কনসিভ করে। তখন সবাই বলাবলি করতো, এটাও মিসক্যারেজ কেস হবে। সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করেই ছেলেটার জন্ম হয়। মিলি ওর নাম রাখে রাতুল।
কি ফুটফুটে সুন্দর ছিলো ছেলেটা। মিলি একবারও ওকে কাছ-ছাড়া করতো না, সবসময়ই কোলে নিয়ে রাখতো। কিন্তু তবুও যে ঘটনাটি কিভাবে ঘটে গেল, কেউ বলতে পারলো না।
রাতুল মারা যাবার একমাস পর, এক সন্ধ্যাবেলায়, বাড়িতে তখন কেউ নেই। মিলি শোবার ঘরে শুয়ে ছিলো, ওর হঠাৎ মনে হলো, বসবার ঘরে যেন ও রাতুলের হাসির শব্দ শুনলো। ছুটে বসবার ঘরে গিয়ে ও দেখলো, কেউ নেই।
রাতে শাহেদ ঘরে ফিরলে ও কথাটা বললো শাহেদকে। শাহেদ হেসেই কথাটা উড়িয়ে দিলো। মাঝরাতে, ওরা যখন ঘুমিয়ে আছে, মিলি বুঝতে পারলো ছোট একটা বাচ্চা শুয়ে আছে ওদের মাঝে। বাচ্চাটার গা থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছে, রাতুলের শরীরে এই ঘ্রাণটি পেতো মিলি। ও বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। হেসে উঠলো বাচ্চাটা।
শাহেদ ঘুম ভেঙে বললো, 'এই, কে হাসে?'
মিলি বললো, 'আমাদের রাতুল এসেছিলো। ওই হাসছিলো।' শাহেদ গম্ভীর হয়ে গেলো, কিছু বললো না। ওর চারপাশে তাকালো, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। মিলি বললো, 'তুমি জাগলে দেখেই তো ও চলে গেল। এভাবে ধমকে উঠলে কেন?' শাহেদ বললো, 'রাত হয়েছে, শুয়ে পড়ো।' বলেই অন্যপাশে ফিরে শুয়ে পড়লো সে। সারারাত আর ঘুম এলো না ওর।
সকালে উঠেই বাক্সপেটরা গুছিয়ে মিলিকে নিয়ে শাহেদ ওর শ্বশুরবাড়িতে চলে গেল। একমাস এ বাসাতে থাকবে ওরা।
বিকেলবেলাতে মিলির বাবা শাহেদের কাছে এসে বললেন, 'বাবা, তোমাকে একটা কথা বলবো। মিলি যেন না জানে। কথাটা আমাদের দুজনের মাঝেই রাখতে হবে।' মিলি তখন রান্নাঘরে, ওর মায়ের সাথে নাস্তা তৈরি করছে। রাতুল বললো, 'বলেন, আমি কাউকে বলবো না।'
মিলির বাবা বললেন, 'কথাটা তোমাকে আগেই জানানো দরকার ছিলো, কিন্তু মিলির কথা চিন্তা করেই বলি নি। মিলি যখন পেটে, তখন ওর মায়ের কিছু সমস্যা শুরু হয়। প্রায়ই সন্ধ্যাবেলাতে ওর মা দেখতো, এক লম্বা কালো চাদর পড়া লোক ওর জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু ওই দেখতো, আমরা কিছু দেখতে পারতাম না। অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছি, কোনো লাভ হয় নাই। শেষে একজনের খোঁজ পেলাম, তিনি নাকি এসব ব্যাপারে বেশ অভিজ্ঞ। তাকে নিয়ে আসলাম। তিনি বাসায় এসেই বললেন, 'ভাই, আমার জীবনে আমি অনেক ভয়ঙকর জিনিসের মোকাবেলা করেছি, কিন্তু আপনার বাসায় যে আছে, তার মতো ভয়ঙকর কিছুকে আমি আগে কখনো দেখি নি।'
আমি বললাম, 'এখন কি করবো আমরা?'
তিনি বললেন, 'আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। কিন্তু কাজ যে হবেই, এমন কিছু বলতে পারছি না।'
তিনি খুঁজতে খুঁজতে আমাদের বাড়ির পিছে একটা গাছের কাছে চলে গেলেন। এরপর বললেন, 'এ জায়গাটা খুঁড়েন।'
জায়গাটা খোঁড়া হলো। এরপর যা বের হলো,তা আমরা জীবনেও কল্পনা করতে পারি নাই। দেখলাম, একটা ছোট বাচ্চার মাথার খুলি।'
তখনই ওরা রান্নাঘর থেকে মিলির চিৎকার শুনতে পেলো।
রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে ওরা দেখলো মিলি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার পাশে মিলির মা। তাকে কেউ যেন ছিঁড়ে দুভাগ করে ফেলে রেখেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পুরো রান্নাঘর।
সে রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করা হলো মিলিকে। ওর জ্ঞান ফেরেনি তখনো। মিলির মায়ের পোস্টমর্টেম শেষে শেষকৃত্যও হয়ে গেল। মিলি জানতেই পারলো না।
দুদিন পর মিলিদের বাসায় সে এলাকার ইন্সপেক্টর দেখা করতে আসেন। মিলির বাবার এলাকায় খুবই প্রভাব, সুতরাং তাদের বাসার এমন একটা ঘটনা খুবই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত হবে সেটাই স্বাভাবিক। মিলির বাবাকে সে বলল, 'আপনাদের কেসের তদন্ত বেশ ভালো ভাবে আগাচ্ছে। আশা করি কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খুনিকে গ্রেফতার করতে পারবো।'
'তাহলে তো খুবই ভালো কথা।'
'তবে কিছু সমস্যা আছে। আজকে আমরা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। আপনার স্ত্রীর গায়ে খুনির হাতের যে ছাপ পাওয়া গেছে তা খুবই অদ্ভুত। এতো বিশাল হাতের ছাপ কোনো মানুষের হতে পারে না।'
'আপনারা তাহলে কি করতে চান?'
