শেষ বিকেলের আলো

0 8
Avatar for Nikita11
3 years ago

প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা করছে। মাথার বাম পাশের শিরাটা দপদপ করে লাফাচ্ছে। মনে হচ্ছে লাফাতে লাফাতে যে কোন সময় ছিঁড়ে বের হয়ে আসবে। দুটো মাইগ্রেনিল ০.৫ মিলিগ্রাম খেয়ে ফেললাম। ওষুধে কিছু হয় না। শুধু কেমন জানি দুর্বল, আচ্ছন্ন ভাব আসে। কিন্তু ব্যাথা কমে না। কোন ডাক্তারই আজ পর্যন্ত আমার মাথা ব্যাথা কমাতে পারে নি। শুধু সাবু পারতো। সাবু আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমার সারাজীবনের সবচে ভাল বন্ধু। একদম প্রাণের বন্ধু।

ছোটবেলা থেকে আমার মাইগ্রেনের সমস্যা। যখন ব্যাথা শুরু হত তখন পাগলের মত হয়ে যেতাম। তখন যশোর জিলা স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ি। একদিন এরকম মাথা ব্যাথা শুরু হলে সাবু বিরক্ত হওয়ার ভান করে বলল,

‘তোরে নিয়ে তো ভাল যন্ত্রণা। মাথা ব্যাথার দেখি কোন ইস্টিশন নাই।‘

আমি কিছু না বলে মাথার বাম দিকের শিরাটা চেপে ধরে সিঁড়িতে বসে পড়ি। আমার কথা বলার মত অবস্থা নেই।

‘দাঁড়া, তোর মাথা ব্যাথা কমিয়ে দিচ্ছি।‘

‘কিভাবে?’ কোনমতে বলি।

সাবু তখন আমার পাশে বামদিকে বসে ওর মাথাটা আমার মাথার সাথে চেপে ধরে।

‘এই দ্যাখ, আমি তোর মাথা ব্যাথা নিয়ে নিচ্ছি। তুই শুধু চিন্তা করতে থাক যে তোর ব্যাথা কমে যাচ্ছে। তোর ব্যাথা আমার মাথায় চলে আসছে।‘

আমি চোখ-মুখ কুঁচকে স্বার্থপরের মত সাবুর মাথায় আমার ব্যাথা পাঠানোর চেষ্টা করতে থাকি। মিনিট দুয়েক পর সত্যিই আমার ব্যাথা কমে গেল।

‘ব্যাথা কমে গেছে।‘

‘দেখেছিস! বলেছিলাম না?’ সাবুর মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি।

‘এখন তোর মাথা ব্যাথা করছে না?’

‘মাথার ডান পাশটা একটু চিন চিন করছে।‘

‘তোর কি কষ্ট হচ্ছে?’

‘দূর। এইটুক ব্যাথা-ট্যাতায় আমার কিছু হয় না।‘

ওর আসলেই কিছু হয় না। গাঁট্টাগোট্টা, শক্তিশালী শরীর। সে তুলনায় আমি নেহায়েতই দুবলা। মাথা ব্যাথা কমানোর এই পদ্ধতি আমরা এরপরও অনেক বার প্রয়োগ করেছি। সব বারই কাজ করেছে।

সাবুর হাতের লেখা আর আমার হাতের লেখা একই রকম ছিল। আমরা দুজন পিছনের দিকে একটা বেঞ্চে একসাথে বসতাম। তখন বাংলা ক্লাসে প্রতিদিন এক পৃষ্ঠা করে হাতের লেখা দেখাতে হত। মকবুল স্যার সামনে থেকে খাতা দেখতে দেখতে আসতেন আর যে হাতে লেখা আনে নাই তার হাতে মোটা বেতের প্রচণ্ড বাড়ি। ছাত্র হিসেবে আমি মোটামুটি ভাল, কিন্তু খুব ভুলোমনা ছিলাম। মাঝে মাঝেই লেখা নিয়ে যেতে ভুলে যেতাম। আমি যখন ব্যাপারটা আবিষ্কার করে টেনশনে অস্থির হয়ে যেতাম তখন সাবু আমার খাতা নিয়ে লিখতে শুরু করত। স্যার কাছে আসতে আসতেই ওর লেখা শেষ! প্রচণ্ড দ্রুত লিখতে পারতো সাবু।

একদিন তো এমন হল যে ও আমারটা লিখে দিয়েছে কিন্তু ঐদিন ও নিজের লেখাটাই লেখে নি। ওর উপর রাগ করেছিলাম খুব। সেটা বলতেই,

‘তুই মার খেলে আমার খুব খারাপ লাগে।‘

‘তাই বলে নিজে মার খেয়ে আমাকে বাঁচাবি!’

