মেডিটেশন

0 27
Avatar for MasudRanaPro
4 years ago

|| মেডিটেশন; সফলতা ও সুখী জীবন অর্জনে আলাদিনের প্রদীপ ||

•মেডিটেশন কি?

শরীর স্বাস্থ্য উন্নতির জন্য আমরা কতকিছুই না করে থাকি, ব্যায়াম, নিয়মিত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি৷ অথচ অনেকেই ভুলে যাই যে, একমাত্র শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতিই জীবনে সুখ বয়ে আনতে পারে না, সেজন্য প্রয়োজন মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নও৷ মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, মেডিটেশন বা ধ্যান। ধ্যান শব্দটা শুনলেই আমাদের মাথায় কিছু চিত্র ভেসে উঠে— বটবৃক্ষের নিচে গেরুয়া পরা কোন সাধু, চোখ বন্ধ করে মাসের পর মাস ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন এমন কেউ কিংবা হিমালয় পর্বতের শিখরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকা, সমাজ-বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন নির্জন গুহায় গিয়ে মাসের পর মাস ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকা কোনো মহামানবের চিত্র৷

অনেকেই ধ্যান বিষয়টিকে অনেকটা ধর্ম, বিশেষ গোত্র, বিশেষ সংস্থা কিংবা কোন বিশেষ ব্যক্তির সাথে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন৷ আবার এক-একজন মেডিটেশনকে শয়তান পূজার চর্চা হিসেবেও ধারণা করে থাকেন৷ অথচ মেডিটেশন এসবের সাথে সম্পর্ক যুক্ত নয়৷ প্রকৃতপক্ষে, মেডিটেশন হিন্দুদের ধ্যান, মুসলিমদের সুফিজম, বৌদ্ধের ধ্যাই কিংবা জিউসদের কাব্বালাহ নামক আধ্যাত্মিকতা চর্চা থেকে শুরু হলেও এখন মেডিটেশনকে অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়— "Meditation is a practice where an individual uses a technique – such as mindfulness, or focusing the mind on a particular object, thought, or activity – to train attention and awareness, and achieve a mentally clear and emotionally calm and stable state"

অর্থাৎ, ধ্যান হলো এমন এক অলখ পদ্ধতি যা ব্যবহার করে মনযোগ বৃদ্ধি কিংবা কোন নির্দিষ্ট বস্তু, চিন্তাধারণা অথবা কাজের প্রতি মনযোগ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায় এবং মানসিক পরিচ্ছন্নতা, ইমোশন নিয়ন্ত্রণ অর্জন করা যায়৷

• মেডিটেশনের কেন করবেন?

১৯৭০ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি মেডিকেল স্কুলের ড. বেনসন নামক একজন গবেষক প্রমাণ করেন যে, মেডিটেশন মানুষের অনিচ্ছাকৃত, অহেতুক চিন্তাধারণকে হ্রাস করে৷

কিভাবে এই কাজ করে এই সম্বন্ধে ধারণা পেতে হলে, ড. সারা লাজার এর মেডিটেশন সম্বন্ধীয় ২০০৭ সালের গবেষনার ফলাফলের দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে—

আমাদের মস্তিষ্ক অনেকগুলো ভাগে বিভক্ত; প্রধান তিনটি ভাগ হলো— ফরব্রেইন, মিডব্রেইন ও হিন্ডব্রেইন৷ মস্তিষ্কের যে অংশগুলো সরাসরি আমাদের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে, মেডিটেশনের মাধ্যমে সেই অংশগুলোকে যথাযথ ব্যবহার শিখানো সম্ভব৷ ড. লাজার এর গবেষনালব্ধ ফলাফলের মতে,

