(মানব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে একটু বিজ্ঞানময় বিশ্লেষণ মিশিয়ে লেখা একটি সামান্য প্রতিবেদন)
এক সময়ে লেখাটি বাংলাদেশের অসংখ্য সহযোদ্ধা মানে এই অন্তর্জালের ব্লগার হিসেবে এক অসম লড়াইয়ে প্রাণ হারানো মানুষদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে লিখেছিলাম , আবার এই লেখাটি পাঠকের দরবারে তুলে ধরলাম। ভালো লাগলে খুশি হবো।
শুরুতেই একটা কথা বলে রাখি, আমার এই লেখা কোনো ধর্মকে ব্যঙ্গ করার জন্য না স্রেফ আমাদের ধর্মীয় কাজকর্মের উপর এবং ইশ্বরের খোজ কে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা। আমাদের এতো বছরের লালিত কিছু চিন্তা বা আচরণের উপর আলোচনা। কোনো অনুভূতি প্রবল হলে অনুরোধ করছি এই লেখা এড়িয়ে যান। আর দ্বিমত থাকলে নিজের যুক্তি তুলে ধরুন,আমি আপনাকে স্বাগত জানাবো। অকারণে গালাগাল করলে একই রাস্তায় অভ্যর্থনা করবো।
যাই হোক,শুরু করছি ধর্মীয় একটি উপাখ্যান দিয়ে ,সাউল বলে একটি লোক ৩৬ ক্রিস্টাব্দে শুনতে পায় যীশু বলে এক কথিত মাসিহা বা ঈশ্বরের পুত্র বলে খ্যাত কোনো লোকের শিষ্য ইত্যাদি বাড়ছে। তাদের কতল করার জন্য সে সেই সময়ের সিরিয়ার দিকে রওনা দেয়। পথমধ্যে একটি জায়গায় এই সাউল এর এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। তিনি তার চারপাশে এক আলোর বিচ্ছুরণ অনুভব করেন। এরপরেই তিনি মাটিতে পড়ে যান এবং এই অবস্থায় একটি ঐশ্বরিক কণ্ঠের আদেশ পান (যীশুর কন্ঠ বলে কথিত ) তার যাত্রা অব্যাহত রাখতে। এরপরেই সাউল তিনদিন দৃষ্টিহীন হয়ে যান। এই অবস্থা থেকে স্বাভাবিক হন যখন এনানিয়াস বলে এক যীশুর অনুসারী তার হাত না ধরে। এরপরে সাউল যীশুর স্মরণ নিয়ে নেন অর্থাৎ ক্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে এই সাউল বিখ্যাত হন সেন্ট পল নামে। ক্রিস্টধর্ম প্রচার এর কারণে এই সন্ত বেশ বিখ্যাত।
এই কাহিনী ধার্মিকের কাছেই শুধু আকর্ষণীয় না বিজ্ঞানী মানে স্নায়ুতন্ত্রের উপর বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ নিউরো সায়েন্টিস্টদের কাছেও বেশ আগ্রহের বিষয়। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা এই ঘটনা মিলিয়েছেন টেম্পোরাল লোব বলে আমাদের মস্তিষ্কের এক অংশের উপর প্রভাব সৃষ্টি করা এক ধরনের মৃগীর সাথে। ঠিক এই ধরণের লক্ষণ মানে আলোর ঝলক , সাময়িক অন্ধত্ব ,কোনো মানুষের কন্ঠের অনুভব সবই কিন্তু তাদের পর্যবেক্ষন করা রোগীর মধ্যে পাওয়া গিয়েছে। এর উপর আরো বিস্তৃত জানতে এই লিংকে একটু খোঁচা দিন। প্রসঙ্গত মোজেস মানে সেই মুসা থেকে আরো অনেক ধর্মীয় পুরুষের উপর একই লক্ষণের সমন্ধে জানতে পারবেন। http://www.bbc.co.uk/science/horizon/2003/godonbrain.shtml
