“রাকিব ভাই, ও রাকিব ভাই। দরজাটা খুলেন।” দরজায় অনবরত ঠকঠক শব্দের সাথে নূরীর আতংকিত কণ্ঠ শুনে রাকিবের ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িতে বাজে রাত এগারোটা। গ্রামগঞ্জে এটাকে গভীর রাতই বলে। দরজা খুলে নূরীর হাতে রক্তাক্ত দা'টা দেখে রাকিব ঘাবড়ে গেল। গলা মুহূর্তেই শুকিয়ে গেল। বড়বড় চোখে নূরীর দিকে তাকিয়ে আছে। নূরী ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। মনে হচ্ছে দৌড়ে এসেছে। রাকিব কিছু বলার আগেই নূরী বলল, “ওই শয়তান বোরহানকে আমি শেষ করে দিয়েছি। আমাকে বিক্রি করতে চেয়েছিল।”
বকুলতলা গ্রামের খুব দরিদ্র পরিবারের একটি মেয়ে নূরী। বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। তার ছোট দুই ভাইবোন আছে। নূরী পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। দারিদ্রতার কারণে আর পড়া হয়নি। যৌতুকের দিতে অক্ষম হওয়ায় আঠারো পেরোনো নূরীর এখন পর্যন্ত বিয়ে হয়নি। সাধারণত ষোলোর ঘরে পা পড়তেই গ্রামের মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। ওদিকে তার ছোট বোনটাও বড় হয়ে যাচ্ছে। দুই বোনই রূপসী। তাই গ্রামের বখাটেদের নজরও তাদের দিকে। এই নিয়ে চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছে তাদের বাবা-মা। বোরহান হলো এই গ্রামের একজন সুনামধন্য ব্যক্তি। শহরে গিয়ে বেশ অর্থ উপার্জন করেছে। প্রায়শই সে গ্রামের ছেলেমেয়েদেরকে শহরে নিয়ে চাকরি দেয়। চাকরি দেওয়া নাকি তার জন্য সামান্য ব্যাপার। নূরীর বাবা উপায় না পেয়ে নূরীকে শহরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। যদি কিছু টাকাপয়সা আয় করতে পারে। তাহলে সংসারের অভাব দূর হবে। নূরীও পারিবারিক অবস্থা বিবেচনা করে যেতে রাজি হয়। কাপড়চোপড় গুছিয়ে বাবা-মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে বোরহানের সাথে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু গ্রাম ত্যাগের আগেই জানতে পারে তাকে বিক্রি করার পায়তারা করেছে বোরহান। তাই সে কোনোমতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাকিবের কাছে ছুটে চলে এসেছে। রাকিব তার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। ছোটবেলার সাথী।
সব শুনে রাকিব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। যেই বোরহান প্রতি বছর গ্রামের মসজিদের হাজার হাজার টাকা অনুদান দেয়, তার চেহারার আড়ালে এমন নরপশু লুকিয়ে আছে তা কি কেউ কখনো ভেবেছে?
