অনুর ঘুম ভাঙল সকাল ৮টায়। কড়কড়ে ঠাণ্ডা। কম্বলটা শরীরের উপর থেকে সরিয়ে চাদর টেনে নিলো। এরপর নামল বিছানা থেকে। জানালাটা খুলে দিলো; কিন্তু ঠাণ্ডা হাওয়া শরীর নিতে পারল না নলে আবার দ্রুত আটকে দিলো জানালা। শুভ্র ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে। এত শীতেও গোসল করেছে ছেলেটা।
শুকনো তোয়ালে দিয়ে মাথাটা মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শুভ্র। আয়নাতে অনুর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে। শুভ্র সেদিকে তাকিয়ে বলল, "টেবিলের উপর একটা কার্ড দেখলাম, ওটা কার?"
অনু প্রথমে ভুরু কুঁচকে টেবিলের দিলে তাকালো। টেবিলের উপরে তাকিয়ে কার্ডটা দেখতেই কুঁচকানো কপাল মিলিয়ে গেল। চাদরটা আরও ভালোভাবে শরীরে জড়িয়ে নিয়ে বলল, "ওটা বাবা দিয়েছে। লোকটা নাকি বিশাল বড় অফিসার।"
শুভ্র পিছনে ঘুরে বোনের দিকে সরু চোখ রেখে বলল, "কার্ডটা বাবা কোথায় পেলো? বাবা তো অনেকদিন ধরে এই ধরনের মানুষদের থেকে দূরে আছে।"
অনু নিঃশব্দে হাসল। বলল, "বাবা কি আর আগের মতো আছে? তাঁর মধ্যে এখন বিশাল পরিবর্তন এসেছে।"
"তা যা বলেছ।" মাথা দুলিয়ে তাল মেলালো শুভ্র৷ আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে বলল, "কাল রাতে কথা বলতে গিয়ে আমি তো ভীমড়ি খেয়েছিলাম। কথাবার্তায় খুব পরিবর্তন এসেছে। আর খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে। মনে হচ্ছে আবার বিজনেস শুরু করবে। জমি বোধহয় বেশ ভালো দামে বিক্রি হয়েছে।" শেষের কথাটা একটু ফিসফিস করে বলল শুভ্র। সে-ও ইতোমধ্যে জেনেছে, বাবা জমি বিক্রির জন্যই কিছুদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়েছিল।
শুভ্রর কথার প্রতিউত্তরে কিছুক্ষণ নীরবে ভাবল অনু। এরপর ভাবনাটা ঝেড়ে ফেলে দিলো। দাঁড়িয়ে অন্য আরেকটা তোয়ালে বের করে শুভ্রর উদ্দেশ্যে বলল, "ভাবছি কার্ডের এই অফিসের ঠিকানায় একবার যাব। আমার চাকরি খুব দরকার।"
শুভ্র আবার পিছনে ঘুরে বলল, "তুমি তো আজকাল খবরের কাগজ পড়ো। ওখানে তো অনেক চাকরির বিজ্ঞাপন থাকে।"
"আমি কয়েক জায়গায় সিভি জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তাছাড়া আমার রেজাল্টও অত ভালো না৷ মাস্টার্স শেষ করতে পারলে তবুও কথা ছিল।"
"আগে পারোনি তো কী হয়েছে? এবার পারবে।"
"এই বয়সে?" অনু ঠাট্টার ভঙ্গিতে হাসতে শুরু করল।
শুভ্র সিরিয়াস ভাবে বলল, "এই বয়সে মানে কি? তুমি কি বুড়ি হয়ে গেছে? মাঝে তো দু'টো বছর গ্যাপ গেছে শুধু।"
হাস্যরতভাবে অনু বলল, "এখন আবার ফাস্ট ইয়ার থেকে শুরু করতে হবে। আসলে দোষটা আমারই। পড়াশোনা নিয়ে কখনোই অত সিরিয়াস ছিলাম না। ভেবেছিলাম বিয়েসাদী করে সংসার করব, অত ফাস্টক্লাস রেজাল্ট দিয়ে কী করব।"
শুভ্র হেসে বলল, "হু, বিয়ে করেছ তো।"
"হু, করেছি। কিন্তু টিকলো কই? তাছাড়া যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম, জীবন তো সেভাবে পরিচালিত হয়নি। সব এলোমেলো হয়ে গেছে। এরজন্য অবশ্য আরও অনেকেই দায়ী।" অনুর গলার স্বর গম্ভীর হয়ে এলো সহসা। প্রায় নিভে যাওয়া আলোর মতো টিপটিপ করতে লাগল। চোখের কোণা ভিজে এলো সামান্য।
শুভ্র কিছুটা সময় নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল, "বাবা বলছিল তোমার বিয়ের কথা। বলছিল তোমাকে ভালো একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলে তিনি স্বস্তি পাবেন।"
"মানে?" অনু জ্বলে উঠল হঠাৎ। যেন টিপটিপ করে জ্বলতে থাকা আগুনে হঠাৎ কেরোসিন ঢালা হয়েছে।
শুভ্র হকচকিয়ে উঠল বোনের গলার আওয়াজ শুনে। ইতস্ততভাবে বলল, "না মানে, বাবা বলছিল আরকি। ওই যে কাল রাতে বাবার ঘরে গেলাম, তখন বলছিল।"
