বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম

0 21
Avatar for Mumu
Written by
3 years ago

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম কাজী নজরুল ইসলাম রাঢ় বাংলায় জন্ম নেওয়া একজন বাঙালি কবি এবং পরবর্তী কালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম পরিচিতিঃ

কাজী নজরুল ইসলাম ১১ ই জৈষ্ঠ্য ১৩০৬ সালে (২৪ শে মে ১৮৯৯) ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

তার বাবার নাম কাজী ফকির আহমদ। মা জায়েদা খাতুন। খুব ছোটবেলায় নজরুলের বাবা-মা মারা যান। তারপর শুরু হয় দারিদ্র্য এবং অন্যসব প্রতিকূলতার সঙ্গে তার লড়াই। ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল বলে নজরুলের ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’।


গ্রামের মক্তব থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন নজরুল। মাত্র বারো বছর বয়সে যোগ দেন গ্রামের লেটো গানের দলে। গ্রামের মক্তবেও কিছুদিন শিক্ষকতা করেন তিনি। তারপর আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ নেন। সেখানে এক বাঙালি পুলিশ অফিসারের নজরে পড়ে যান তিনি। সেই অফিসার তাকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীর হাবিলদার হিসেবে যোগদান করেন। এখানেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।

কাজী নজরুল ইসলামের সৈনিক জীবনে সাহিত্য চর্চাঃ

চুরুলিয়া হলো বর্ধমান জেলার কয়লাখনি অঞ্চল। ইংরেজদের শাসনামলে এই গ্রামে আণ্ডাল থেকে চুরুলিয়া পর্যন্ত একটা রেলপথও চালু ছিল। ভারতের স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যে এই রেলপথ বন্ধ হয়ে যায়।

নজরুল তাঁর জন্মস্থান চুরুলিয়া গ্রাম থেকে এক সময় বেরিয়ে পড়েন। এই বেরিয়ে পড়া নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখার আগ্রহ নিয়ে। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন তিনি। ছোট পৃথিবী ছেড়ে বড় পৃথিবীর স্বপ্ন, লেখাপড়া শিখেছেন নানান স্কুলে। রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে, বর্ধমানের মাথরুন বিদ্যালয়ে। আবার বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার কাজীর শিমলায় দরিরামপুর হাইস্কুলে। এসব তাঁর খাম-খেয়ালির মতো ব্যাপার ছিল না। আসলে যাঁরা বড় মাপের মানুষ হন, বিশেষ করে স্বপ্ন দেখা ভাবুক মানুষ তাঁদের ভিতরে অস্থিরতা থাকে। জীবনকে, দেশকে, জগতকে দেখার জন্য তাদের সব সময়ই মনে হয়, হোথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনো খানে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভুষণের মতো মানুষদের মধ্যেও এমনটা ছিল। পৃথিবীর অন্য অনেক বিখ্যাত লেখকদের জীবনেও এমনটা দেখা যায়। এ যেন তাদের এক স্বপ্নের দেশ, স্বপ্নের পৃথিবী খুঁজে বেড়ানো।

কবি নজরুল খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। ধরাবাধা গতানুগতিক পথ যেন তার জন্য নয়। সিয়ারসোল হাইস্কুলে দশম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষায় বসার আগেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। দেশের যারা যুবক তারা অনেক স্বপ্ন দেখতেন যে, বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক হতে পারলে অস্ত্র চালনা শেখা যাবে। সেই অস্ত্র উঁচিয়ে ধরা যাবে ভারতের ইংরেজ শাসকদের উপর। লেখা-পড়ার চাইতে তাঁরা তখন দেশ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন। এসই স্বপ্নই তাঁকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। কত কষ্ট করেছেন ঘর ছেড়ে বের হবার পর। কাজী বাড়ির ঠুনকো আভিজাত্য ভেঙে রুটির দোকানে কাজ করেছেন। কিন্তু এসবের মধ্যেও ছেলেবেলার লেখা-পড়ায় দারুণ আগ্রহ ছিল তাঁর। সেই আগ্রহেই ময়মনসিংহের মতো অতো দূরের এখনকার বাংলাদেশের গণ্ডগ্রামে গিয়ে থেকেছেন। সেখানে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনাও করেছেন।

নজরুল যদি যুদ্ধে যোগ না দিতেন তাহলে তাঁর জীবন কেমন হতো কে জানে। কিন্তু যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই তাঁকে সৈনিক কবি করে তুলেছিল। পৃথিবীর নানান দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ তাঁকে উৎসাহী করে তুলেছিল।

করাচির সেনানিবাসে থাকার সময় তিনি লেখেন প্রথম কবিতা ও গল্প। কলকাতার পত্রিকাতে তা ছাপা হয়। করাচিতে নজরুল ছিলেন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার। এই যুদ্ধক্ষেত্রেই পল্টনের আরো দু’জনের সঙ্গে নজরুলের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ডিসিপ্লিন ইনচার্জ শম্ভু রায়। অন্যজন মণিভুষণ মুখোপাধ্যায়। এই মণিভূষণ পরবতীকালে ‘লাঙল’ পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন। তাঁর আরেকটি প্রতিভা ছিল সংগীত প্রতিভা। মণিভূষণ নিয়মিতভাবে নজরুলের সঙ্গে সংগীতের তালিম নিতেন, এছাড়া আরো একজনের নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি হলেন হাবিলদার নিত্যানন্দ দে – যাঁর বাড়ি ছিল হুগলীর ঘু্টিয়া বাজারে। এই নিত্যানন্দের কাছ থেকেই নজরুল অরগ্যান বাজানো শিক্ষা গ্রহণ করেন।