রাকিব ভাবনায় পড়লো। নূরী গ্রামে থাকলে সমস্যা হবে। কিন্তু শহরে কোথায় নিয়ে যাবে? তার নিজেরই থাকতে হিমশিম খেতে হয়। এক রুমে তারা পাঁচজন থাকে। তারওপর ওখানের পরিবেশ একটা মেয়ের জন্য বিপজ্জনক। আশেপাশে মদখোর, জুয়াড়িদের আড্ডা। রাকিবের পায়ের কাছে পড়ে করুণ সুরে নূরী বলল, “ভাই, আপনি আমাকে শহরে নিয়ে যেই কাজ দিবেন সেটাই করব। তবে বোরহানের মতো ধোকা দিয়েন না।”
- তোকে বোনের মতোই দেখি। তোর ক্ষতি হবে এমন কিছু আমি করবো না।
অনেক চিন্তাভাবনার পর রাকিব একটা উপায় খুঁজে পেল। নূরীকে বিস্তারিত সব খুলে বলল। শহরে রাকিবের এক বড় ভাই আছে। নাম আসাদ। শিক্ষিত ছেলে। রাকিব যেই গার্মেন্টসে কাজ করে সেখানের ম্যানেজার। ভালো টাকা আয় করে। ছেলের পরিবার বলতে কেউ নেই। কিছু মাস ধরে বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছে। রাকিবকে বলেছে ভালো পাত্রী পেলে যেন জানায়। যৌতুক লাগবে না। এক কাপড়েই মেয়েকে তুলে আনবে। শর্ত একটাই মেয়ে নম্র-ভদ্র হতে হবে।
নূরী রাজি হচ্ছে না। রাকিব তাকে বুঝাতে লাগল। গ্রামের সবাই ভাবে শহরে গেলেই টাকা আর টাকা। কিন্তু ওখানের পরিস্থিতি কতটা কষ্টের ও সংগ্রামের তা গ্রামের কেউ বুঝে না। বোরহানের মতো লোকেরা রাতারাতি ধনী হয়ে যায় ঠিকই। কিন্তি সত্ পথে যারা চলে তাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়। শহরকে যতোটা সুখের মনে হয় ততোটা সুখের নয়। শহরের গর্ভে অজস্র কালো অধ্যায় লুকিয়ে থাকে। তাছাড়া হুট করে নূরীকে নিয়ে আমি রাখবে কোথায়? ব্যাচেলর বাড়িতে একা মেয়ে নিরাপদ নয়। আসাদ ভাইয়ের সাথে বিয়ে হলে তার জীবন সুখের হবে। পরিবারও একটা ভরসার লাঠি পাবে। অতঃপর নূরী রাজি হলো। এছাড়া অন্যকোনো উপায়ও নেই। রাতেই নূরীকে নিয়ে রওনা দিলো রাকিব। কেননা সকাল হতে হতে যদি কোনো ঝামেলা বেঁধে যায় তখন আরও মুশকিল হবে।
নূরীর সাথে আসাদের বিয়েটা হয়ে গেল। আসাদ এমনিতেই বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিল। চাইলেই সে ধনী পরিবারের যেকাউকেই বিয়ে করতে পারে। কিন্তু ধনীদের প্রতি তার অনীহা আছে।
নূরীকে দেখে আসাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তাই আর দেরি করেনি। নূরীর ব্যাপারে রাকিব কিছু সত্য ও মিথ্যের সংমিশ্রণ করেছে। রাকিব বলেছে, নূরী তার গ্রামের মেয়ে। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। ছোট থাকতেই বাবা-মাকে হারিয়েছে। চাচার কাছে মানুষ হয়েছে। চাচী খুব অত্যাচার করে। দিনরাত মারধর করে। খাবারও ঠিকমতো দেয় না। এমন অত্যাচারে মধ্যদিয়েই নূরী বড় হয়েছে। সম্প্রতি ওর চাচাতো ভাই ওর দিকে কুনজর দিয়েছে। তাই রাকিব তাকে শহরে নিয়ে এসেছে।
রাকিব কঠোরভাবে নূরীকে নিষেধ করেছে সত্য যেন এখন না জানায়। এতে সংসারে অশান্তি হবে।