বিজ্ঞান আবার কোনো কিছু আধাআধি রেখে যায় না লেগে থাকে যতক্ষন না এর উপর কোনো যুক্তিগ্রাহ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পায়। এই জন্য গঠিত হয়েছে নিউরোথিওলজি। এই বিভাগের গঠনের মূল উদ্দেশ্য ধর্মীয় কাজকর্মের সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের যোগ নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া। যদিও এর কাজকর্ম অনেক ধার্মিকের রোষের কারণ হয়েছে,তাদের ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ কে মানব মস্তিষ্কের সাথে যোগ করে এর গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়ার জন্য দোষী করেছে। অবশ্য তাতে বিজ্ঞান তার কাজ বন্ধ করেনি। আমাদের প্রার্থনা /ইবাদত /ধ্যান ইত্যাদির সাথে মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থের যোগাযোগ আরো প্রকট হচ্ছে এই কাজগুলোর জন্য।আমাদের নির্দিষ্ট ধর্মীয় দিন /তিথি বা সময়ের জন্য কি আমাদের মস্তিস্ক দায়ী ? আসুন জানি এর উপরে।
উপরে সন্ত পল এর ঘটনা বা ঐধরণের বিষয়ের সাথে মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব অংশেরই যোগ আছে এই ধারণা থাকলেও পরবর্তীতে অত্যাধুনিক স্ক্যানিং ব্যবস্থা আর বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রমান করছে এই প্রার্থনা ইত্যাদির সময়ে শুধু ওই অংশই না,মস্তিষ্কের আরো অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ডক্টর এন্ড্রু নিউবার্গ,বিশেষজ্ঞ -পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় একটি ইমেজিং প্রক্রিয়ার মাধ্যেম এই বিষয়ে অনেক তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। একটি বিশেষ প্রতিচ্ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে যার নাম সিঙ্গেল ফোটন এমিশন কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি বা SPECT ,এর উপরে সংক্ষেপে বলা যায়, শরীরের বিবিধ জায়গায় রক্তের প্রবাহ মানে টিস্যু বা অঙ্গে সংবহনের ছবি পাওয়া যায় এই স্ক্যান এর মাধ্যমে (এর উপর জানতে এই লিংক এ গুতো দিন : https://www.mayfieldclinic.com/PE-SPECT.htm )
আরো সহজ করে বলতে গেলে আমরা বলতেই পারি যে অঙ্গের কাজ বেড়ে যাবে ওই অঙ্গে রক্ত সংবহন ও বেড়ে যাবে।নিউবার্গ এক দল তিব্বতি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী স্বেচ্ছাসেবক এর সাহায্য নেন এই নিরীক্ষার জন্য। ওই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তাদের ধ্যানের পর্যায়ে যাওয়ার সময় ইশারা করেন আর ঠিক সেই সময়ে নিউবার্গ একটি বিকিরণশীল পদার্থের (শরীরের ক্ষতিকারক না ) মিশ্রণ ওই সন্ন্যাসীদের শিরায় ইনজেকশন দেন এবং মস্তিষ্কের স্ক্যানিং শুরু করেন। তিনি দেখতে পান,মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব এর কার্যকরণ বেড়ে গিয়েছে ,এই অংশ আমাদের মনসংযোগ এর জন্য কাজ করে। ওই সন্ন্যাসীরা তো ধ্যানের সময় ওই কাজ করছিলেন তাই কোনো অস্বাভাবিক কিছু ছিল না ওটা কিন্তু মজার হলো মস্তিষ্কের পার্শিয়াল লোব এর কাজ অতীব অস্বাভাবিক কমে গিয়েছিল। এই অংশ অন্য কাজ ছাড়া বিশেষ একটি কাজ করে তা হলো আমাদের এই ত্রিমাত্রিক