ছোটগল্প : বন্ধু

0 5
Avatar for Nikita11
4 years ago

বন্ধুদের মধ্যে আমি রানাকেই সবচেয়ে বেশী বিপদ-আপদে কাছে পেয়েছি। সে আমার বন্ধু থেকে সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে গেছে। আামদের দুই বন্ধুর বাসা পাশাপাশি একই এলাকাতে। লেখাপড়াও শেষ করেছি প্রায় একই সাথে। আব্বা অফিসে চাকুরীরত অবস্থায় হঠাৎ করে হার্ট এ্যার্টাক করে মারা যায়, সে জন্য কর্তৃপক্ষ আমাকে অনেকটা তড়িঘরি করে আব্বার অফিসে দৈনিক মজুরী ভিত্তিতে যোগদান করায় আর এক বৎসরের মাথায় আব্বার অফিসে আমার চাকুরীটা স্থায়ী হয়ে যায়। রানা সরকারি চাকরির চেষ্টা না করে নিজেই একটা ডিজাইন ফার্ম দেয়, সেখানেই সে নিজেই ডিজাইনার হিসাবে কাজ করে।

আমি আর রানা বিয়েও করেছি প্রায় একই সময়ে, রানা তাদের যৌথ পরিবারে তার বউ মিলি, দুই জমজ মেয়েকে নিয়ে একত্রে বসবাস করে। আর আমি চাকুরীর শর্ত মোতাবেক নিজের বাসা ছেড়ে কিছুটা দূরে অফিসের সরকারি কোর্য়াটারে বসবাস করছি। আমাদের দুই বন্ধুর বন্ধুত্বের সুবাধে দুই পরিবারের সদস্যদের সাথে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

হাল্কা, পাতলা গড়ন আর সুন্দরী চেহারার মিষ্টভাষী মিলিভাবি শিল্প আর সাংস্কৃতিক মনা ছিলেন। আমাদের পরিবারিক ও নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে ভাবিই নিজ থেকেই উদ্যেমী হয়ে বিভিন্ন দায়িত্ব নিতে পছন্দ করতেন। তিনি সবার সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে পারতেন বলে তার একটা আলাদাই পরিচিতি ছিল। আর ভাবি নিজে যেমন সাজতে পছন্দ করতেন ঠিক তেমনিভাবে যে কোন অনুষ্ঠানে তার জমজ দুই মেয়েকে পরীর মত করে সাজিয়ে নিয়ে আসতো সেটা অনেকেরই নজর কেড়ে নিতো।

বেশ কিছু দিন ধরে রানা তার ডিজাইন র্ফাম নিয়ে খুবই ব্যস্ততার মধ্যে সময় পার করছিল। আমরা দুই বন্ধু আর আগের মত আলাদাভাবে সেভাবে ঘুরে বেড়ানোর জন্য সময় বাহির করতে পারছিলাম না। তবে আমি সময় পেলেই বন্ধুর ডিজাইন ফার্মে যেতাম, সে কাজের মধ্যে ডুবে থেকেই সবার খোঁজ খবরটা সেরে নিতো, মন খুলে গল্প করতো। আমি তার সৃষ্টিশীল কাজ গুলি খুব মনোযোগ সহকারে দেখতাম, লক্ষ্য করতাম যে, সে তার কাজের মধ্যে মিলি ভাবির পছন্দের শাড়ীর রং গুলি দিয়ে বইয়ের প্রচ্ছেদ ফুটিয়ে তুলেছে তা দেখে আমি খুবই অবাক হতাম। মিলি ভাবির প্রতি রানার ভালোবাসা সে তার সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে ফুঁটিয়ে তুলতো।