‘ওরকম একটা-দুটো মারে আমার কিছু হয় না।‘ সাবু দাঁত কেলিয়ে হাসে।

‘এরপর থেকে আর কখনো এরকম করবি না। করলে কিন্তু......’

‘ঠিক আছে যা, আর এরকম করব না।‘ সাবু হাত দিয়ে বিষয়টা উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে।

আসলে ব্যাপারটা আমার প্রেস্টিজে লেগেছিল। সবসময় সাবুই আমার জন্য করবে - ব্যাপারটা আমার ভাল লাগত না। ওর জন্য কিছু করতে ইচ্ছে হত। মনে হত ওর জন্য জীবন দিয়ে দিই। মনে হত, এমন কোন ঘটনা ঘটুক যে আমি আমার জীবন দিয়ে ওকে বাঁচিয়ে দিই। তাহলে সাবু বুঝতে পারত যে আমি ওকে কতটা ভালবাসি।

সেদিনের কথা আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। টিফিন পিরিয়ড। এর পরে সমাজ ক্লাস। সাবু বলল, ‘চল, একটা খাতা কিনে আনি। স্যার সমাজের জন্য আলাদা খাতা বানাতে বলেছে। আমার এখনো কেনা হয় নি।‘

আমি হোমওয়ার্কটা একটু দেখে নিচ্ছিলাম। ওকে বললাম, ‘একটু দাঁড়া। যাচ্ছি। এক মিনিট।‘

‘আচ্ছা, তুই থাক। আমি এক দৌড়ে যেয়ে কিনে আনি।‘

এই বলে সাবু ওর প্রিয় ‘স্যানসি’ সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। দোকানটা স্কুলের বাইরে। আমাদের স্কুলের পাশে বড় রাস্তা। বেশ ব্যাস্ত রাস্তা। সাবু সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা গরু ওর সাইকেলে শিং দিয়ে গুতা দিল। সাবু ছিটকে পড়ল রাস্তার মাঝের দিকে। ঠিক সেই সময় একটা বিশাল ট্রাক ওর উপর দিয়ে চলে গেল। ট্রাকের টায়ারের নিচে পড়ে ‘ফটাশ’ শব্দ করে সাবুর মাথার খুলি ফেটে গেল। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল একগাদা রক্ত, মাথার ঘিলু। লাল টকটকে তাজা রক্ত। খবর পেয়েই আমি দৌড়ে ছুটে গেলাম। এই দৃশ্য দেখে আমার হিস্টিরিয়ার মত শুরু হল। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

সাবুর পুরো নাম সাহাবুদ্দিন মিয়াঁ । নামের ‘মিয়াঁ’ অংশটা ওর খুব পছন্দ ছিল। কোন কারণে কোথাও আমি ‘মিয়াঁ’ লিখতে ভুলে গেলে ও রাগ করত। ক্রিকেট খেলতে যেয়ে রানের হিসেব রাখার সময়ও ওর পুরো নাম লিখতে হবে। মিয়াঁ যেন বাদ না পড়ে। ‘মিয়াঁ’ নামটা আমার খুব একটা পছন্দ ছিল না। একটু খ্যাত মনে হত। আমি ওকে পছন্দের কারণ জিজ্ঞেস করলে ও বুক ফুলিয়ে বলল, ‘আমি আমাদের বংশের বড় ছেলে। আমার আপন বোন থেকে শুরু করে চাচাত-ফুফাত সব ভাই-বোন আমাকে মিয়াঁ ভাই ডাকে’। বলতে বলতে গর্বে ওর চোখ চক চক করে ওঠে।

