বাংলাদেশের পাখি
ভূমিকাঃ ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল’।
মদন মোহন তর্কালঙ্কার
চির সবুজ দেশ হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিত আমাদের বাংলাদেশ। যেসব প্রাকৃতিক উপাদান সুজলা-সুফলা এ দেশকে ব্যাপক সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে তার মধ্যে পাখি অন্যতম। নানা প্রজাতির নানা বর্ণের পাখির কলরবে সারাক্ষণ বাংলার প্রকৃতি মুখরিত থাকে। কণ্ঠ-মাধুর্যে যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মানুষের মনোহরণ করে আসছে এদেশের পাখি। আকাশে সূর্য তার আগমনী বার্তা দেওয়ার আগেই পাখি তার মধুর কণ্ঠে স্বাগত জানায় দিনের প্রথম প্রহরকে। পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙ্গা বাংলাদেশের মানুষের জীবনের একটি নিত্য ঘটনা।
বাংলাদেশের পাখি-বৈচিত্র্যঃ প্রকৃতির অকৃত্রিম সবুজের সমারোহে অন্যরকম এক সৌন্দর্য যোগ করেছে বাংলাদেশের বিচিত্র সব পাখি। এ দেশের সর্বত্র রয়েছে বিভিন্ন পাখির নিয়মিত আনাগোনা। বাংলাদেশে প্রায় ৫৫০ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। তার মধ্যে প্রায় ৪০০ প্রজাতির পাখি এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। বাকীরা পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্ত থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে অতিথি হিসেবে এসে প্রকৃতিকে মাতিয়ে রাখে আর বাংলাদেশের মানুষকে অনাবিল আনন্দ দান করে। বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, বনে-বাঁদাড়ে, ঘরের আঙ্গিনা, গাছ-গাছালিতে, খালে-বিলে সবখানে রয়েছে পাখিদের সমান পদচারণা। নিম্নে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলো-
জাতীয় পাখি দোয়েলঃ দৃষ্টিনন্দন ও মিষ্টি কণ্ঠের অধিকারী দোয়েল বাংলাদেশের জাতীয় পাখি। দোয়েলের মতো রূপের বাহার সচারচর অন্য কোনো পাখির মধ্যে দেখা যায় না। বাংলাদেশের প্রকৃতির সাথে মিশে আছে তার শোভা। জাতীয় পাখি হওয়ার সুবাদে এ পাখির সগর্ব বিচরণ রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যেও। সারা বছরই আমাদের চারপাশে দোয়েল পাখি লক্ষ করা যায়। এরা সাধারণত বাগান বা বাড়ির আঙ্গিনার খোলা জায়গায় ঘাসের উপর চরে বেড়ায়। ছড়ানো-ছিটানো শস্যকণা ও ছোট পোাকা-মাকড় খেয়ে দোয়েল জীবনধারণ করে।
গৃহপালিত পাখিঃ বাংলাদেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই পাখিপ্রেমী। অনেকেই নিজের বাড়িতে বা বাগানে বিভিন্ন জাতের পাখি পালন করে। যে সব পাখি বাড়িতে পালন করা হয় তাদেরকে বলা হয় গৃহপালিত পাখি। বাংলাদেশে গৃহপালিত পাখির মধ্যে সবার আগে কবুতরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের পাখিপ্রেমীদের অধিকাংশই বাড়িতে কবুতর পালন করে। গৃহপালিত পাখির মধ্যে আরো রয়েছে চড়–ই, পায়রা, বুলবুল, টিয়া, ময়না ইত্যাদি জাতের পাখি।
শিকারী পাখিঃ যেসব পাখি অন্য কোনো ছোট প্রাণি শিকার করে ভক্ষণ করে তাদেরকে শিকারী পাখি বলা হয়। ঐ ধরণের পাখির সংখ্যাও বাংলাদেশে প্রচুর। এরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সহজলভ্য প্রাণি এবং পোকা-মাকড় শিকার করে নিজেদের খাবারের যোগান দেয়। এদের মধ্যে চিল, বাজ, ঈগল, মাছরাঙ্গা, পেঁচা, কোড়া ইত্যাদি পাখির নাম উল্লেখযোগ্য।
গায়ক পাখিঃ বাংলাদেশে গায়ক পাখি হিসেবে প্রধানত পরিচিত হচ্ছে কোকিল। তার মধুর স্বরে কুহুকুহু আওয়াজ মানুষের কানে সুরেলা গানের মতো বাজে। কোকিলকে বলা হয় বসন্তের দূত। কেননা ঋতুরাজ বসন্তকে আরো মোহনীয় করে তোলে তার সুরেলা কলরব। গায়ক পাখি কোকিলের ডাক শুনে বাংলাদেশের মানুষ বসন্তের আগমন বার্তা পায়। শ্যামা পাখিও গানের পাখি হিসেবে বেশ পরিচিত। এরা গায়ক পাখির মধ্যে আরো রয়েছে বুলবুল পাখি।
জলচর পাখিঃ বাংলাদেশের গাছ-গাছালির পাশাপাশি খালে-বিলে ও নদীতেও রয়েছে অসংখ্য পাখির পদচারণা। এরা সাধারণত জলে বিচরণ করে বলে তাদেরকে জলচর পাখি বলা হয়। পানিতে অবস্থানরত পোকা-মাকড়, ছোট মাছ ও খাদ্যকণা খেয়ে এরা জীবনধারণ করে। জলচর পাখির মধ্যে হাঁস অন্যতম। এছাড়াও পানকৌড়ি, বক, বালিহাঁস, ধনেশ, গাঙ-শালিক, কাদাখোঁচা, গাঙচিল প্রভৃতি পাখি সর্বদা জলে চরে বেড়ায়।