বাসায় আম্মার সাথে দেখা করতে গেছি, ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা। তুমি কি জানো ভাইয়া, তোমার বন্ধু রানা ভাইয়ের সাথে মিলি ভাবির ডির্ভোস হয়ে গেছে। আমি হতভম্ব হয়ে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, কি বলিস সর্বনাশ! আমি তো কিছু জানি না। মিলি ভাবিই তো রানা ভাইকে তালাক দিয়ে চলে গেছে। কি এমন ঘটনা ঘটলো যে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। মিলি ভাবি তো যৌথ পরিবারের সাথে থাকতে চাচ্ছিল না। আরও অনেক কারন আছে তোমার বন্ধু তো দিন-রাত ডিজাইনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সংসারের দিকে তার নজর দেওয়ার একদমই সময় ছিল না। আর মিলি ভাবিরও নাকি? বিয়ের আগে থেকেই তার চাচাতো ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল।

দেখি, আমি রানার কাছে ব্যাপারটা কি তা জানার চেষ্টা করবো। দুপুরে আম্মার বাসায় খাওয়া-দাওয়া করার পর রানার বাসায় গেলাম। রানার পরীর মত যমজ দুই মেয়েকে দেখে নিজের মনটা আহত পাখির মত ঝটফট করতে লাগলো। চোখের পানি কিছুতেই ধরে রাখতে পারলাম না। মা ছাড়া মেয়ে দুটোও একে বারেই ভেঙ্গে পড়েছে। খালাম্মাকে বললাম আমি কি মিলি ভাবিকে ফিরে আনার চেষ্টা করে দেখবো কিনা?

বুঝলে বাবা আল্লাহতালা পাপী মানুষকে বেশীদিন ঘরে রাখেন না, ঘর হতে বাহির করে নেন। মেয়ে দুটোর কথা চিন্তা করে আমাকে সব মেনে নিতে হচ্ছে, বাবা। আমরা আমাদের বউমাকে কে একবার সুযোগ দিতে চায়। এই বয়সে আমি আর অশান্তি চায় না। আমি আমার ছেলের পরিবার আর সামলাতে পারছিনা। রানার ফার্মে গেলাম, রানাকে ভাবির ডির্ভোসের কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললো ঠিকই শুনেছিস।

মিলির চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছিল। সে একটু শৌখিন মেয়ে আগে থেকেই সাজতে খুব ভালোবাসতে কিন্ত বাড়ি-ঘর ঠিকমত সাজাতে পারেনি। সে তার লেভেলটাই ঠিকমত ধরতে পারতো না, অপরের টাকার উপর খুব লোভ ছিল। বন্ধু বল তো এখন কিভাবে আমি আমার সংসারটা ধরে রাখবো। নিজে তো পরিশ্রম করে যাচ্ছি, বউ আর দুটো মেয়েকে একটু সুখে রাখার জন্য।

মিলিতো আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। বন্ধু কষ্ট তো এখানেই মেয়ের বিয়ে দিতে গেলেও মায়ের পরিচয় লাগে। আম্মা কি বলেছে? খালাম্মা বলেছে বউমা যদি তিন মাসের মধ্যে নিজের ভূল বুঝতে পেরে ঘরে ফিরে আসে তাহলে ঘরে তোলে নিবে। রানা তোর কি মত, আম্মা তার বউমাকে ফিরিয়ে নিবে এতে আমার কোনো আপত্তি নাই।

রফিক বল তো সংসার পরিবার নিয়ে কি আমার ওতো ভাবার সময় আছে। বর্তমানে এই পেশাতে খুবই প্রতিযোগিতা নিজেই ঠিকমত টিকে থাকতে পারছি না। ভাবির দেওয়া তালাকের সময় পার হতে আর তিন মাসের মধ্যে আর দুই দিন বাকী আছে। তুই নিজ থেকে কোন যোগাযোগ করেছিস নাকি, চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু মিলি আমার মোবাইল ধরেনি। আমি একটু চেষ্টা করে দেখব নাকি দেখতে পারিস কিন্ত বন্ধু হিসাবে বলতে পারি তোর পরিবার আছে, অন্যের পরিবারের অশান্তি নিজের পরিবারে আনা ঠিক না।

