ঝুমুর ভিলা

0 5
Avatar for Nikita11
4 years ago

ছোট গল্প

ঝুমুর ভিলা

আব্বা মৃত্যুবরণ করার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বিছানায় শয্যাগত ছিল। সেই সময় আম্মাকে বলতো যে, তোমার ঘরে কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডব শুরু হবে। ঘরের খুঁটি গুলো শক্ত করে বাঁধন দেওয়ার চেষ্টা করো। আম্মা ঠিকই ধরতে পেরেছিল যে, খুঁটি গুলো এখন আর শুধুমাত্র স্নেহ, মায়া, মমতা আর ভালবাসা দিয়ে তা বাঁধানো সম্ভব হবে না। এখানে শক্ত পিলার দাঁড় করাতে হবে। সেই কনক্রীটের পিলার দাঁড় করানোর মতো শক্তি, সাহস আর অর্থ কোনটিরও আম্মার ছিল না।

আব্বা মৃত্যুবরণ করার পর, তাঁর কথাটি সত্য হয়ে গেল। আমি আর ঝড়ের কাছে দাঁড়াতে পারলাম না। সব কিছু তছনছ হয়ে গেল। মায়ের আদর আর তাঁর নিঃস্বার্থ ভালবাসা ছাড়াও পরিবারের অনেক সদস্য থেকে পর হয়ে গেলাম। আর যেখানে আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের অনেক সময় পার করেছি, সেই চিরপরিচিত এলাকা ছেড়ে ভাড়া বাসায় গিয়ে উঠলাম।

প্রায় ১৬ বছর যাবৎ ভাড়া বাসায় বসবাস করছি। এক বাসায় বেশি দিন থাকাও হয়না। দুই বছর পর পরই বাড়িওয়ালা বাড়ির ভাড়া বাড়াতে চাই। তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই লাভ-ক্ষতির হিসাব করে নতুন বাসার খোঁজ করতে হয়। আবার অনেক সময় বাড়িওয়ালা পীড়াপীড়ি করে বাসা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। তখন আর লাভের হিসাব করা যায় না। আবার এমনও হয়েছে কিছুটা গলির মধ্যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছি, সামনে বড় রাস্তা আছে কিছুটা কম ভাড়ায় বাড়ি পেয়েছি। নতুন বাড়ি-ভাড়া নিব, কিন্তু বাড়ির মালিক কিছুতেই ছাড়তে চায় না তখনোও মন খারাপ হয়।

সকালে ঘুম থেকে উঠতে খুব সমস্যা হয়। পিঠের শিরদাঁড়া আর ঘাড় খুব ব্যথা করে। মাথায় মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। কিছুদিন পরপরই মাথা-ব্যথা শুরু হয়। তখন কোন দিক তাকাতে পারিনা। তারপর পেটে ব্যাথা তো আছে। মাঝে মধ্যেই পেট ফুলে যায়। নানা শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে চলাফেরা করি। নানা ধরনের ঔষধ খেতে হয়। এসব অসুস্থতা দেখে বউটা প্রায়ই বলে তুমি যাওয়ার আগে, আমাদের একটা গতি করে দিয়ে যাও। তোমার যে জমানো টাকা আছে। সেটা দিয়ে কোনমতে একটু জায়গা কিনে দাও। তোমার কিছু হয়ে গেলে, পেনশনের যে টাকাটা পাওয়া যাবে, সেটা দিয়ে বাড়ী করা হয়ে যাবে। আর মাসে মাসে যে টাকা পাবো সেটা দিয়ে কোনমতে সংসার চলে যাবে। স্বামীর ভিটার উপর তোমার দুই ছেলে কে নিয়ে, আমি ঠিকই সামলে নিবো।

নিজের শারীরিক অসূস্থতা, বাড়ি পরিবর্তনের ভয়ে আর বউয়ের পীড়াপীড়ি শেষ পর্যন্ত স্থায়ী নিবাসের জন্য জমি কিনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আমার এলাকাতে জমির দাম অত্যন্ত বেশি। যে জায়গায় জমির দাম তুলনামূলক কম আছে, সে জায়গায় জমি খুঁজতে যাই কিন্তু অন্য এলাকায় জমি দেখতে গেয়ে কেমন যেন একটা অশান্তি ও অস্থিরতা অনুভব করি অথচ নিজের এলাকাতে জমি দেখতে একটা শান্তি ও আত্মীয়তার আবেশ অনুভব করি।