ফুলে সজ্জিত বিছানায় নূরী বসে আছে। কিছুক্ষণ পর আসাদ এসে তার পাশে বসলো। নূরীর হাতে হাত রাখলো। অজানা এক অনুভূতিতে নূরী কাঁপতে লাগল। সেই কম্পন আসাদ অনুভব করলো। মুচকি হেসে বলল, “তোমার আমার জীবনটা একদিক দিয়ে একই। আমাদের আপনজন থেকেও নেই। তোমার চাচা-চাচী থাকতেও যেমন নেই। আমারও বাবা মা তেমনই থাকতেও নেই।” নূরী কিছুটা বিস্ময়ের সাথে আসাদের দিকে তাকালো। কেননা সে জানে আসাদের পরিবার বলতে কেউ নেই। আসাদ আরও বলল, “আমার বাবা-মা আছেন। কিন্তু তাদের জন্য আমি নেই। আমার জন্মের কিছু বছর পর মা তার পুরানো প্রেমিকের জন্য বাবাকে ডিভোর্স দেয়। বাবাও নতুন বিয়ে করে ফেলে। আমার স্থান হয় বোর্ডিংয়ে। বাবা কখনোই আমাকে দেখতে আসতেন না। শুধু মাসে মাসে খরচ পাঠিয়ে দিতেন। সেখানেই আমার বেড়ে উঠা। বড় হওয়ার পর আমি সেই শহর ত্যাগ করে এখানে চলে আসি। তারপর জীবনের সংগ্রাম এখানেই শুরু করি। আমার ভীষণ ইচ্ছে আমারও একটা পরিবার হোক। কেউ একজন আমাকে ভালোবাসুক। পরিবার না থাকার কষ্ট কি তা তুমি জানো। আশাকরি তুমি আমাকে কখনোই কষ্ট দিবে না। আমিও কথা দিচ্ছি তোমাকে সবসময় সুখী রাখার চেষ্টা করব।”
আসাদের কথা শুনে নূরীর অন্তরটা নড়ে উঠলো। বাইরে থেকে আসাদকে হাসিখুশি দেখালেও তার ভেতরে যে এমন কষ্ট লুকিয়ে আছে তা বুঝার উপায় নেই। নূরী নিচু স্বরে বলল, “আমার মনে হয় অতীত ভুলে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা উচিত।” আসাদ একটা সরল হাসি দিয়ে নূরীকে বুকের মাঝে টেনে নিলো। আসাদের স্পর্শে নূরীর শরীরটা কাঁপতে লাগল। ধীরে ধীরে সেই কাঁপুনি ভালোবাসার অনুভূতিতে রূপান্তর হলো।
নূরী পুরোদমে সংসার গুছিয়ে নিতে লাগল। আসাদ ভাবতো তার বিশাল বড় এই ঘরে কোনো কিছুর কমতি নেই। কিন্তু নূরীর জন্য সেটা ভুল প্রমাণিত হলো। এই বাড়িতে রান্নার সামগ্রীই নেই। কেননা আসাদ সবসময়ই হোটেল থেকে এনে খেতো। আসাদ প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে আনলো। নূরী সব গুছাতে লাগল। আসাদও তাকে সাহায্য করতে লাগল। সবকিছু গুছানোর পর নূরী হাসি দিয়ে বলল, “তোমাদের শহরে রান্না কি তেল ছাড়াই হয়?
আসাদ মাথায় হাত দিলো। সে তো তেল আনেইনি। আসাদ ছুটলো তেল আনতে। নূরী হেসেই যাচ্ছে।
মা হওয়া প্রতিটি মেয়ের জন্য খুশির খবর। নূরীও খুশি। কিন্তু আজ তার বাবা-মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। আজ যদি তার পরিবার পাশে থাকতো তাহলে আনন্দ আরও বাড়তো। রাতে আসাদের সাথে রাকিবও এলো। নূরীকে অভিনন্দন জানালো। আসাদকে স্বামী হিসেবে পেয়ে নূরী নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে। আসাদের মন যেমন পবিত্র তার ভালোবাসাও তেমন গাঢ়। আসাদ তাকে অত্যন্ত ভালোবাসে। তার দেখাশোনায় ত্রুটি রাখে না। সুখের সাগরে ভাসতে লাগল নূরী। তবে এই সুখের মাঝেও সে তার পরিবারকে ভুলেনি। আসাদ প্রতিদিন তাকে হাত খরচের জন্য টাকা দেয়। নূরী সেই টাকা জমিয়ে মাস শেষে রাকিবকে দিয়ে গ্রামে পাঠায়। পরিবারের খবরাখবর রাকিবের মাধ্যমে পায়।
আজ আসাদ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে এলো। ঘরে এসে রাকিবকে দেখতে পেল।
- কিরে তুই কখন এলি? আমাকে তো জানালিও না।
- এইতো ভাই কিছুক্ষণ আগে এসেছি। হঠাৎ এসেছি তো তাই জানাইনি।
বুয়া এসে শরবত দিয়ে গেল। ঘরের কাজকর্ম করার জন্য বুয়া রাখা হয়েছে। রাকিব বলল, “বুয়া রেখে একদম ভালো করেছেন ভাই। এই মুহূর্তে নূরীর সর্বোচ্চ বিশ্রামের প্রয়োজন।”
- সেটা তো তোর বোন বুঝে না। সে সারাক্ষণ এটা সেটা করতে চায়।
নূরী বলল, “একটু আধটু করলে কিছু হয় না। একেবারে অলস হয়ে বসে থাকা যায় নাকি?”