জগতে বিভিন্ন স্থান মানে আপনি আপনার অবস্থানের কাছাকাছি বস্তু বা বিভিন্ন জায়গার দূরত্বের একটা আন্দাজ করেন এর সাহায্যে। আরো সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় আপনি আপনার বসার ঘরে থেকে আপনার রান্নাঘর ,শোয়ার ঘর বা স্নানঘর ইত্যাদির দূরত্ব আন্দাজ করেন এই অংশের সাহায্যে। অর্থাৎ ওই সন্ন্যাসীরা তাদের এই অবস্থানে থাকার সময় গোটা সৃষ্টির সাথে একাত্ব হওয়ার অবস্থায় যাচ্ছেন এই অংশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে। অনেকটা ওই transcendence বা তুরীয় অবস্থায় থাকার যে বর্ননা পেয়ে থাকেন ওই অবস্থার কারন আসলে মস্তিষ্কের ওই অংশ। তিনি এই একই অবস্থা পর্যবেক্ষন করেন একদল খ্রিশ্চান সন্ন্যাসিনী মানে নানদের উপর নিরীক্ষা করে। তাদের অবস্থা ও একই হয়েছিল অর্থাৎ তারা ওই বর্তমান অবস্থার সমন্ধে ভুলে এক অপার্থিব অবস্থায় গিয়েছিলেন একই কারণে।
নিউবার্গ একই পরীক্ষা অন্য একদল Pentecostal Christian গোষ্ঠির খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠীর উপর করেন। এই মানুষগুলো স্বাভাবিক এবং প্রতিনিয়ত চার্চে যান। তারা ধার্মিক এবং অন্য বাকি দিক থেকে সম্পূর্ণ মানসিক ভাবে সুস্থ ব্যক্তি। তাদের উপাসনার এক পর্যায়ে তারা আধ্বাত্বিক ভাবে ঈশ্বরের নৈকট্য উপলব্ধি করেন এবং তাদের মুখ দিয়ে নানান ধর্মীয় বাণী ইত্যাদি বেরোতে থাকে। এদের ক্ষেত্রে উনি দেখেন এক অন্য বিষয় ,এই মানুষগুলোর ক্ষেত্রে ফ্রন্টাল লোব স্বাভাবিক ছিল কিন্তু left caudate বলে মস্তিষ্কের একটি অংশ অতি স্বক্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই পর্যায়ে নিজেরা বলছিলেন তো বটে কিন্তু মস্তিষ্কের কথা বলার সাথে অন্য অংশের সাযুজ্য থাকার কাজ কিন্তু হচ্ছিল না। এর উপর আরো বিস্তারিত জানতে এই সূত্র দেখ
ঈশ্বর দর্শনের যন্ত্র (খুড়োর কল )
কথা হলো,এই ঐশ্বরিক উপলব্ধির জন্য মস্তিষ্কের কোন অংশ দায়ী আর কেন হয় ওটা বোঝার পর একটা প্রশ্ন উঠেছে যে আমরা কি এই ধ্যান /ইবাদত /উপবাস /প্রার্থনা ইত্যাদির মেহনত ছাড়াই এই অভিজ্ঞতার ভাগিদার হতে পারি ? এই কাজে এগিয়ে এসেছেন মাইকেল পারসিঙ্গার ( Michael Persinger ) , উনি একটি বিশেষ যন্ত্র তৈরী করেছেন যা একটা শিরস্ত্রাণ এর ধাঁচের মানে হেডগিয়ার এর মতো। এতে লাগানো আছে ইলেক্ট্রোড বলে কিছু বস্তু যার কাজ মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব এ প্রবাহমান তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গে পরিবর্তন করা। পারসিঙ্গার এর মতে তিনি এর মাধ্যমে যে কোনো মানুষের মধ্যে মস্তিষ্কের কাজ কে প্রভাবিত করে তাকে বিভ্রান্তিকর কোনো অবস্থায় ফেলে দেওয়া। এর ফলে ওই ব্যক্তি ঈশ্বর থেকে দানব যা কিছু একটা অতিপ্রাকৃতিক অনুভব তৈরি করে দিতে পারে। তিনি আরো দাবি করেছেন কোনো মানুষকে এই পরীক্ষার উপর না জানিয়ে ওই শিরস্ত্রাণ পরিয়ে দিলে ৮০% মানুষ বলেছেন তাদের পাশাপাশি কেউ আছে এই ধরনের অনুভূতির কথা।