একটা মানসিক সমস্যায় পড়ে গেলাম। যখন অন্য এলাকায় জমি পছন্দ হয়। বায়না করব বলে সিদ্ধান্ত নিই। তখন থেকে রাতে আর ঠিকমতো ঘুম আসে না। ঘুমের মধ্যেই অবচেতন মনে আমার আম্মা, আব্বা আর ছেড়ে আসা পরিবারের সদস্যদের আর আমার নিজের শৈশব আর কৈশোরের দুরন্তপনার অনেক পুরনো স্মৃতিগুলো মনের মধ্যে নাড়া দেয়। কে যেন আমাকে, নিজের এলাকায় ফিরে আসার জন্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

একদিন খুবই মন খারাপ হলো। আম্মার কাছে ছুটে গেলাম। আব্বার কবর জিয়ারত করলাম। এলাকায় নিজের বাসার আশে-পাশে হাঁটাহাটি করছি। এমন সময় লক্ষ করলাম, একটা মেয়ে আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে। আমি ঝুমুর চিনতে পারো-নি, না। তাই বলেই, আমার সাথে গল্প শুরু করে দিল। সে আমার সম্বন্ধে এমন এমন কথা বলছে মনে হচ্ছে, সে আমার পরিবারের সবকিছুই খবর রাখে। সবার খোঁজ খবর নিলো। আমার শরীর- স্বাস্থ্যেরও খোঁজ খবর নিলো। আর কতদিন ভাড়া বাসায় থাকবা বলে আমাকে একটা জমি কেনার পরামর্শ দিল। আমি তার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছি।

স্বভাব-সুলভ ভাবে আমি একটু মুচকি হাসি দেওয়াতে, ঝুমুর আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। তোমার হাসির রহস্যময়তায়, আমি আমাকে তোমাকে একটু গোপনে ভালবেসেছিলাম। এই হাসিটাই আমার কৈশোর জীবনকে অগোছেলো করে দিয়েছিল তা আমি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি।

ঝুমুরকে চিনতে পারলাম। ছোট বেলায় আমরা মেয়েরা এক দলে, আর ছেলেরা আরেক দলে আবার কখনো ছেলে-মেয়েরা একসাথেই দুই দলে ভাগ হয়ে খেলাধুলা করতাম। আমি ভালো খেলতে পারতাম না ছেলেরা আমাকে তাদের দলে নিতে চাইতো না কিন্তু যখন ছেলে-মেয়েরা এক সাথে দুই দলে ভাগ হয়ে যেত তখন ঝুমুর যে দলে থাকুক না কেন আমাকে হাত ধরে টানতে টানতে তার দলের দিকে নিয়েই যাবে। প্রত্যেক দিন সকাল বেলায় চাপ কলে পানি আনতে যেতাম। ঝুমুর জানালা দিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে চুপিসারে এসে আমার কলসিতে চাপকলের পানি ভরে দিত। আর চুপ চুপ করে এসে গাছের পেয়ারা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেত, আমি আর সেটা বাসায় নিয়ে যাওয়ার সাহস পেতাম না। তার কৈশোরের এতটা বাড়াবাড়ি আমার মোটেই ভালো লাগতো না।

ছোটবেলায় ঝুমুরের বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তারপর তার মা ঝুমুরকে নিয়ে তার মায়ের বাড়ী গ্রামে চলে যায়। ঝুমুর কৈশোরে আমাকে এতটা ভালোবাসতো, সেটা আমি সেই বয়সে অনুভবই করতে পারিনি। শুধু বই পড়ে জ্ঞান পরিপূর্ন করা যায় না, শেখা যায় না। অনুভূতি ভালোবাসা এই সব সূক্ষ বিষয়গুলো বুঝতে হলে মানুষকে জানতে হবে, বুঝতে হবে তাকে মান্য করা শিখতে হবে। সেটা ঝুমুরের সাথে আমার আর হয়ে উঠেনি।

ঝুমুরের অস্থিরতা আমাকে কেমন যেন ভাবিয়ে তুলছে। সে যেন তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সব হিসাব নিকাশ ঠিক করে নিয়েছে। এখন শুধু তা মিলানোর চেষ্টা করছে। তুমি কি জানো? আমাদের বাবা-মায়ের যে জমিটা আছে তা আমরা সবাই ভাই-বোনেরা মিলে বিক্রি করবো। আর জমিটা তোমার বড় ভাই নিতে চেয়েছে। আমি চাই আমার অংশটা তোমার কাছে বিক্রি করবো সেজন্য বাটোয়ারা দলিলে স্বাক্ষর করিনি।

ঝুমুর ওয়ারিশসূত্রে প্রাপ্ত জমির তার অংশ আমার কাছে বিক্রি করার প্রস্তাব দিলে তাতে আমি সম্মতি জানালাম, সে আর একটা বিষয়ে অনুনয়-বিনয় করতে লাগলো, আমি যেন জমি রেজিষ্ট্রির দিন এক জোড়া কবুতর দিই আর সেটা যেন হয়, সূস্থ্য-সবল, বাচ্চা দেওয়ার উপযোগী আর দেখতে যেন খুব সুন্দর হয়।