শুরু হলো তাদের তর্কবিতর্কের পর্ব।
মধ্যরাতে হঠাৎই নূরীর প্রসব বেদনা উঠলো। আসাদ সাথেসাথে নূরীকে হাসপাতালে নিয়ে এলো। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রাকিবও চলে এলো। দুঃশ্চিন্তার মাঝে তাদের নির্ঘুম রাত কাটলো। সকাল সকাল সুখবর এলো নূরী একটা ছেলে জন্ম দিয়েছে। আসাদের ঘরে আনন্দ আরও বেড়ে গেল। ধীরে ধীরে নূরী আবার সাংসারিক কাজে মনোযোগ দিলো। তাই বুয়াকে বাদ করে দিয়েছে। এই নিয়ে আসাদ বেশ অনুযোগ করে বলল, “তুমি একা কত দিকে সামলাবে? মাহিম আরেকটু বড় হতো তারপর বুয়া বাদ দিতে।”
- শুনো, তিনজনের এই ছোট্ট সংসার আমি একাই সামলাতে পারবো। তোমাকে ওতো চিন্তা করতে হবে না।
সংসার বেশ সুখেই যাচ্ছে। সবকিছু একদম পরিপাটি। নূরী তার স্বামী-সন্তানের দিকে যথেষ্ট খেয়াল রাখে। বিকেলে আসাদ বাসায় চলে এলো। বিল্ডিংয়ে প্রবেশের সময় এন্ট্রি খাতায় নিজের সাইন করার সময় তার দৃষ্টি রাকিবের নামের ওপর গেল। সে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল, “রাকিব এসেছিল?”
- জ্বি স্যার। দুপুর বারোটায় এসেছিল।
- আচ্ছা।
আসাদ কিছুটা ভাবনায় পড়লো। রাকিব বাসায় এসেছে কিন্তু তাকে বলেনি। অথচ না বলে তো রাকিব বাসায় আসে না। আসাদ এই ব্যাপারে নূরীকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। নূরীও তাকে রাকিবের ব্যাপারে কিছু বলেনি। কিছুদিন পর আবারও এন্ট্রি খাতায় রাকিবের নাম দেখতে পায়। সেদিন দারোয়ান জানায় আসিদ মাঝেমাঝে দুপুরের সময় আসে আর ঘন্টাখানেক পর চলে যায়। এরপর থেকে আসাদ প্রতিদিন দুপুরে চলে আসে। এন্ট্রি খাতায় সাইন করে কিন্তু বাসায় যায় না। ছাদে সময় কাটিয়ে তারপর বাসায় আসে। এক দুপুরে এন্ট্রি খাতায় রাকিবের নাম দেখতে পেল। তবে এখনো যায়নি। ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি আসাদের কাছে আছে। সেই চাবি দিয়ে আসাদ চুপচাপ ঘরে ঢুকে পড়ে। ধীরগতিতে নিস্তব্ধতার সাথে আসাদ এগোতে থাকে। বেডরুমের দিকে আসতেই নূরী ও রাকিবের গলার শব্দ শুনতে পায়। রুমের দরজা খোলা আছে। আসাদ আড়াল থেকে ভেতরে উঁকি দেয়। দেখতে পারে বেশ গম্ভীরতার সাথে দুজনে কথা বলছে। নূরীকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। তাদের কথা শুনার জন্য একটু এগোতেই মাহিমের কান্নার শব্দে তাদের কথা বন্ধ হয়ে গেল। নূরী তাকে কোলে নিয়ে দুলতে লাগল। কিছুক্ষণ পর রাকিব বেরিয়ে পড়লো। নূরী দরজা আটকিয়ে দিলো। আসাদ এককোণায় লুকিয়ে রইলো। সুযোগ বুঝে আসাদও বেরিয়ে পড়লো। তারপর সময়মতো স্বাভাবিকভাবে কলিংবেল বাজিয়ে ঘরে ঢুকলো।