প্রথমত, মেডিটেশন আমাদের মস্তিষ্কের পোস্টেরিও সিনিওলেইট কর্টেক্সের কার্যক্ষমতাকে হ্রাস করে, মস্তিষ্কের এই অংশ ওভার থিংকিং এর জন্য কাজ করে৷ এই ওভার থিংকিং এর ফলে আমাদের ডিপ্রেশন, হতাশার সৃষ্টি হয়৷ কোন কাজ করার আগেই 'পারবো না' ভাবটা এই ওভার থিংকিং এরই কুফল৷ মেডিটেশনের ফলে ওভার থিংকিং হ্রাস পায়৷ চিন্তা-ক্ষমতা আত্ম-নিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠে৷

দ্বিতীয়ত, লেফট হিপোক্যাম্পাস এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে৷ মস্তিষ্কের এই অংশ স্মৃতিধারণ, শিখার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ এই অংশের উন্নতি হলে যে কেউ খুব সহজেই যেকোন কিছুকে শিখতে পারে, যেকোন স্মৃতি দীর্ঘকাল পর্যন্ত ধারণ করতে পারে৷

তৃতীয়ত, অ্যামিগেলা সেল ভলিওমকে হ্রাস করে৷ ব্রেইনের এই অংশ ভয়ভীতি, স্ট্রেস ও অস্বস্থির জন্য দায়ী৷ মেডিটেশনের ফলে, অহেতুক ভয় কমে যায়, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং যেকোন পরিবেশে নিজেকে খাই-খাইয়ের নেয়ার জন্য ব্রেইন তৈরি থাকে৷

এই গবেষণার বাহিরে ২০১৫ সালের অন্য আরেকটা গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মেডিটেশন ডরসেলাটেরাল কর্টেক্সকে উন্নতি করে, এটি মানুষের উইল পাওয়ারকে নিয়ন্ত্রণ করে৷

•কর্মব্যস্ত মানুষ ও ছাত্রদের জন্য মেডিটেশন কেন জরুরি?

কর্মব্যস্ত মানুষ ও ছাত্রদের জন্য মেডিটেশন চমৎকার ফলপ্রদ টনিক হতে পারে৷ সারাদিন কাজকর্ম, পড়ালেখা, খাটাখাটনিসহ নানান শ্বাপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে এসে দিনশেষে অনেকেরই মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়৷ এই খিটখিটে মেজাজ কখনো কখনো ভয়ঙ্কররূপ নেয় যা, যে কাউকেই আশেপাশের মানুষজনের কাছে অপছন্দীয় করে তুলতে পারে৷ নিয়মিত মেডিটেশন করলে এই ধরণের সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে৷ কেননা, মেডিটেশন আমাদের মস্তিষ্কে আলফা ওয়েভের নিঃসরণ বৃদ্ধি করে, যা দুশ্চিন্তা, দুঃখ ও রাগের মতো অনুভূতিগুলো কমিয়ে ফেলে৷

কর্মক্ষেত্রে অনেকেই কাজ করতে করতে মনযোগ হারিয়ে ফেলে, যার ফলে উর্ধতন কর্মকর্তার বকাঝকা শুনতে হয় কিংবা পড়তে বসলে বইয়ের প্রতি মনযোগ থাকে না, যে কোন একটা কাজে স্থির হতে পারে না, মন বিক্ষিপ্তভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করে৷ এমতাবস্থায় মেডিটেশন যেকোন একদিকে মনযোগী হতে সাহায্য করে৷ কারণ, মেডিটেশনের মূলেই রয়েছে গভীর মনোযোগের প্রশিক্ষণ৷ যে কোনো এক বিষয়ের প্রতি পুরো মস্তিষ্ককে ফোকাস করতে শেখানোই মেডিটেশনের উদ্দেশ্য৷ এর ফলে যেকোন একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়৷

•বর্তমান প্রেক্ষাপটে মেডিটেশনের গুরুত্ব কি?

