দু দশকের শত্রুতা,প্রতিহিংসা আর অন্ধকার জগতের ক্ষমতার অলিন্দে টিকে থাকার লড়াই এর গল্প মির্জাপুর।রাজনৈতিক নেতা আর মাফিয়া ডনের অবৈধ আঁতাত,,,সৎ মানুষের সৎ ভাবে বেঁচে থাকার অক্ষমতা এবং সবশেষে অপরাধের অন্ধকারময় গলিতে হারিয়ে যাওয়ার কাহিনী মির্জাপুর।পাশাপাশি প্রেম,অবাধ যৌনাচার,ব্যাভীচারিতা আর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও বিশ্বস্ততার গল্প মির্জাপুর। ভারতীয় ওয়েব সিরিজের দুনিয়ায় যত ডার্ক সিরিজ আছে তার মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল নাম এই মির্জাপুর।
প্রায় দু'বছর আগে যে সিরিজটি রিলিজ করেছিল ও বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল,,,তার গল্প নিয়ে বেশি কিছু বলাই বাতুলতা।অল্প দু-চার কথায় বলতে গেলে উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর আর জৌনপুরের দুই যুযুধান মাফিয়া ডন পরিবারের ক্ষমতা দখলের গল্প বলে এই সিরিজ।যার সাথে জড়িয়ে পড়ে একদম ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা দুই ভাই,,,গুড্ডু আর বাবলু।তারপর তাদের তৃতীয় শক্তি হিসাবে উত্থানের কাহিনীই প্রাধান্য পেয়েছে প্রথম সিজনে।
এক্সেল এন্টারটেইনমেন্ট প্রযোজিত এই চরম উত্তেজনাপূর্ন ওয়েব সিরিজ আমার মতে তাদের প্রডাকশনের অনেক ফিচার ফিল্মকেও ছাপিয়ে যাবে মেকিং এর উৎকর্ষে,,,অভিনেতাদের চরিত্রানুগ স্বাভাবিক অভিনয়ে এবং অবশ্যই এর হিংস্রতায়!!দুর্ধর্ষ গতিময় চিত্রনাট্য পাশাপাশি প্রতিটি চরিত্রকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে proper character development এই সিরিজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।অজস্র চরিত্র থাকা সত্ত্বেও লেখকের কারিগরীর জন্য কাউকেই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়না।প্রতিটি সাব প্লট ও দারুণ ভাবে মূল প্লটের সাথে mixed করেছেন পরিচালক করণ অংশুমান এবং গুরমিত সিং।ওয়েব কন্টেন্টের উপর সেন্সর বোর্ডের চোখ রাঙানির অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বীভৎসতার চরম সীমায় পৌঁছে যায় অ্যাকশন ও মার্ডার সিনগুলি।রক্ত,মাংস,ঘিলু,নাড়িভুঁড়ি একাকার করে সে যেন এক নারকীয় উৎসব।বিশেষ করে কম্পাউন্ডারের ক্ষুর দিয়ে গলা কাটার দৃশ্যগুলি দেখলে গা ঘিনঘিন করে!
অভিনয়ের কথা বলতে গেলে প্রথমে এটাই বলতে হয় যে মুখ্য চরিত্র থেকে আরম্ভ করে একদম অকিঞ্চিকর ছোট্ট চরিত্র পর্যন্ত সবাই মারাত্মকরকম স্বাভাবিক ও সু-অভিনয় করেছেন।চোখের সামনে পর্দায় যেন আসল অপরাধ জগতের পাত্র-পাত্রীদের দেখতে পেয়েছি আমরা,,তাঁদের দৌলতে।একমেবাদ্বিতীয়ম অবশ্যই "কালিন" ভাইয়া অখন্ডানন্দ ত্রিপাঠীর চরিত্রে পঙ্কজ ত্রিপাঠী।এটা ওনার অন্যতম কেরিয়ার বেস্ট পারফরম্যান্স আমার মতে।মাফিয়া ডন বলতে যা বুঝি সেই প্রথাগত ধারণা ছাপিয়ে অন্য খাতে বয়ে গেছে তাঁর অভিনয় নদী!ধুরন্ধর বুদ্ধিমান,শঠ ব্যাক্তিত্বের পাশাপাশি কালিন ভাইয়ের মানবিক মুখ ও সাফল্যের সাথে তুলে ধরেছেন পঙ্কজ জী।তাই পর্দায় কখনো কালিন ভাই কে দেখে যেমন ভয় লাগে ঠিক সেইরকম মাঝেমধ্যে ভালবাসতেও ইচ্ছা করে তাঁর কিছু কিছু ন্যায়নিষ্ঠ আচরণের জন্য।