গভীর রাত। শহরটা ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশাচরের মতো কিছু লোক জেগে আছে। আজ আসাদ তাদের দলে যোগ দিয়েছে। গণিতের সমস্যা সমাধানের জন্য যেমন সূত্র থাকে। তেমনই মানব সমস্যা সমাধানের জন্যও কিছু সূত্র রয়েছে। অনেক সময় এই সূত্র দিয়ে সমাধান মিলে যায়। আবার অনেক সময় সমস্যা আরও জটিল হয়ে যায়। আসাদের জীবনেও এখন জটিলতা চলছে। সে ভেবেই পাচ্ছে না নূরী ও রাকিবের মধ্যে কি চলছে? আগে রাকিব কেবলমাত্র তার সাথে বাসায় আসতো। কিন্তু এখন তার অগোচরেও আসে। কিন্তু কেন? তাছাড়া নূরী কখনোই রাকিবের ব্যাপারে কথা তুলে না। ঘরে কেউ এলে কথায় কথায় তার প্রসঙ্গ উঠে আসে। কিন্তু নূরীর মুখে আজ পর্যন্ত রাকিবের ব্যাপারে কোনো কথা উঠেনি। তবে কি তাদের মধ্যে কোনো অবৈধ সম্পর্ক চলছে? এজন্যই কি নূরী ঘরে বুয়া রাখতে নারাজ? এজন্যই কি রাকিব চাকরি ছেড়ে অন্য কোথায় চাকরি নিয়েছে? যাতে আসাদের নজর থেকে দূরে থাকতে পারে। নূরী কি তাকে ধোকা দিচ্ছে? প্রতারণা করছে? আসাদের অন্তরটা কষ্টের তীব্রতায় কেঁদে উঠলো। তার জীবনে যা হয়েছিল সেই একই ঘটনা কি তার ছেলের সাথেও হতে যাচ্ছে? কিন্তু নূরীর আচরণে কখনো মনে হয়নি সে আসাদকে ভালোবাসে না। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের চা পর্যন্ত সবকিছুই নূরী বেশ যত্নের সাথে করে যাচ্ছে। তাহলে এই লুকোচুরির কারণ কি? আসাদ কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। তবে এটা বুঝতে পারছে যে তার অগোচরে কিছু একটা হচ্ছে। মাথার মধ্যে নানান চিন্তা করতে করতে একটা সময় সে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল।
প্রতিবছর গার্মেন্টসে পহেলাবৈশাখ পালন হয়। শ্রমিক-মালিকেরা এক হয়ে এই দিবস পালন করে। এবারও তাই করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে পরিবারের সবাই আমন্ত্রিত থাকে। সেই উপলক্ষেই নূরী তৈরি হচ্ছে। আসাদ এসে তাগাদা দিয়ে বলল, “আহা! কি করছ এখনো? তাড়াতাড়ি করো। সময় হয়ে যাচ্ছে তো। আর হ্যাঁ, নতুন যে হারটা বানিয়ে দিয়েছি ওটা পরবে।” নূরী তৈরি হতে হতে আচ্ছা ঠিক আছে বলল। তৈরি হয়ে তারা যাত্রা শুরু করলো। আসাদ দেখলো নূরী সেই হারটা পরেনি।
- কি ব্যাপার? তোমাকে না বলেছি নতুন হারটা পরতে।
- উফফ! মনে ছিল না।
- ঠিক আছে। আমি গাড়ি ঘুরাচ্ছি।
- এই এই না না। আসলে হারটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই এটা পরেছি।
- খুঁজে পাচ্ছিলে না মানে? এত দামী হার কোথায় যাবে?