বর্তমান সময়ে প্রায় প্রত্যেক মানুষই কোনো না কোনো নেশা দ্বারা আক্রান্ত৷ কারো মাদকের নেশা, কারো অতিরিক্ত গেইমিং এর নেশা, কারো কারো অতিরিক্ত ফেসবুকিং এর নেশা৷ নেশা যেরকমই হোক না কেনো এটা সবসময়ে ক্ষতি ব্যতিত আর কিছুই বয়ে আনে না৷ নেশা থেকে মুক্তি পেতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে— মেডিটেশন৷ প্রথম দিকেই বলেছিলাম, মেডিটেশন আমাদের ডরসেলেটারাল কর্টেক্সকে প্রভাবিত করে যার ফলে আত্মনিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়৷ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, 'মানুষ অভ্যাসের দাস' প্রবাদকে উল্টে 'অভ্যাস মানুষের দাস' করে ফেলা যায়৷ তাই নয় কি?

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর উইলিয়াম কুইকেন এর মতে, মেডিটেশন অ্যান্টি ডিপ্রেশন রূপে কাজ করে৷ বিষণ্ণ হওয়ার ঝুকি ৩১% পর্যন্ত কমিয়ে দেয়৷ পৃথিবীর সফল বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী, উদ্দোক্তাদের জীবনে বারবার ব্যর্থতা এসেছে, এরপরও কিভাবে এই ডিপ্রেশনকে কাটিয়ে উঠেছেন তাঁরা? খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তাদের প্রায় সবারই মেডিটেশনের অভ্যাস রয়েছে৷ বর্তমান যুগের টিনএজার ও ইয়ং জেনারেশন হাই ডিপ্রেশনে ভুগে৷ অতিক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণেও তারা ডিপ্রেশনে পড়ে যায় এমন সামান্য ঘটনার ফলে নিজের মূল্যবান জীবনকে বলিদান দিতেও দ্বিধাবোধ করে না!

এদের মানসিক উন্নয়ন, আত্মবিশ্বাসবৃদ্ধি, ওভার থিংকিং কমানোর একমাত্র উপায়— মেডিটেশন৷ মেডিটেশনে অভ্যস্ত ব্যক্তি, সহজেই ভেঙে পড়ে না, ব্যর্থতার কাছে কাবু হয় না, কারণ তাদের রয়েছে অফুরন্ত জীবনীশক্তি৷

এছাড়াও মেডিটেশন আমাদের শারিরীক সুস্থতার জন্য কাজ করে৷ যেমন: মেডিটেশন আমাদের দেহে C-Reactive Protein এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে যার ফলে আমাদের হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায়।

যখন আমরা হরহামেশাই বলে থাকি, মনই সব, মানুষের মস্তিষ্ক অসাধারণ, চিন্তাচেতনাই জীবনকে পাল্টে দেয়, তখন আমরা কেনই বা মেডিটেশনের অভ্যাস করবো না!

•কিভাবে মেডিটেশন শুরু করতে হয়?

মেডিটেশন করার জন্য সবচেয়ে প্রথমে জরুরী — নির্জন স্থান৷ যেকোন নির্দিষ্ট একটি নির্জন স্থান বাছাই করে নিতে হবে, যেখানে নিয়মিত, নিশ্চিতে মেডিটেশন করা যাবে৷ সেটা নিজের রুম হতে পারে আবার ফুরফুরে হাওয়ায় বসে করার জন্য ছাদও হতে পারে৷ যেহেতু মেডিটেশনের সময়ে মস্তিষ্ক রি-কোডিংয়ের কাজ চলে সেহেতু পরিবেশ অনেক বড় একটা ম্যাটার, পরিবেশ দ্বারা মস্তিষ্ক প্রভাবিত হবে৷ এছাড়া, নির্জন পরিবেশ ব্যতিত স্থির মনযোগ তৈরি করাও সম্ভব না৷

নির্দিষ্ট সময়ে মেডিটেশন আরেকটি অবশ্য লক্ষণীয় বিষয়৷ মেডিটেশনের জন্য নির্জন পরিবেশের পরেই দরকার সময়ানুবর্তিতা৷ প্রত্যেকদিন একই সময়ে মেডিটেশন করলে তবেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাবে৷ এজন্য এমন সময় নির্ধারণ করা যখন কোন ব্যস্ততা থাকার সম্ভাবনা নেই৷ সেটা ঘুমানোর আগে হতে পারে (ঘুমের সময় নির্দিষ্ট থাকা চাই৷) কিংবা ঘুম থেকে জাগার পরও হতে পারে (নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে জাগা অবশ্য কর্তব্য)