সন্ধ্যার পর রানার অফিসে বসেই মিলি ভাবিকে মোবাইল করলাম। ভাবি, কেমন আছেন বলতেই খুব একটা ভালো নেই বলে জানালেন। ভাবি আপনার তো রানার সংসারে ফিরতে কোন অসুবিধা নেই। আপনার দুই মেয়ের কথা চিন্তা করেও তো আপনাকে সংসারে ফিরে আসা উচিত। আমি রানার সাথে কথা বলেছি, খালাম্মার সাথে আলাপ হয়েছে তারা আপানাকে একবার সুযোগ দিতে যাই। তাছাড়া তিন মাস হওয়ার আর দুইদিন বাকী আছে, আপনি কালকেই আবার সংসারে ফিরে আসেন।

রফিক ভাই, আমি রানার পরিবারকে অনেক অসম্মান করেছি তাছাড়া পাড়া-প্রতিবেশীরাও আমার ডির্ভোসের ব্যাপারটা জেনে গেছে, রানা তার পরিবার ছেড়ে আমাকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠবে না। আমার আর ওই বাসায় ফিরে যাওয়া সম্ভব না, ভাই আপনি পারেন আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে । আমাদের সংসারটা বাচাঁতে আপনার একটু সহযোগিতার দরকার। আপনি একটু সাহায্য করলেই দুই এতিম বাচ্চা তার মাকে ফিরে পাবে। আপনার বন্ধুও পরিবার ফিরে পাবে। আমিও তো আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আমি কি ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি, বলেন ভাবী।

রফিক ভাই আমি নিজেকে একটু প্রতিষ্ঠা করার পর আবার রানার সংসারে ফিরে যাবো। আমার মেয়েদের কাছে ফিরে যাবো। আপনি তো জানেন, আমি শিক্ষিত মেয়ে বিএ অনার্স করার পর এম,এ টা আর করা হয়নি। আমি এম,এ টা শেষ করবো এরই ফাঁকে ফাঁকে আমি চাকুরীরও চেষ্টা করতে থাকবো। রানার ফার্মের অবস্থাও খারাপ, আমার চাকুরীটা খুবই দরকার নাহলে আমাদের পথে বসতে হবে।

আমাকে পারতেই হবে ভাই, আমি রানাকে খুব ভালবাসি তার সংসারে একটু আর্থিক সচ্ছলতা আনতে চাই। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছেন। আমি আমার জীবনকে নতুনভাবে সাজিয়ে রানার ঘরে ফিরতে চাই, আমি এতদিন তাকে চিনতে পারিনি, তার মতো স্বামী কম মেয়ের ভাগ্যেই জুটে। আমি রানাকে আমার জীবনের চেয়েও ভালবাসি। ভাই আমাকে আর একটা কথা দেন আমার স্বপ্নের কথা আপনার বন্ধুকে জানাবেন না। ঠিক আছে, কথা দিলাম।

ভাই আমার আপাতত এম, এ ক্লাশে ভর্তি, কম্পিউটার টেনিং আর মহিলা হোষ্টেল খরচ বাবদ পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে। আমার বিকাশ নম্বরে পাঠিয়ে দিয়েন। অফিসে কোন কাজেই ঠিকমত মন বসাতে পারছি না। মিলিভাবি কত চেষ্টা করছে নিজের অতীত ভূলে সবকিছু নতুন ভাবে গড়তে। রানার সংসারে ফিরে আসার জন্য নিজেকে কত কষ্ট করে তৈরী করছে। আমার বার বার রানার দুই মেয়ের জন্য মনটা খুব খারাপ হতে লাগলো। অফিসে জিপিএফ ফান্ডের পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য আবেদন করলাম। প্রতি মাসে দুইহাজার টাকা করে পঁচিশ কিস্তিতে ভাগ করে পরিশোধ করবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। মিলি ভাবিকে টাকা দিয়ে মনে মনে একটু আনন্দ অনুভব করলাম। বেশ কিছু দিন পর ভাবি আবার আমার কাছে টাকা চাচ্ছে, দুই লক্ষ টাকা দিলেই নাকি চাকুরীটা হয়ে যাবে। চাকুরীটা হলে আমাকে নাকি আস্তে আস্তে টাকা পরিশোধ করে দিবে।