- কোথায় যেন রেখেছি। কিন্তু আপাতত মনে পড়ছে না। ফিরে এসে খুঁজে দেখবো।
আসাদ আর কথা বাড়ালো না। সে স্পষ্ট নূরীর চোখে ভয় দেখেছে ও গলায় কাঁপুনি অনুভব করেছি। হারটা নিয়ে নূরীর মাঝে এতো চিন্তা কিসের? প্রায় আড়াই লাখ টাকার হার ওটা।
পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নূরী ও মাহিম। সবাই বেশ প্রসংশা করেছে নূরীর। মাহিমকে সবাই কোলে নিয়েছে। স্নেহ করেছে। অনুষ্ঠান শেষে তারা ঘরে চলে এলো। ঘন্টাখানেক সময় পেরিয়ে গেল। কিন্তু নূরীর মাঝে হার খোঁজার কোনো প্রবণতা দেখা গেল না। অথচ এই মেয়েটা একটা সুতাও যদি খুঁজে না পায় তবে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ায়। পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নেয়। কিন্তু আজ একেবারে নীরব।
নববর্ষ উপলক্ষে ঘরে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান রাখা হয়েছে। খুব কাছের লোকজনদের আমন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে। রাকিবও এসেছে। অনুষ্ঠান শেষে সবাই চলে গেল। স্বভাবতই রাকিব আরও কিছু সময় থেকে গেল। আসাদ তার কিছু বন্ধুদেরকে বিদায় দেওয়ার জন্য নিচে নেমেছিল। বিদায় দিয়ে তারপর আবার রুমে এলো। বেডরুমের দিকে আসতে লক্ষ্য করলো রাকিব ও নূরী চুপিসারে কথা বলছে। নূরীর চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আসাদকে দেখতেই তাদের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। আসাদ স্পষ্ট বুঝতে পারলো তাকে দেখার কারণেই তাদের কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন হয়েছে। তবে আসাদ ব্যাপারটা বুঝতে দেয়নি। সে স্বাভাবিক রইলো।
আসাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। যখন সে রাকিব-নূরীকে এক রেষ্টুরেন্টে দেখতে পেল। আসাদ তার বসদের সাথে সেখানে লান্স করতে এসেছে। চোখাচোখি হতেই নূরীর চোখে আতংক ছড়িয়ে পড়লো। তবে আসাদ তাদেরকে কিছু বলেনি। এমনকি তাদের কাছেও যায়নি। দূর থেকেই চোখাচোখি হয়েছে। দূর থেকেই আসাদ সরে গিয়েছে। রাত পেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ আসাদের কোনো খবর নেই। নূরী তার জন্য অপেক্ষায় আছে। বেশ কয়েকবার ফোনও দিয়েছে কিন্তু নাম্বার বন্ধ। নূরী ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। উপায় না পেয়ে রাকিবকে ফোন দিলো।
আসাদকে দেখে ইলিয়াস চমকে গেল। মাথায় থাকা পুলিশের টুপিটা টেবিলের ওপর রেখে বলল, “তুই হঠাৎ এখানে? আর চেহারার এই দশা কেন?” তারা দুজন ভার্সিটির বন্ধু। বেশি ঘনিষ্ঠ নয় আবার দূরেরও নয়। কিছু মাস আগে একবার রাস্তায় দেখা হয়েছিল দুজনের। তারপর থেকে টুকটাক যোগাযোগ অব্যাহত থেকেছে। আসাদের মুখে সব শুনে ইলিয়াস একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এই যুগে এসেও তুই এতো বড় বোকামি কিভাবে করলি? এটা স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে যে রাকিব অর্থসম্পদের জন্য তোকে ফাঁদে ফেলেছে। তারই পরিচিত মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দিয়েছে। হতে পারে এই মেয়ে তার প্রেমিকা। তুই কিভাবে যাচাইবাছাই না করেই বিয়েটা করলি? বিয়ে কি ছেলেখেলা?” ইলিয়াসের মুখে অর্থ সম্পদ শব্দটা শুনে আসাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিতে বিয়ের দিনের একটা ঘটনা মনে পড়লো। রাকিবের কথায় কাবিননামা বিশ লক্ষ টাকা লেখা হয়েছিল। এতো কেন জানতে চাওয়ায় রাকিব বলেছিল, “এতবড় ম্যানেজারের কাবিননামা লাখ বিশে না হলে ভাব জমে না।” সেদিন আসাদ ব্যাপারটা নিয়ে তেমন ভাবেনি। কিন্তু তার মস্তিষ্কে ব্যাপারটা নাড়া দিয়ে উঠলো। ব্যাপারটা ইলিয়াসকে জানালো। ইলিয়াস বলল, “দেখ, বর্তমানে এসব নারী ব্যাপার গুলো খুব ঝামেলার। তারওপর তোর কাছে কোনো প্রমাণও নেই। এমতাবস্থায় ডিভোর্স দিতে হলে কাবিনের পুরো অর্থের পাশাপাশি আরও কিছু খরচাপাতি দিতে হবে।”
- টাকা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু আমার ছেলেটার কি হবে? ওর জীবনটা নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলল কেন?