পরিবেশ ও সময় ঠিক হয়ে গেলে মেডিটেশন করার জন্য বাহ্যিক উপদান প্রস্তুত হয়ে গেল৷ মেডিটেশন করতে হলে পদ্মাসনেই বসতে এমন এমন বাধ্যবাধকতা নেই, চেয়ারে বসেও মেডিটেশন করা যায় কিংবা দাঁড়িয়েও কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে শিরদাঁড়া যাতে খাঁড়া ও সোজা থাকে এবং মেডিটেশন আরামদায়ক পদ্ধতিতে হয়৷ সেজন্য আসন পেতে বসাই সবচেয়ে উত্তম৷ শিড়দাঁড়া সোজা করে, গভীর শ্বাস নিতে হবে, পুরো মনোযোগকে শ্বাসের প্রতি নিবিষ্ট করার চেষ্টা করতে হবে৷ ভাবতে হবে আমি শ্বাসের সাথে আমার সকল দুশ্চিন্তা, হতাশাকে মুক্তি দিয়ে দিচ্ছি৷

প্রথমদিকে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা মাথায় এসে ভর করবে, ভুলে যাওয়া কোন কাজ হঠাৎ করে মনে পড়ে যাবে, মনে পড়ে যেতে পারে যে— কাউকে কল দিতে হবে, অমুক কাজটি তো করা হয়নি, আজকে কার কার সাথে এপয়েন্টমেন্ট আছে... এইসব মাংকি থটকে কোনভাবেই পাত্তা না দিয়ে গভীর শ্বাসের প্রতি মনযোগ নিবিষ্ট করতে হবে৷ যেকোন একটা নির্দিষ্ট বাক্য, মন্ত্র উচ্চারণ করা যেতে পারে, এতে মনোযোগ নিবিষ্টকরণে সহায়ক হয়৷ অনেকে আবার মেডিটেশনের অধিক মনোযোগ দিতে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে থাকে, এটাও একটি কার্যকর পদ্ধতি৷ মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলে আমাদের সাব-কনশাস মাইন্ডে মেডিটেশনের প্রতি একটা আলাদা সিরিয়াস ভাব এসে যায়৷

বিগেনারদের জন্য প্রথমেই দীর্ঘসময়ে মেডিটেশন করার চেষ্টা করার প্রয়োজন নেই এতে দুয়েকদিন পর আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়৷ প্রতিদিন পাঁচ মিনিট করে করার পর অভ্যাসে পরিনত হলে এরপর দুই মিনিট করে সময় বাড়িয়ে নেয়া যেতে পারে৷

মনোযোগকে একদিকে নিবিষ্ট করতে রিলাক্সিং মিউজিক শুনে শুনতে মেডিটেশন করা যেতে পারে৷ রিলাক্সিং মিউজিক হলো এমন মিউজিক যেখানে কোন কথা থাকবে না, শুধুমাত্র সফট বাজনা, প্রকৃতির নানান শব্দ৷ এইধরনের মিউজিকের জন্য সহজেই অ্যাপ পাওয়া যায় কিংবা বিভিন্ন সাইটেও পাওয়া যায়৷

মেডিটেশনের বেসিক দিকনির্দেশনা এইটুকুই৷ মনে রাখতে হবে, ধৈর্য্য হারা হওয়া যাবে না, মেডিটেশন এক বৈঠকে সফলতা পাওয়া মতো কিছু না৷ লেগে থাকতে হবে৷ গবেষণা মতে, নিয়মিত সময় মতো মেডিটেশন করলে ৮ সপ্তাহে চমৎকার ফল পাওয়া যায়৷

1
$ 0.00
Avatar for MasudRanaPro
4 years ago

Comments