সবার উপর অবশ্য কাজ করেনি এই খোদা দর্শনের হেলমেট। নাস্তিকতার প্রচারকারি এবং প্রথমসারির মানুষ রিচার্ড ডকিন্স এর উপর এর কোনো বিশেষ প্রভাব হয় নি। তার মতে এই হেলমেট পরে তিনি হালকা মাথা ঘোরা আর পায়ে কিঞ্চিৎ চুলকানির অনুভব পেয়েছেন।
এক্ষেত্রে এই খুড়োর কল নির্মাতা মানে মাইকেল পারসিঙ্গার অবশ্য বলেছেন সবার উপর একই প্রভাব হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এক্ষেত্রে আমাদের জেনেটিকাল গুণাবলী এবং আদি মানবের থেকে চলে আসা বিশেষ বৈশিষ্ট দায়ী। আরো একই পথের বিজ্ঞানীদের মতে আমাদের চারপাশের ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা বা প্রশ্নের উত্তরের জন্য মানুষ অতীন্দ্রিয় কিছুর মধ্যে আশ্রয় খুঁজেছে।
এখন কথা হলো আজকের এই ব্যস্ততার সময়ে ধর্মীয় রীতিনীতি বা কার্যকরণ করার সময় কোথায় মানুষের ? তা হলে কেন উবে যাচ্ছে না এই ধর্মের প্রচলন ? নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী মানুষ বলবে হবেই কিন্তু হয় না কেন ? কেন অনেক প্রবল নাস্তিক মানুষ ও প্রবল বিপদের সম্মুখীন হয়ে প্রচলিত ঈশ্বর (সে যে ধর্মের হোক ) এর কোনো কিছু চিহ্ন বা কিছু ধর্মীয় উচ্চারণ করেন ? এর সমন্ধে বিশেষজ্ঞ বা জ্ঞানীগুণীদের বক্তব্য আমাদের এই কাজের কারন হলো আমাদের বহু হাজার হয়তো বা লাখের উপর বছরের লালিত কিছু ভাবনা। আমাদের মস্তিষ্কে প্রথিত হয়েছে কিছু প্রাচীন ধারণা যে আমাদের থেকে শক্তিশালী কেউ বা অনেক জন আমাদের উপর নজর রাখে। তারা আমাদের রক্ষা করে ,আরো মজার হলো এই বিশ্বাস একটি নীতিমালার অবস্থান নিয়ে আসে যার ফলে বড়ো সংখ্যার মানুষ ঈশ্বর ভীরু হিসেবে অতিরিক্ত মদ্যপান বা অন্য শারীরিক ক্ষতির কারন হয় এইরকম অভ্যাস থেকে দূরে থাকে। এই দূরে থাকার মাধ্যমে ডারউইন এর তত্বের মতে গোষ্ঠীর বাঁচবার রাস্তা তৈরী করে দেয়।
আরো মজার হলো দেখা গেছে ধর্ম নিরপেক্ষ বা ধর্ম উদাসীন গোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন এসেছে অনেক বেশি অথচ ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটা বা পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষণ দেখা গিয়েছে।
শেষ করছি আখ্যান অসমাপ্ত রেখেই তবে একটি কথা বলে, আপনারা অনেকেই একটি সিনেমা দেখেছেন 'যমালয়ে জীবন্ত মানুষ ' ওতে প্রাতঃস্মরণীয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় একটি কথা বলেছিলেন " কোটি কোটি বছরের ভাত ঘুমের অভ্যেস ,সে কি আর এক দিনে যায় ?” অনেক কিছুই যায় যে বলা কোনো কিছু না বলে তাই আশা নিয়েই আছি,একদিন আমরা সংস্কার মুক্ত হবো ,ভয় মুক্ত হবো। অতি শক্তিশালী হবো যাতে আমাদের অতীন্দ্রিয় বা অলৌকিক কিছুর দরকার না হয়। ততদিন পর্যন্ত এই দ্বিধা বা দ্বন্দ্বের দোলাচল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে মানুষ তার চেষ্টা চালিয়ে যাবে ওটাই আমার ধারণা।
লেখার জন্য ব্যবহৃত তথ্যসূত্র,উপরের গুলো ছাড়া