নজরুলের জীবনে করাচি সেনানিবাসে থাকা এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সৈনিকের জীবন-যাপন করেও তিনি লেখাপড়া ও সাহিত্য চর্চায় নিয়মিত ডুবে থাকতেন। করাচি সেনানিবাসে থেকেও তিনি তৎকালীন সমস্ত বিখ্যাত পত্র-পত্রিকা পাঠ করতেন। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মর্মবাণী, সবুজপত্র, বঙ্গবাণী, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা ও বিজলী’র গ্রাহক ছিলেন। এছাড়া রুশ বিপ্লব সম্পর্কিত নানা পত্র-পত্রিকা তিনি নিজের হাতের কাছে রাখতেন সব সময়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত রুশ বিপ্লব নজরুলকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। রুশ বিপ্লব সম্পর্কে যাবতীয় পত্র-পত্রিকা নজরুল অত্যন্ত খুঁটিয়ে পড়তেন। জাতীয়তাবাদী পত্র-পত্রিকাতেও রুশ বিপ্লব সম্পর্কে অনেক খবরাখবর প্রকাশিত হতো। যদিও এদেশে তখনো অবধি কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠেনি। ঠিক এ রকম একটা পরিস্থিতিতে সেনা বিভাগের কঠিন কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ থেকেও ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন ভারতের একজন হাবিলদার হয়ে কীভাবে রুশ বিপ্লব সম্পর্কে এতটা আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন তা থেকেই কাজী নজরুলের স্বদেশচেতনা এবং বিপ্লবী মানসিকতার প্রকৃত ছবিটি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

যাইহোক, সৈনিক থাকা অবস্থায় নজরুলের সাহিত্য-জীবনের উন্মেষ ঘটে। করাচি থেকেই তিনি নিয়মিত কলকাতার পত্র-পত্রিকাতে বিস্তর লেখা পাঠাতে থাকেন। তাঁর বেশ কয়েকটি লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে ছাপা হতেই বাঙালি পাঠক মহলে এই নতুন অসামান্য প্রতিরোধের বাঙালি কবির একটি স্বতন্ত্র জায়গা নির্দিষ্ট হয়ে গেল। এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই কাজী নজরুলই প্রথম সৈনিক কবি। নজরুলের ‘মুক্তি’ শীর্ষক কবিতাটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় ছাপা হয়। যতদূর জানা যায়, এটিই ছিল পত্রিকায় ছাপানো তাঁর প্রথম কবিতা। এরপর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মে-জুন সংখ্যায় মাসিক ‘সওগাত’ প্রথমবর্ষ সপ্তম সংখ্যায় নজরুলের একটি গল্প ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ প্রকাশিত হয়। গল্প হলেও লেখাটি অনেকটা আত্মস্মৃতিমূলক। ‘মুক্তি’ কবিতাটি প্রকাশের পর নজরুলের সাহিত্য-সৃষ্টিতে যেন বাণ ডাকতে শুরু করে। একটার পর একটা গল্প, কবিতা, উপন্যাস তিনি লিখতে শুরু করেন। লিখলেন, ‘ব্যথার দান’ গল্প, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় প্রকাশিত হলো। প্রকাশ হলো ‘হেনা’ গল্পটি। ‘ব্যথার দান’ গল্পে রুশ বিপ্লব সম্পর্কে কবি নজরুলের চিন্তা-ভাবনা কোন স্তরে ছিল তার বিবরণ পাওয়া গেল। শুধু দেশপ্রেম নয়, নজরুল ইসলামের এই গল্পের ভিতর দিয়ে আন্তর্জাতিকতাও ফুটে উঠেছে। যা আমাদের বাংলা সাহিত্যের নতুন দিক বলতে হবে। ‘রিক্তের বেদন’ গল্পটিও নজরুল ইসলাম করাচি সেনানিবাসে বসে লেখেন।

কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কাব্য, গল্প, উপন্যাসঃ

কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গুলো হলে-অগ্নিবীণা,বিষের বাঁশ, ছায়ানট,প্রলয়শিখা,চক্রবাক,সিন্ধুহিন্দোল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

গল্প ও উপন্যাস সমূহ হলোঃব্যথার দান,রিক্তের বেদন,শিউলিমালা,মৃত্যুক্ষুধা,কুহেলিকা, আলেয়া,পুতুলের বিয়ে,ঝিলিমিলি।

কাজী নজরুলইসলামের নাগরিকত্ব প্রদান ও মৃত্যুঃ

মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কবি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন।বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং পরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।তাকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি মর্যাদায় ভূষিত করা হয়।

২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সালে কবি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মসজিদ সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তাঁকে পরিপূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

0
$ 0.00
Avatar for Mumu
Written by
3 years ago

Comments