দ্বিতীয় সেরা অভিনয় অবশ্যই কালিন ভাইয়ের ছেলে মুন্না ত্রিপাঠীর চরিত্রাভিনেতা দিব্যেন্দু শর্মা।যথেষ্ট সুদর্শন দিব্যেন্দু যে অনায়াস দক্ষতায় এরকম একটা নেগেটিভ রোল উতরে দেবেন,,সত্যিই বোঝা যায়নি।এই সিরিজের অন্যতম প্রাপ্তি দিব্যেন্দু'র অভিনয়।আদতে অপদার্থ কিন্তু রগচটা,সেক্স ম্যানিয়াক,নেশাখোর ডন পুত্রের ভূমিকায় দিব্যেন্দু'র অভিনয় একইসাথে বিশ্বাসযোগ্য ও একপ্রকার visual treat..।থ্রি ইডিয়টস ফিল্মের জয় লোবোকে মনে আছে?স্বপ্নালু চোখের সেই উঠতি ইঞ্জিনিয়ার যে দুম করেই চাপ সামলাতে না পেরে হোস্টেলের দেওয়ালে "I Quit" লিখে রেখে আত্মঘাতী হয়েছিল!সেই নরম সরম ছেলে অর্থাৎ ভূমিকাভিনেতা আলি ফজল যে গুড্ডু পন্ডিতের মত এইরকম একটা rough & tough রোলে মানিয়ে যাবেন ও অসাধারণ কাজ করবেন,,,কে ভাবতে পেরেছিল??জড় বুদ্ধি কিন্তু বনমানুষের মত শারীরিক ক্ষমতাশালী দেশীয় হাল্ক রূপী আলি গুড্ডুর রোলে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন।খই এর মত মুখে ফুটতে থাকা কাঁচা খিস্তিখেউড়ই হোক,,কিংবা পরিবারকে বাঁচাতে আর মধ্যবিত্ত সীমাবদ্ধতার বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য ক্রাইমের দুনিয়ায় প্রবেশ করা অথবা লাজুক প্রেমিক সব সিচুয়েশনেই আলির অভিনয় প্রশংসনীয়!ছোট ভাই বাবলু'র রোলে বিক্রান্ত মাসে একটা বিপ্লব!এমনিতেই বিক্রান্ত মাসে একজন দারুণ অভিনেতা।এখানে কিন্তু ওনার কমফর্ট জোনের বাইরে বেরিয়ে এসে গুড বয় থেকে ব্যাড বয়ে উত্তরণের জার্নিটি অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বিক্রান্ত।মহিলা সবক'টি চরিত্রে সবাইই যথাযথ কিন্তু আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য নাম রাসিকা দুগ্গাল!কালিন ভাই এর seductive wife এর রোলটা সম্ভবত ইনি ছাড়া আর কেউ এত ভাল ভাবে করতে পারতেন না!প্রায় সবার কথাই বললাম,,,কিন্তু শেষে একজনের কথা না বললে অন্যায় হবে যে!তিনি আমাদের অতিপ্রিয় "হাথোড়া ত্যাগী"!না,,,এই সিরিজ যখন রিলিজ করে তখনও তিনি হাথোড়া ত্যাগী হন নি।বলছি অভিষেক ব্যানার্জীর কথা।হাথোড়া'র চেয়েও অনেক বেশি স্ক্রিনটাইম ছিল তাঁর এই কম্পাউন্ডারের ভূমিকায়।নৃশংসতাও কম দেখাননি তিনি এখানেও।কিন্তু হাথোড়া'র পাস্ট লাইফের জন্য যতটা আমরা তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছি,,,এখানে কম্পাউন্ডার কে ঠিক ততটাই ঘেন্না করেছি আমরা।অনায়াসে নিরীহ মানুষের গলা কেটে ফেলা লোকটা যখন শেষমেশ নিজের প্রিয় বসের হাতেই গলা কেটে মারা গেল,,ঠিক তার আগের মুহুর্তের অভিষেকের এক্সপ্রেশনটা খালি দেখবেন!!তিনি যে জাত অভিনেতা,,তা ওই একটা দৃশ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছেন "হাথোড়া ত্যাগী" থুড়ি "কম্পাউন্ডার"!
নেটফ্লিক্সের স্যাক্রেড গেমসের পাল্টা বলা হচ্ছিল মির্জাপুর'কে।দুটি সিরিজের মধ্যে আমার ব্যাক্তিগত প্রিয় মির্জাপুর।কারণ এর সরল সাদাসিধা ন্যারেটিভ।অনেক চরিত্র দুটি সিরিজেই,,প্রচুর সাব প্লট দুটি সিরিজেই!কিন্তু মির্জাপুরের পরিচালক অকারণ জটিলতার আশ্রয় নেন নি!এবারে সত্যিই কি স্যাক্রেড গেমস কে ছাপিয়ে যেতে পারবে মির্জাপুর??সেই উত্তর পাওয়া যাবে ২৩শে অক্টোবর।সিজন ২ যেদিন রিলিজ হবে