জমি রেজিষ্ট্রির দিন, আমি ঝুমুরের অনুরোধ রক্ষা করে, এক জোড়া কবুতর নিয়ে গেলাম। ঝুমুর আমার সেই কবুতর পেয়ে খুব উচ্ছাসিত আর আনন্দিত হয়েছিলো, বাসা থেকেই কবুতরের জন্য আগে থেকেই শস্য-দানা এনেছিল, তা এক মনে বসে থেকে, কবুতরের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছিল।

কৈশোর বয়সে আমাকে ভালবেসে ছিল সেই ভালোবাসা সে সারা জীবন মনে রেখেছে, কৈশোরের ভালোবাসা খুব গভীর এবং আর সুন্দর হয় এই ভালোবাসায় মানুষকে সারাজীবন তাড়িত করে নিয়ে বেড়ায়। তাকে খুব একা দেখাছিল, কেউ তার সাথে কথা বলছিল না, আমি তার পরিবারের খোঁজ খবর নেওয়াতে বললো, আমার কেউ নেই। আমার শারীরিক অসূস্থতা অনেকদিনের এবং এই অসূস্থতার জন্য আর বিয়ে করা হয়নি।

আমি ছিলাম যাযাবর। আমি ছিলাম উত্ভ্রান্ত। আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে, যেখানে আমি নিজের স্থায়ী নিবাস থেকে দখলচ্যুত হয়েছিলাম, সেই এলাকাতেই বাড়ির ঠিক কিছুটা পার্শ্বেই, ঝুমির আমার কাছে তাঁর জমিটা বিক্রি করবে।

বাড়ির কাজটা খুব দ্রুত আরম্ভ করে দিলাম। ভিত দেওয়ার সময় পরিবারের সদস্যদের আর কিছু আত্নীয়-স্বজন, অফিসের কলিগ আর কিছু বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত করলাম। দশ ফিটের রাস্তার সাথে দেড় কাটার স্কয়ার জমিটার উপর বসে, অনেকেই খুটিঁনাটি বিষয় নিয়ে খোশ-গল্পে মেতেছে, জমির ওয়ারিশ কে কে ছিল আমি কার ওয়ারিশের জমি কিনেছি ভাই না বোনের, কত টাকায় নিয়েছি ইত্যাদি। এমন কথা কানে আসছে যে, লাইলী-মজনুর প্রেম, আমার কৈশোরের প্রেমিকা নাকি আমাকে জমি দান করে দিয়েছে। যুক্তিহীন কর্থাবর্তা গুলো শুনে, নিজেকে খুব স্বার্থপর আর অসহায় মনে হচ্ছিল।

বছর খানিকের মধ্যে বাড়ির কাজ সমাপ্ত হল। একটা মিলাদ দিয়ে বাসায় উঠবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, ঝুমুরের কথা খুব বেশী মনে পড়ছিল, তাঁকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য তার নানীর গ্রামের বাড়ি খুজেঁ বের করলাম। বাড়ীর সাথেই সরিষা বাগান, চারিদিকে হলুদের সমারোহ, আর বাড়ির পূর্ব দিকে উঁচু রাস্তার ঠিক নিচেই বিরাট দীঘি, দীঘিতে রাজহাঁস ঘোরাফিরা করেছে। বাসার উঠানে দাঁড়িয়ে আছি, কারো কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছি না, মাথার উপর দিয়ে বাক বাকুম করে কবুতর উড়ে যাচ্ছে।

চারদিকে নিস্তব্ধতা, শান্ত-শিষ্ঠ পরিবেশ, কোন অস্থিরতা নেই, কাউকে না পেয়ে দীঘির পাড়ের রাস্তায় বসে আছি, দীঘির ঘাটে মহিলারা গৃহস্থালীর জিনিষপত্র ধোঁয়ামোছাতে আর কেউ কেউ বাচ্চাদের গোসল করাতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।

অধৈর্য্য হয়ে শেষ পর্যন্ত মহিলাদের ঘাটে গিয়ে, ঝুমুরের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। দীঘির ঘাটের মেয়েরা আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে বললো, অনেক দিন ধরেই ঝুমুরের কিডনীর সমস্যা ছিল, প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল, তার দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে মারা গেছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না, বাসার দিকে পা বাড়ালাম।

ঝুমুর ভালবাসার হাত প্রশস্ত না করলে, এই বাড়িটা আমার পক্ষে কোন মতেই করা সম্ভব ছিল না। তার মমতা আর ভালবাসায় আমি হার মেনে গেলাম। আমার বাড়ির নামকরণ করলাম, ঝুমুর ভিলা।

1
$ 0.00
Avatar for Nikita11
4 years ago

Comments