আম্মাকে প্রতি মাসে যে টাকা দিই তা গত দুই মাস থেকে দিতে পারছি না বলে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। আজকে বিকালে অফিস শেষ করে ভাবির স্বপ্ন পূরনে আমার আর্থিক অসংগতির কথা বলে আসবো। আম্মাকেও কয়েক মাস ধরে সংসারের খরচ দিতে পারছি না সেটাও ভাবিকে খুলে বলবো।

মিলি ভাবিকে মোবাইলে কল দিয়ে মোবাইল বন্ধ পেলাম। কি যেন একটা অজানা আশঙ্কা মনের মধে তোলপাড় করছিল। অফিস শেষ করেই ভাবির মহিলা হোস্টেলে গেলাম। মহিলা হোস্টেল সুপারের সাথে কথা হল ভাবির চেহারার বর্ণনা দিলাম। তিনি জানালেন এই হোষ্টেলে মিলি নামের এম, এ ক্লাশের কোন ছাত্রী থাকেনা।

মিলি ভাবির নম্বরে বার বার কল দিয়ে মোবাইল বন্ধ পাচ্ছি। উৎভ্রান্তের মত বন্ধুর কাছে গেলাম, রানা তার ফার্ম নিয়ে ব্যস্ত আছে তার কাজের খুব চাপ বেড়েছে এখন নাকি কাজের ভরা মৌসুম। বন্ধু তোকে তো আমার বিয়ের কথা বলাই হয়নি। কার সাথে বিয়ে আমার মামাতো বোনের সাথে, আম্মা পছন্দ করেছে। আমার মেয়েরাও তার নতুন মাকে পছন্দ করেছে।

মিলি ভাবির খবর কিছু জানিস নাকি, গত মাসেই তো এক ব্যবসায়ীর সাথে মিলির বিয়ে হয়ে গেছে। আম্মাকে দাওয়াত করেছিল, আম্মাতো মিলির বিয়ে নিজের চোখে দেখেই এসেই আমার বিয়ের ব্যবস্থা করলো।

আমি এখন উঠি বন্ধু, বাহিরে তো প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে যাস না। রফিক আমি তো তোর শুধু সুখের বন্ধুনা, দুঃখের ও তো বন্ধু। এত অভিমান করে আছিস কেন কি হয়েছে আমকে সব খুলে বল। খালাম্মা বলছিল তুই নাকি কয়েক মাস ধরে বাড়ীতে কোন খরচ দিস না। কি হয়েছে তোর, আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম হাউ-মাউ করে কেদেঁ ফেললাম।

মিলির খপ্পরে পড়েছিস, তাই না, কত টাকা নিয়েছে পঞ্চাশ হাজার টাকা। এইনে, দশ হাজার টাকা খালাম্মাকে দিবি। পঞ্চাশ হাজার টাকা কোথায় পেলি, অফিসে জিপিএফ ফান্ড থেকে লোন করেছি। কত করে কিস্তি কাটে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা। কিস্তি শোধ না হওয়া পর্যন্ত, অফিস শেষ করে আমার র্ফামে দুই ঘন্টা করে প্রুফ রাইটারের কাজ করবি, আমি তোকে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে দিবো। আমার গা ছুঁয়ে বল, মিলির ব্যাপারটা ভূলে যাবি। তোর কিছু হলো খালাম্মা কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মত ঘুরে বেড়াবে। তোকে আমি খুব ভালবাসি বন্ধু। চল বাহিরে যাই বৃষ্টি থেমে গেছে, দুই বন্ধু একটু বাহিরে ঘুরাফিরা করবো। ভালো-মন্দ খাবো। আমি কোন কথা বলতে পারছি না, শুধু বন্ধুর পিছে পিছে হাঁটতে থাকলাম।

1
$ 0.00
Avatar for Nikita11
4 years ago

Comments