অনু জবাব দিলো না। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ, এরপর ফুঁসতে ফুঁসতে তোয়ালে হাতে ওয়াশরুমে চলে গেল।
শুভ্র হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। বোন ওয়াশরুম থেকে বেরুনোর আগেই সে চট করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল।
৯টার দিকে খাওয়াদাওয়া শেষ করল অনু। বাড়িতে এখন বৃষ্টি আর মমতাজ বেগম ছাড়া কেউ নেই। শুভ্র ইউনিভার্সিটিতে চলে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। বাঁধনও অনেক সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। আর আজ খুব সকালেই বিশেষ কাজের কথা বলে বেরিয়ে গেছেন নুরুল ইসলাম। দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সুযোগ স্ত্রীকে দেননি তিনি।
অনু গেইট দিয়ে বের হওয়ার আগেই দারোয়ানের মুখোমুখি হলো। দারোয়ান তাকে দেখেই খবরের কাগজ এগিয়ে দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললেন, "আপা, আপনার কাগজ।"
কাগজটা হাতে নিলো অনু। তাঁর খবরের কাগজটা উপরে যায় না। এখানেই দারোয়ানের কাছে জমা থাকে। সে সকালে বেরুনোর সময় কাগজ নিয়ে যায়, এরপর বাসে বসে বসে মামুনের নতুন লেখা পড়ে।
আজও মামুনের একটা লেখা বেরিয়েছে। সাথে সুন্দর একটা রঙিন ছবি। সরু গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে মামুনের ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল অনু। জীবনটা ভারি অদ্ভুত। একদিন হঠাৎ করে দেখা হয়েছিল এক রিকশাচালক এর সাথে। এরপর পরিচয়। মানুষটা তাকে ঘিরে রেখেছে। নিজের বিপদে মানুষটাকে পাশে পেয়েছে সবসময়। এমন ভালো মানুষ আজকাল দেখা যায় না।
"আরে অনু, কেমন আছো?"
কাগজের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল অনু। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল। এমন সময় দ্বিতীয় ব্যক্তির কথাটা কানে এলো। কিছুটা চমকিত হয়ে সামনে তাকালো অনু। মাঝবয়সী এক মহিলা বাজারের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। মহিলাটি তাঁদের বিল্ডিংয়ের দু'তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকে। আগে বেশ ক'বার দেখা হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই এখানে থাকায় আলাপ বেশ অনেকদিনের।
নিজেকে সামলে নিয়ে অনু কোমল স্বরে বলল, "আমি ভালো আছি, আন্টি। আপনি কেমন আছেন?"
মহিলা হালকা হেসে বললেন, "আছি ভালোই। তা কোথায় যাচ্ছো?"
মহিলার হাসিতে যে কতটা উপহাস আছে, তা অনুমান করতে পারছে অনু। তিনি ঠিক কোন কারণে এইসময় খাতির জমাতে এসেছেন, তা-ও অজানা নয়। অনু তবুও নিজেকে শান্ত রেখে জবাব দিলো, "ঢাকা যাচ্ছি।"
অনুর কথা শুনে মহিলার মুখের হাসি প্রশস্ত হলো। তিনি তিরস্কারের স্বরে বললেন, "শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছ নাকি? কিন্তু আমি তো শুনেছিলাম তোমাদের ডিভোর্স হয়েছে।"
অনু মুখ শক্ত করে বলল, "আপনি ঠিক শুনেছেন।"
"ওহ্ হো!" ভারি দুঃখী প্রতিক্রিয়া দেখালেন মহিলা। নিচের দিকে তাকিয়ে খানিকটা বিষণ্ণ গলায় জানতে চাইলেন, "তা ডিভোর্সটা হলো কেন?"
অনু ম্লানস্বরে বলল, "ডিভোর্সের কারণ জানার জন্য দাঁড় করিয়েছেন, নাকি কোথায় যাচ্ছি সেটা জানার জন্য দাঁড় করিয়েছেন?"
অনুর জবাবে অসন্তুষ্ট হলেন মহিলা। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি রুক্ষ গলায় বললেন, "বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটা ভুলে গেছ নাকি? এখন বুঝতে পারছি কেন ডিভোর্স হয়েছে। নিশ্চয়ই তোমার এই বেয়াদবি শ্বশুর বাড়ির কেউ মেনে নিতে পারেনি।"
অনু বিস্ময়পূর্ণ কণ্ঠে বলল, "আমি আপনার সাথে বেয়াদবি করলাম কখন?"