তা সত্যিই ওর ভেতর বড় ভাই সুলভ অনেক ব্যাপার ছিল। মাঝে মাঝে মনে হত ও বুঝি আমারও বড় ভাই। ছোটবেলায় আমি মুখচোরা, লাজুক ধরনের ছেলে ছিলাম। চার-পাঁচ জনের ভিড়ে কোন কথায় বলতে পারতাম না। সাবু আমার এই ঘাটতি পুষিয়ে দিত। আমাকে বুক দিয়ে আগলে রাখত। আমি একটু দুর্বল প্রকৃতির ছিলাম। কোন ছেলে যদি আমাকে মারত বা কিছু করত তাহলে সাবু আমার হয়ে প্রতিশোধ নিত। একবার এক ছেলেকে গাছের ডাল ভেঙে এমন মার মারল যে ব্যাপারটা হেডস্যার পর্যন্ত গড়াল। হেডস্যারকে আমরা খুব ভয় পেতাম। বিশাল শরীর, মেঘের গর্জনের মত গলার স্বর। হেডস্যার একটা মোটা ছয় নম্বুরী বেত নিয়ে সাবুর সামনে দাঁড়িয়ে হুংকার দিলেন,

‘তুই ওকে মেরেছিস কেন?’

‘ও যে দীপুকে ইট ছুড়ে মারল।‘

‘ও দীপুকে মেরেছে তো তুই ওকে মারলি কেন?’

‘দীপু আমার ভাই।‘

উত্তর শুনে স্যার একটু অবাক হলেন। তারপর আমাকে, সাবুকে আর ঐ ছেলেটাকে যার নাম রাকিব – তিনজনকে ডেকে নিয়ে তিনজনকেই পেটালেন। আমার কোন দোষ না থাকলেও সেদিন মার খেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। সাবু একা মার খেলে খুব কষ্ট হত। আসল ঘটনা তেমন কিছু ছিল না। কী কারণে জানি রাকিব রেগে যেয়ে আমার দিকে একটা ছোট ইটের টুকরা ছুড়ে মারে। ওটা আমার কপালে লেগে একটু কেটে যায়। আমার রক্ত দেখে সাবু খেপে পাগল হয়ে গেল। তারপরে এই ঘটনা।

আমিও সাবুর রক্ত দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যিকারের পাগলই বোধহয়। সাবু বেঁচে থাকতে যেরকম তাজা, সতেজ ছিল, ওর রক্তও ছিল সেরকম তাজা। তাজা, চাপ চাপ রক্ত রাস্তায় ছড়িয়ে আছে। আর তার মাঝে যশোর জিলা স্কুলের সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট স্কুল ড্রেস পরা ছেলেটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শার্টটা রক্তে মাখামাখি হয়ে প্রায় লাল হয়ে গেছে। আজ সকালে যদি ও এই ড্রেস পরে স্কুলে আসত তাহলে অ্যাসেম্বলিতে নির্মল স্যারের হাতে মার খেত খুব। নির্মল স্যার আমাদের ড্রিল স্যার। সবাই ঠিকমত স্কুল ড্রেস পরে এসেছে কিনা সেদিকে স্যারের কড়া নজর। এই ঘটনার পর আমার মানসিক কোন সমস্যা হয়েছিল। স্কুলে এক বছর লস দিয়েছিলাম। এই সময়টার কোন কথা আমার ঠিক মনে নেই।

যেকোন খেলাধুলায় সাবু ছিল দুর্দান্ত। আর আমি পুরো উল্টো, একেবারে যাচ্ছেতাই। এর জন্য আমার যেন কোন অসুবিধা না হয় তাই ও সবসময় আমাকে ওর দলে নিত। কখনও যদি ভাগাভাগির সময় আমি অন্য দলে চলে যেতাম তখন ও আমাকে ওর দলে নেওয়ার জন্য ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দিত। ঝগড়াঝাটিতে কাজ না হলে ব্যাট-বল নিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার ভয় দেখাত। আমাদের খেলার মাঠ ওর বাড়ি থেকে কাছে হওয়ায় সাধারণত ওর ব্যাট-বল দিয়েই খেলা হত। তাই এই ভয় দেখানোতে কাজ হত খুব।