'খুনের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী আপনার মেয়ে। তার জ্ঞান ফিরলেই আমরা ওর জবানবন্দি নিবো।'
'জ্বি অবশ্যই নিবেন। আমিও চাই অপরাধী ধরা পড়ুক।'
ইন্সপেক্টর চলে গেলেন। মিলির বাবা গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। শাহেদ বসে আছে তার পাশে। বাবা মিলির ছোটবেলার গল্পটি শেষ করেননি। এই অবস্থায় শাহেদও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না।
সে রাতে মিলির কেবিনের ডিউটিতে যে নার্স ছিলেন তার নাম শাহানা। তার ডিউটি পাঁচমিনিটের মধ্যেই শেষ হবে। একটু তাড়াহুড়ো করছিলেন তিনি। তার ছোট ছেলেটা বাসায় একা, তার উপর অসুস্থ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় যেতে হবে তাকে। তিনি সব গুছিয়ে নিচ্ছিলেন, এসময়ই মনে হলো কে যেন দরজার সামনে দিয়ে দৌড়ে গেল। তিনি বাইরে উঁকি দিলেন। করিডর খালি, কেউ নেই। এসময় এমন এক জিনিস দেখলেন তিনি, ভয়ে জমে গেলেন একদম।
***
রাতের খাওয়া শেষ হলে মিলির বাবা শাহেদকে নিজের ঘরে ডাকলেন। শাহেদ ঘরে এলে তিনি বললেন, 'তোমাকে যে ঘটনাটি বলছিলাম সেটা তো শেষ করিনি।'
'জ্বি বলুন।'
'আচ্ছা শোনো। আমরা মাথার খুলি পাবার পর লোকটি শাবল দিয়ে ওটা ভেঙে ফেলল। উঁহু উনার নামটাও মনে পড়ছে না। যাই হোক, এরপর সেই খুলির ভেতর দুটো কাগজ পাওয়া যায়। কি সব অদ্ভুত অদ্ভুত লেখা আর নকশা করা ছিলো সেখানে। লোকটা আমায় বললো সে কাগজটা বাসায় নিয়ে যাবে নষ্ট করার জন্য। পরদিন সকালে সে আবার আসবে। কিন্তু সকালে সে আসলো না। তার লাশ পাওয়া গেল জংলার ধারে। কে যেন ছিঁড়ে দুভাগ করে ফেলে রেখেছে তাকে।'
শাহেদ আঁতকে উঠলো। তার শ্বাশুড়িকেও তো এভাবেই মেরে ফেলা হয়েছে। সে মিলির বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,'মাথার খুলিটা কার ছিলো জানা গেছিলো?'
'না।'
'আর কাগজগুলো?'
'পাওয়া যায়নি।'
হঠাৎ কি মনে পড়তেই ভয়ানক চমকে উঠলো শাহেদ। তখনই বেরিয়ে পড়লো সে, বাবাকে কিছু না বলেই। এখনই ওকে ওদের বাড়িতে যেতে হবে, যতোদ্রুত সম্ভব।
***
খালি করিডরে একটা বাচ্চা ছেলেকে দেখলেন শাহানা। ছয়-সাত মাস বয়স বাচ্চাটির, অথচ বাচ্চাটি দাঁড়িয়ে আছে দুপায়ে, ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ভয় পেলেন শাহানা, প্রচন্ড ভয়।
বাচ্চাটি ওর চোখে চোখ রেখে পেছাতে লাগলো,এরপর ঢুকে পড়লো এক রুমের ভেতরে। রুমটা খালি, হাসপাতালের বাতিল জিনিসপাতি রাখা হয় সেখানে। শাহানা গিয়ে উঁকি দিলো রুমটার ভেতর। অন্ধকার রুমটা, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চোখে আঁধার সয়ে আসতেই শাহানা দেখলেন কেউ নেই সেখানে। ফিরে আসার জন্য তিনি পিছন ঘুরলেন, সেইসময় কে যেন তার চুল টেনে ধরলো। এরপর হ্যাচকা টান দিয়ে নিয়ে গেল রুমের ভেতর। শাহানা কোন কিছু আঁকড়ে ধরার সময়ও পেলেন না। রুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ দরজার ভেতরে শাহানার চিৎকার কেউ শুনতে পেল না।
সেসময়েই জ্ঞান ফিরলো মিলির। চোখ মেলে দেখলো ওর বিছানার পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে, অসম্ভব লম্বা, আর কালো চাদর গায়ে।
(চলবে)
সাব দিলাম। আমার লেখা দেখে আসবেন আর আমাকেও সাব দিন পাশে পাবেন।