বৃদ্ধ বয়সে,
হাঁটতে হাঁটতে, আমি একদিন পথ হারিয়ে
ঠিক তোমার বাড়ির সামনে এসেই দাঁড়াব।
বাড়িটা খুব চেনা চেনা মনে হবে, কারণ—
শেষ এসেছিলাম ত্রিশ বছর আগে, তোমার বিয়েতে।
অবশেষে চিনব, একটু কষ্ট হবে চিনে নিতে,
আসলে বয়সের ভারে অনেক স্মৃতি হারিয়ে গেছে।
তবে আজ-কাল খুব অবাক হই, এই যে এত এত হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির মধ্যে তোমার কোনো স্মৃতি নেই!
‘ছেলেটা বড্ড চঞ্চল, আর দুষ্ট হয়েছে।
কাব্য, কাব্য, এভাবে দৌড়াদৌড়ি করিস নে।
আমার বয়স হয়েছে,তোর পিছনে কি দৌড়াতে পারি?’
তুমি কথাগুলো বলতে বলতে, ছোট একটা ছেলের পিছে পিছে আসছ, তোমার দ্রুত হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।
ছেলেটা দৌড়ে এসে, আমার পেছনে লুকিয়ে পড়ল।
আমার পিছন থেকে বারবার উঁকি দিয়ে দেখছে—
তুমি কীভাবে তাকে খুঁজে বের করো।
তুমি কয়েক কদম সামনে, আস্তে আস্তে হেঁটে আসছ। এক এক কদম দূরত্ব কমছে, সেই সাথে একটু একটু করে বুকের ব্যথাটা বাড়ছে, নিঃশ্বাস দীর্ঘ হচ্ছে!
“কেমন আছ, কাব্য,” তুমি প্রশ্ন করলে।
পেছনে থাকা ছেলেটা হঠাৎ আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “আপনার নাম বুঝি কাব্য? আমার নামও কাব্য।”
এই বলেই দৌড়ে ভেতরে চলে গেল।
সময় দ্রুত যাচ্ছে, আমি নিজেকে যতটা স্বাভাবিক করতে চাচ্ছি ততই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি।
তুমি হাসতে হাসতে বললে, তোমাকে সেই প্রথম দিনের মতো লাগছে, নার্ভাসে ঘেমে শার্টটা ভিজিয়ে ফেলেছিলে, কপাল থেকে টুপটাপ ঘাম পড়ছিল, জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিলে।…
কুঁচকে যাওয়া হাতের চামড়া যেন তোমার স্পর্শ পেয়ে, আবার জীবিত হতে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্পর্শের অনুভূতি হাত থেকে মস্তিষ্কে পৌঁছে, সেই প্রথম স্পর্শের অনুভূতিটাকে আবার জাগ্রত করল!
বেলকনিতে দু’টি চেয়ার ছিলো, তুমি হাত ধরে নিয়ে গিয়ে সেখানে বসতে বললে। আমাকে বসিয়ে দিয়ে, তুমি আমার সামনে বসলে।
সাদা চুল, মুখে এখানে সেখানে ভাজ পড়া চামড়া,
রং উঠে যাওয়া কয়েকটা চুড়ি, তোমাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে।
তুমি আমাকে নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকলে,
আমি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিতে থাকলাম।
সেই চেনা, বড় বড়, রাগি রাগি চোখে বললে,
“কথা বলবে না?”
অনেক সময় চলে গেছে,
নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছি।
বললাম, “এতগুলো বছর, কিভাবে ছিলে?”
আমার প্রশ্নের সহসা উত্তর দিতে পারলে না!
তুমি বললে, “দেখতে দেখতে কেটে গেছে।
সংসার, ছেলে-মেয়ে, তাঁদের বিয়ে, এখন নাতি-নাতনিদের সাথে কেটে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে কিছুটা কষ্ট হয়েছিল। ধীরে ধীরে ব্যস্ততা বাড়তে থাকল। এই ব্যস্ততায় এতটা পথ নিয়ে এসেছে।…
একটা সময় পর আর নিজেকে প্রশ্ন করিনি- ‘কেমন আছি?’ ”
“তুমি কেমন ছিলে, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি কেমন আছে?”
আমি খুব সহজ উত্তরে বললাম, “কীভাবে যেন একাই কাটিয়ে দিলাম এতটা বছর।
অনিন্দ্রা এতিমখানায় থাকা ছেলেমেয়েদের সাথে দিব্বি কেটে গেছে।”
বহুবছর পড় তোমার চোখের জল দেখলাম।
তুমি খুব ভারি কন্ঠে বললে, “তোমার কন্ঠে আবার এই নামটা শুনবো ভাবিনি কখনো।”
রোদে পোড়া, ফেটা যাওয়া মাটি বহুবছর পর
বৃষ্টি ছোঁয়া পেয়ে যেভাবে কাদামাটিতে পরিণত হয়
ঠিক সেভাবে— আজ তোমার চোখের দুফোঁটা জল, আমার বুকের ভেতর সব এলোমেলো করে দিল।
আমিও বুকে জমা থাকা, বহু বছরের কান্না,
চাপা দিয়ে রাখতে পারিনি।
নিস্তব্ধতায় কেটে গেলো অনেকটা সময়।
তুমি নিজেকে সামলে নিলে, শাড়ি আচল দিয়ে চোখের জল মুছলে।
এই বৃদ্ধ বয়সেও আবার নতুন করে তোমার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হলো। বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো,
“বাকিটা সময় না হয় একসাথে কাটিয়ে দেই?”
কিছুই বলা হলো না৷ শুধু বলা হলো, আজ চলি।
তুমিও কিছু বললে না। শুধু বললে, “নিজের যত্ন নিও।”
“তুমিও নিজের খেয়াল রেখো।”
এই বলে উঠে চলে যেতে শুরু করলাম।
ভাবলাম, কিছু কথা না বলাই ভালো!
সাহস হলো না, যেতে যেতে ঘুরে এর একটিবার তোমাকে দেখার।
তোমার অশ্রু ভর্তি চোখ দেখার মত সাহস আমার আজও নেই।
আর আমিও চাইনি, যে তুমি আমার অশ্রু ভরা দু'চোখ দেখো।
জানো, যেতে যেতে, হঠাৎ মনে হলো,
একদিন আমরা বেঁচে থাকবো না। তবে—
একে অন্যকে ভালোবেসে ডাকা নাম দুটো বেঁচে থাকবে।
বেঁচে থাকবে- ‘অনিন্দ্রা কাব্য!’