- কিছু মনে করিস না। বন্ধু হিসেবে নয় পুলিশ হিসেবে বলছি। এমনও তো হতে পারে ছেলেটা তোর না, রাকিবেরই।
আসাদের অন্তরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। মনে হলো কেউ তার বুকের মধ্যে ছুরি বিঁধে দিয়েছে।
পরেরদিন খুব সকালে আসাদ বাসায় এলো। সাথে রাকিবকেও নিয়ে এসেছে। পুলিশের পোশাকে ইলিয়াসও আছে। এসব দেখে নূরী অবাক হয়ে বলল, “কোথায় ছিলে সারারাত? আর সাথে পুলিশ কেন? কি হয়েছে?” আসাদ শান্ত গলায় বলল, “বোসো। কিছু কথা আছে।” আসার সময় তারা রাকিবকে তার বাসা থেকে তুলে এনেছে। সেই বাসায় নূরীর হারটা পেয়েছে। পথিমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদের সময় রাকিব বলেছে, নূরী তার প্রেমিকা। অর্থ সম্পদের জন্য আসাদকে তারা ফাঁসিয়েছে। খুব শীঘ্রই ডিভোর্সের জালে ফেলে বিশ লাখ টাকা নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। সব শুনে আসাদের মাথায় রক্ত চেপে গেল। সে দুয়েকবার রাকিবের গলাও চেপে ধরেছিল। তবে ইলিয়াস ছাড়িয়ে নিয়েছে। আসাদ ভাবতেও পারেনি রাকিব ও নূরীর আসল রূপ এমন বিভত্স।
আসাদ তার পকেট থেকে হারটা বের করে নূরীর সামনে রাখতেই নূরীর চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। আসাদ বিষণ্ণ গলায় বলল, “কেন এমন করলে?” নূরী তার মাথা নিচু করে বলল, “আমি বাধ্য ছিলাম।”
আসাদ চেঁচিয়ে বলল‚ “কি এমন বাধ্যবাধকতা যার জন্য তুমি আমার জীবন তছনছ করে দিলে?” নূরী ভয়ে কেঁপে উঠলো। তার কোলে থাকা মাহিমও ভয়ে কেঁদে উঠলো। নূরী বলল, “তুমি কি পাগল হয়েছ? এভাবে কেউ চিত্কার করে? ছেলেটা ভয় পেয়েছে।” আসাদ আবার চেঁচিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি পাগল হয়েছি। তোরা আমাকে পাগল করেছিস। বেঈমান।” নূরী অবাক দৃষ্টিতে আসাদের দিকে তাকালো। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই রাকিব বলল, “নূরী, আর লুকিয়ে লাভ নেই। আমি সব বলে দিয়েছি।”
নূরী করুণ দৃষ্টিতে আসাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “সব জানার পরেও তুমি আমাকে বেঈমান বললে? এই তোমার ভালোবাসা?” আসাদ উঠে দাঁড়ালো। নূরীর দিকে তেড়ে যেতে লাগল। কিন্তু ইলিয়াস এসে বাধা দিয়ে একপাশে নিয়ে গেল। একটা ব্যাপার ইলিয়াস লক্ষ্য করেছে। আসাদের চিত্কারে যখন মাহিম কেঁদে উঠেছিল। নূরী তখন আসাদকে উল্টো ধমক দিয়েছিল। ইলিয়াস এই ব্যাপারটা আসাদকে জানালো। আসাদ বলল, “তাতে কি হয়েছে?”