পোষ্য পাখিঃ বহু পাখি আছে যারা বশ্যতা মেনে নিয়ে মানুষের সাথে বাস করে। এদের মধ্যে অনেকে আবার মানুষের কণ্ঠস্বর নকল করে কথাও বলতে পারে। বিনোদন ও আনন্দ লাভ এবং সেই সাথে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য মানুষ এদেরকে পোষে । পোষ্য পাখিগুলো সাধারণত খুব অল্প সময়েই তাদের মনিবের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক হয়ে যায়। মনিবকে তারা খুব ভালোভাবে চিনে রাখে। দেখা মাত্রই ডাক বা শিখানো বুলি ব্যবহার করে তারা স্বাগত জানায় তাদের মনিবকে। পাখি পালন ও পোষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ ও পাখির মধ্যকার ভালোবাসাপূর্ণ একটি সুন্দর সম্পর্কের প্রকাশ পায়। ময়না, টিয়া, চড়–ই, কাকাতোয়া, শ্যামা, ঘুঘু, কবুতর প্রভৃতি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পোষমানা পাখি।
হিংস্র পাখিঃ বাংলাদেশে কিছু প্রজাতির পাখি আছে যারা খুবই সাহসী ও একই সাথে হিংস্র বলে বহুল পরিচিত। এদের মধ্যে শিকারী পাখিদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তবে এক্ষেত্রে চিল, বাজ, শকুন ও কাকের নাম সবার আগে চলে আসে। চিল ও বাজ সাধারণত মাংসভোজী পাখি। এরা বিচরণরত মাছ, মুরগির বাচ্চা, হাঁসের বাচ্চা প্রভৃতি শিকার করে এবং এদের মাংস খেয়ে জীবন-যাপন করে। শকুনও মাছ খায়, তবে মরা গরু, ছাগল ইত্যাদি এদের প্রিয় খাবার।
বন্য পাখিঃ বাংলাদেশের প্রকৃতিতে উপকূল এবং বনাঞ্চলের একটি অপূর্ব মিতালী লক্ষ করা যায়। এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে যেমন একাধিক প্রজাতির জলচর পাখি রয়েছে তেমনি বনে জঙ্গলেও রয়েছে বিপুল পরিমাণ বন্য পাখির বিচরণ। বাংলাদেশের প্রধান বন সুন্দরবনে রয়েছে অগণিত পাখির স্থায়ী আবাস। বনমুরগির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে সুন্দরবন এলাকার মানুষের। অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয় বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস। সুন্দরবন দিয়ে প্রবাহিত উচ্ছল নদীর বুকে সাঁতার কাটে গাঙচিল, বালিহাঁস, পানকৌড়িসহ আরো প্রভৃতি জাতের পাখি। এসব অরণ্য পালিত পাখি আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
অতিথি পাখিঃ বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রকার পাখির পাশাপাশি এদেশের পরিবেশ মাতিয়ে রাখতে আগমন ঘটে বিভিন্ন জাতের অতিথি পাখির। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সবুজ-শ্যামল এ দেশে বেড়াতে আসে এসব অতিথি পাখি। এরা সাধারণত শীতকালে সুদূর হিমালয় ও সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে উড়ে এসে আমাদের দেশের মনোরম পরিবেশে আশ্রয় নেয়। বসন্তকালের শেষের দিকে আবার যথাস্থানে চলে যায় অতিথি পাখিগুলো।
পাখি নিধনঃ বাংলাদেশের পাখি এ দেশের প্রাকৃতিক উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলেও কিছু অসাধু এবং অসচেতন মানুষ প্রতিবছর অনেক পাখি নিধন করে। অনেকে শখের বশে আবার অনেকে খাওয়ার জন্য পাখি শিকার করে বেড়ায়। এতে একদিকে প্রাণিজগত ধ্বংসের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আবার অন্যদিকে দেশের সৌন্দর্যহানি হচ্ছে। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নীতি থাকলেও যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ার কারণে এ নীতির কেউ তোয়াক্কা করে না। ফলে মানুষের হাতে মারা পড়ছে প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ অনেক পাখি। তাছাড়া, অনবরত শিল্পায়নের ফলে দেশে পর্যাপ্ত গাছ-গাছালি ও বনাঞ্চল না থাকায় পাখির উপস্থিতি এখন আগের মতো লক্ষ্য করা যায় না। ধীরে ধীরে লোপ পেতে বসেছে বাংলাদেশের গহীন অরণ্য। আর সেই সাথে বিলুপ্ত হওয়ার পথে বহু প্রজাতির অগণিত পাখি।
উপসংহারঃ বাংলাদেশের অনুপম রূপ-বৈচিত্র্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে এদেশের পাখি। এরা নানাভাবে আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। এদের উপস্থিতি আমাদের প্রাণে আনন্দের স্রোত বইয়ে দেয়। বিচিত্র পাখির বিচিত্র ডাক ও কলরব আমাদের চারপাশের পরিবেশকে মোহময় করে রাখে। বাংলাদেশে পাখিদের সরব বিচরণের কারণেই দেশটা এত সতেজ, সজীব ও প্রাণবন্ত।