সাবু খেলাধুলাতে যতটা দুর্দান্ত ছিল, পড়াশোনায় ঠিক সে পরিমাণ দুর্বল ছিল। পড়াশোনা নিয়ে সাবুর অবস্থা অনেকটা কৌতুকের সেই ছেলেটার মত যার ‘পাস তো দূরের কথা, ফেল নিয়েই টানাটানি’ অবস্থা। আমি মাঝে মাঝে সাবুকে পড়াতাম। দুজনে মিলে চেষ্টা করতাম যেন ওকে কোনমতে পাস করান যায়। বেশিরভাগ সময়ই কানের পাশ দিয়ে গুলি যেত।

প্রতিবার রেজাল্ট দিত আর রেজাল্ট কার্ড হাতে নিয়ে বলত,

‘আজ আমার বাপ আমারে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে পেটাবে।‘

বলার ভঙ্গীতে কোন দুঃখ থাকত না বরং শুনতে মজা লাগত।

‘ঝোলানোর পর কি ফ্যান চালিয়ে দিয়ে পেটাবেন নাকি এমনিই পেটাবেন?’

‘কে জানে! মেজাজ বেশি খারাপ থাকলে চালিয়েও দিতে পারে।‘

সাবুর বাবা ব্যবসায়ী মানুষ এবং যথেষ্ট বদমেজাজী। আমি পারতপক্ষে এই লোকের সামনে পড়তে চাইতাম না।

আরেকবার রেজাল্ট কার্ড হাতে নিয়ে বলল,

‘আজকে আমার বাপ আমারে নিয়ে ফুটবল খেলবে।‘

সাবুর বাবা সাবুকে বল বানিয়ে ফুটবল খেলছেন চিন্তা করে আমি খুক করে হেসে ফেলি।

‘আমার মার খাওয়ার কথা শুনে তুই হাসছিস!’ সাবু আহত হওয়ার ভান করে।

তা সাবু মার খেত বেশ। ও যে রকম দুরন্ত ছেলে তাতে স্কুলে, বাসায় একটু মার খাবে সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। সাবু মার খেতেও পারত খুব। মেরে সাবুকে কাবু করা মুশকিল। ব্যাথা যেন কম লাগে সে জন্য ও নানা ধরনের ব্যবস্থা নিত। ওর একটা মখমলের প্যান্ট ছিল। ওটার ভেতর দিকের কাপড়টা মোটা, অনেকটা বস্তার মত। যেদিন ওর মার খাবার সম্ভাবনা ছিল সেদিন ভেতরে একটা হাফপ্যান্ট পরে ওর উপর এই প্যান্টটা পরে থাকত। ঐ প্যান্টের উপর বেত দিয়ে মারলে শব্দ হত খুব কিন্তু বেশি ব্যাথা লাগত না। তার উপর ও অনেক কৌশল জানত। পাছায় বেত দিয়ে বাড়ি মারলে ঠিক কোন সময়, কিভাবে পাছাটা সামনের দিকে সরিয়ে আনলে ব্যাথা কম লাগবে – ওর থেকে ভাল আর কেউ জানত না।

সাবুর সাথে আমার কোন রক্ত সম্পর্ক নেই, কিন্তু সাবু আমার ভাই। আমার শুধু মনে হয়, ঐ দিন কি আমি ওর সাথে খাতা কিনতে যেতে পারতাম না? কী স্বার্থপরের মত আমি আমার হোমওয়ার্ক দেখছিলাম! এমন কি হতে পারত না যে আমরা দুজন একসাথে খাতা কিনতে গেলাম। গরুটা দেখে আমি সাবুকে সতর্ক করে দিলাম। তারপর দুজনে সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে গরুটা পার হলাম। তারপর দোকান থেকে খাতা কিনে স্কুলে ফিরে আসলাম। এরকম হলে কার কী ক্ষতি হত? ও আল্লাহ, তুমি কেন এরকমটা করলে না!

অসহ্য মাথা যন্ত্রণায় আমার মনে হতে থাকে মাথাটা কেটে ফেলি। দুই হাত দিয়ে মাথা ধরে বসে ফিসফিস করে বলি, ‘সাবু, তুই আমার ব্যাথা কমিয়ে দে। আর কখনও তোকে একা ছাড়ব না। তুই দেখিস, এর পরেরবার আমি ঠিক তোর সাথে যাবো’।

1
$ 0.00
Avatar for Nikita11
3 years ago

Comments