- নূরীর মধ্যে যদি কোনো কেলেংকারী থাকতো তাহলে এই অবস্থায় ছেলে হাসে না কাঁদে সেদিকে লক্ষ্য রাখতো না। আমার মনে হয় রাকিব আমাদের কাছে কিছু একটা লুকিয়েছে।
নূরীকে অন্য রুমে আনা হলো। রাকিবকে কনস্টেবলের কাছে রাখা হয়েছে।
নূরী - আর কি জানতে চান? সবই তো রাকিব ভাই বলেছে।”
ইলিয়াস - রাকিব যা বলার বলেছে। আমরা তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই।
- কি হবে আর বলে? ওর চোখে তো আমি প্রতারক।
- তবুও বলুন। হয়তো এমন কিছু সত্য আছে যা রাকিব বলেনি।
নূরী তার পুরো জীবন বৃত্তান্ত বলল। তা শুনে সবাই চমকে গেল। নূরী এবং রাকিবের বলা ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আসাদ বলল‚ “কিন্তু বিয়ের সময় তুমি বলেছিলে তোমার বাবা-মা নেই। চাচার কাছে মানুষ হয়েছ।”
- আমি তখন অসহায় ছিলাম। রাকিব ভাই যেভাবে বলতে বলেছিল সেভাবেই বলেছিলাম। আমার বাবা-মা, ভাইবোন আছে। প্রতিমাসে তোমার দেওয়া হাত খরচের টাকা জমিয়ে রাকিব ভাইয়ের মাধ্যমে আমি তাদের কাছে পাঠাই। রাকিব ভাইয়া প্রায়শই ঘরে আসতো বাবা-মায়ের খবর জানাতে। কিছুদিন আগে রাকিব ভাই জানিয়েছে মা ভীষণ অসুস্থ। টিউমার হয়েছে। অপারেশনের জন্য অনেক টাকা লাগবে। তখন এই হারটা আমি রাকিব ভাইকে দিয়েছিলাম।
নূরীর দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী ইলিয়াস সেখানের থানায় যোগাযোগ করলো। নূরী ও তার পরিবারের সত্যতা প্রমাণ হলো। বোরহানের ঘটনাও প্রমাণ হলো। বছরখানেক ধরে বোরহান নিরুদ্দেশ। গ্রামে তাকে আর দেখা যায়নি।
আসাদ বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না কে সত্য বলছে। রাকিব নাকি নূরী? রাকিব তার অনেক পুরানো বিশ্বস্ত ছোট ভাই। আর নূরী তো জীবন মরণের সাথী। তবে মিথ্যে বলছে কে? সব জানার পর ইলিয়াস বলল, “ভাবীর কথাই সত্য। তাহলে রাকিব এটা কেন বলল ভাবী তার প্রেমিকা ছিল?” নূরী সটান করে উঠে দাঁড়ালো। চেঁচিয়ে বলল, “কি? রাকিব ভাইয়া এমন বলেছে?” ইলিয়াস মাথা দুলালো। নূরী তাত্ক্ষণিক রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কিন্তু রাকিব নেই। সে কনস্টেবলকে আহত করে পালিয়েছে। কিছু পরামর্শ দিয়ে ইলিয়াসও চলে গেল।
আসাদ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। নূরীও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। কিন্তু মাহিমের কান্নার শব্দে সে উঠে পড়লো। ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল। তারপর আসাদের কাছে এসে বলল, “কি হয়েছে বসে আছ কেন? ওকে ধরো। আমি রান্নাটা সেরে আসি।” আসাদ মলিন মুখে নূরীর দিকে তাকালো। তারপর শুষ্ক কণ্ঠে বলল, “আমি……আমি… খুব…”
- দেখো, আমাদের কোনো দোষ নেই। সবই রাকিব ভাইয়ের চক্রান্তের ফল। তাহলে আমরা কেন নিজেদের জীবনে অশান্তি রাখবো? যা হয়েছে ভুলে যাও। বাবুকে ধরো। রান্না না করলে খাবে কি?
নূরী রান্নাঘরে চলে গেল। আসাদ তাকিয়ে রইলো। নূরীর আচরণ দেখে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। অথচ আজ সে নূরীর দিকে সবচেয়ে বড় কলংকের দাগ ছুড়ে দিয়েছিল। হতে পারে মেয়েটা শিক্ষিত নয় কিন্তু তার মনমানসিকতা-উদারতা আসাদকেও হার মানিয়েছে। কিছুদিন পর রাকিব পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে। সে স্বীকার করেছ অর্থের লোভে পড়ে এসব করেছে।
রাকিবের মতো কিছু কাল সাপ সবার জীবনেই আসতে পারে। সেই সময় প্রয়োজন হয় ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস ও ভরসার। যদিও এসবে আসাদ ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু নূরী সফল হয়েছে। তাই তো তাদের ভালোবাসা ভেঙে পড়েনি।
সমাপ্ত।