"অবশ্যই করেছ।" মহিলার কণ্ঠস্বর অত্যন্ত দৃঢ়। তিনি চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন, "যা জিজ্ঞেস করেছি, তা না বলে কথা পেঁচাচ্ছ কেন? তোমাদের মতো মেয়েদের বিয়ে কেন টেনে না, তা আমাদের জানা আছে। নিশ্চয়ই আরও কোথাও তোমার সম্পর্ক আছে।"
অনুর মেজাজ চটে গেল এবার। সে মহিলার দিকে ভয়ঙ্কর চোখ করে তাকিয়ে বলল, "ঠিক ভাবে কথা বলুন আন্টি। আমি আপনার মেয়ের বয়সী।"
মহিলা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, "আমার এমন মেয়ে থাকলে কবেই গলা টিপে মেরে দিতাম।"
অনু নাক-মুখ কুঁচকে তিক্ত গলায় বলল, "কাউকে মারার জন্য আপনার কথাই যথেষ্ট। আমারই তো কেমন যেন লাগছে এখন।"
অনুর কথা কিছুতেই হজম করতে পারলেন না মহিলা। তিনি উত্তপ্ত গলায় চেঁচাতে শুরু করলেন, "তোমার এতবড় সাহস। মায়ের বয়সী একটা মানুষের সাথে এভাবে কথা বলছ তুমি। বাড়িতে যে একদমই শিক্ষা দেয়নি, তা তো বুঝতেই পারছি। আর শিক্ষা দিবেই না কে? ছোট থেকেই তো সৎ মায়ের বাড়িতে আছো। ভদ্রতা বলে তো কিছু নেই। ছি:! আবার বড় বড় কথা। কে জানে কার সাথে কী অপকর্মে জড়িয়েছিলে, আর সেটা জানতে পেরে স্বামী ডিভোর্স দিয়েছে। সবকিছু জানা আছে আমার। বয়স তো এমনি এমনি হয়নি। আমরা জানি, ঠিক কোন কারণে ছাড়াছাড়ি হয়।" একনাগাড়ে কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালেন না মহিলা। রেগেমেগে চলে গেলেন সামনে থেকে।
অনু হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আশেপাশের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। এতক্ষণ তামাশা দেখেছে সবাই। তামাশা শেষ হয়নি ভেবে এখনো দাঁড়িয়ে আছে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তাকে। অনুও আর দাঁড়াল না। মুখ কালো করে হাঁটতে লাগল। সাভার স্ট্যাণ্ডে গিয়ে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
অনু অবাক দৃষ্টিতে দেখল সামনের ভবনটা। বেশ বড়। উপরে কোম্পানির নাম লেখা। গেইটের দারোয়ানের কাছে গিয়ে কার্ডটা দেখাতেই সে বলল, একটু অপেক্ষা করতে। বাইরে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করল অনু। প্রায় ১০ মিনিট পর স্যুট-প্যান্ট পরা একটা লোক এসে দাঁড়ালো অনুর সামনে। গায়ের রং ফরসা। গালভরতি ছোটছোট ঘন দাড়ি। দেহের গড়ন বেশ ভালো। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তিনি। সামনে দাঁড়িয়ে পলকহীন ভাবে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল অনুর দিকে। অনু একটু অপ্রস্তুত হয়ে কাশতেই লোকটা বিব্রত কণ্ঠে বলে উঠল, "আপনিই অনু?"
অনু কিছুটা সময় নীরব থেকে লোকটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালোভাবে চোখ বুলালো একবার। বয়স অনুমান করা মুশকিল। মুখের চামড়া বেশ টানটান। দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম। খুব বেশি লম্বা না হলেও অনুর থেকে উচ্চতায় বড়। জবাবে অনু বলল, "অহনা।"
লোকটা হাসল মৃদু আওয়াজ করে। হেসে বলল, "সবাই তো অনু বলেই ডাকে, তাই না?"
ভুরু নাচিয়ে অনু 'হ্যাঁ' সূচক মাথা ঝাঁকালো।
লোকটা আবার বলল, "আমার নাম অর্ক। এই কোম্পানিতে ছোট্ট একটা চাকরি করি।"
অনু অবাক হয়ে বলল, "বাবা বলেছিল আপনি মস্তবড় অফিসার।"
আবারও মৃদু আওয়াজ করে হাসল অর্ক। সামনের দিকে ধীর গতিতে পা বাড়িয়ে বলল, "ওই আরকি। আসুন আপনি।"
অনু কথা বলল না আর। সেও অর্ক'র পাশ দিয়ে ধীর গতিতে হাঁটতে লাগল। গেইট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে লিফটে উঠল।
অর্ক অনুর দিকে তাকিয়ে ওকে দেখল আরেকবার। খুব সাধারণ সাজে এসেছে মেয়েটা। অথচ দেখতে কী অসাধারণ লাগছে! বিমুগ্ধ হয়ে অনুকে দেখতেই গন্তব্যে এসে গেল ওরা। দু'জনে আবার হাঁটতে শুরু করল। মৃদুস্বরে অর্ক বলল, "আচ্ছা, আপনার ডিভোর্স হয়েছে কতদিন হলো?"
অনু থমকে গেল কথাটা শুনে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে খানিক শুকনো গলায় বলল, "কী আজব!"
অর্ক ইতস্তত বোধ করল কিছুটা। সচারাচর এমনটা
খুব সুন্দর হয়েছে গল্পটা, অনেক অনেক ধন্যবাদ