নাটোর সদরের পশ্চিমে চৌদ্দ কিলোমিটার পরে রাজশাহী জেলার সীমানা ঘেঁষে দস্তানাবাদ গ্রাম। সেখানে গাংধার নামে একটা পাড়া আছে। সে পাড়ায় বাস করতো ফজলু নামের এক দিনমজুর। তিন বছরের ফুটফুটে এক ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে ছোট্ট একটা অভাবি সংসার। দিন কেটে যাচ্ছিল কোনোমতে, তারপর!
ডিসেম্বরে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে অফুরন্ত অবসর। ফেব্রুয়ারীর আগে পুরাপুরি ক্লাস শুরু হয় না। তাই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো। প্রতিদিন বিকেলে বন্ধুদের সাথে রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কে আড্ডা দেই। সন্ধ্যা হলে ইউনিয়ন কাউন্সিলের মাঠে বসে সরকারের দেয়া সাদাকালো ন্যাশনাল টিভি দেখি প্রায় শ'খানেক মানুষ একসাথে বসে।
সেদিন শুক্রবার। যথারীতি বিকেলের আড্ডা চলছে। সবে মাগরিবের আজান দিয়েছে। হঠাৎ এক বন্ধু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলছে, 'এই শুনেছিস! গাংধারের ফজলু তার ছেলেকে খুন করেছে।' সবাই ছুটলাম ফজলুর বাড়ির দিকে। গিয়ে দেখি ফজলুকে দড়ি দিয়ে বারান্দায় খুঁটির সাথে বেঁধে রেখেছে। উঠোনে সাদা কাপড়ে ঢাকা ছোট্ট একটা লাশ।
ঘটনা কীভাবে ঘটলো সে কৌতুহল থেকে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম। যা জানলাম তার সারমর্ম হলো; ক'দিন ধরে ফজলু কোন কাজকর্ম পাচ্ছিল না। ঘরে দানাপানি নেই। আত্মীয়-স্বজনের কাছে ধার-দেনা চেয়েও লাভ হয়নি। দু'দিন হলো চুলায় হাঁড়ি চড়ে না। ক্ষুধার জ্বালায় জান যায় যায় অবস্থা। জুম্মার পর বাড়ি ফিরে বউকে বলেছিল; 'বউ! ছেলেটাকে গোসল দিয়ে জামাকাপড় পরিয়ে দে। ওকে নিয়ে ঘুরতে যাবো।' বউ সরল বিশ্বাসে ছেলেকে গোসল দিয়ে, জামাকাপড় পরিয়ে পাশের বাড়ি গেছে কিছু খাবারের খোঁজে। এই ফাঁকে ফজলু ছেলেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে বারান্দায় শুইয়ে খেজুর গাছ কাটা ধারালো দা দিয়ে উপর্যুপরি কোপ। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে বাবার সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি রক্তে লাল। মুহুর্তের মধ্যে ছেলের দেহ থেকে প্রাণটা বেরিয়ে গেল।
যথারীতি রাতে নাটোর থানা থেকে একদল পুলিশ আসল। এখানে উল্লেখ্য যে, তখন এতো পুলিশ ভ্যান ছিল না। তাছাড়া গ্রামের কাঁচা চিকন রাস্তায় সেগুলো নেয়াও দুঃসাধ্য ছিল। কাউকে ধরতে একান্ত বাধ্য না হলে গাড়ি ভিতরে আসত না। কয়েক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সদর রাস্তায় এসে বাস বা পুলিশের গাড়িতে আসামি উঠানো হত।
মাঘ মাসের প্রচন্ড শীত। রাত দশটার দিকে পুলিশ ফজলুকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করল। আগে হ্যান্ড কাফের গোড়ায় মোটা প্লাস্টিক দিয়ে দড়ি জোড়া লাগানো থাকতো।
চিনিকল এলাকা হওয়ায় নাটোরে একসময় শুধু আঁখের আবাদ হতো। রাস্তার দু'ধারে যতদূর চোখ যায় শুধু ঘন আখের জমি। পুলিশ আগে আগে হ্যান্ড কাফের দড়ি ধরে যাচ্ছে। গায়ে মোটা উলের চাদর জড়িয়ে ফজলু পিছে পিছে হাঁটছে। পুলিশের পিছে ফজলু তার বুদ্ধির কাজ করছে। দু'হাত মুখের কাছে নিয়ে প্লাস্টিকের জোড়া কুটকুট করে কেটে চলেছে। বড় রাস্তায় ওঠার আগেই প্লাস্টিক কাটা শেষ। হঠাৎ পুলিশের হাতে ধরা দড়ি হালকা হয়ে গেল। ঝপাৎ শব্দ শুনেই পুলিশ বুঝে গেল আসামি ভেগেছে ঘন আখ খেতের মাঝ দিয়ে। সাথে সাথে পুলিশ পিছে ধাওয়া করলো। নিজের এলাকা হওয়াতে ফজলু দ্রুত পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। একেতো অন্ধকার রাত তার উপর অচেনা জায়গা তাই পুলিশ দিগ্বিদিক দৌড়াতে লাগল। হ্যান্ডকাফ নিয়ে আসামি হাওয়া। পুলিশের চাকরি যায় যায় ভাব। পরদিন থেকে গ্রামের রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশের টইল শুরু হলো। যাদের হাত থেকে আসামি ছুটে গেছে তারা ফজলুর মা'র হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলো। যাতে উর্ধতন কর্মকর্তার কাছে ছেলের দোষ বলে পুলিশের পক্ষে সাফাই স্বাক্ষী দেয়।
তিনদিন পর ভোরে সারা গ্রাম হৈ হৈ করে উঠলো। ফজলুকে পাওয়া গেছে। আমিও ছুটলাম দেখার জন্য। তার বাড়ির কাছাকাছি যেতেই দেখি ফাঁকা জমির মধ্যে একটা বাবলা গাছের কাছে প্রচুর মানুষের ভীড়। নিকটে গিয়ে দেখলাম; ফজলুর নিথর দেহ গাছের ঠিক নিচে পড়ে আছে। গলায় চিকন পাটের রশি যেটা দেহের ভার সহতে না পেরে ছিঁড়ে গেছে। হ্যান্ডকাফ জোড়া বাবলা গাছের ডালে ঝুলে আছে। কয়েকদিন না খেয়ে থাকায় হাত দুটো সরু হয়ে যায়, ফলে সেগুলো খুলতে অসুবিধা হয়নি। গলায় ফাঁস নেয়ার আগে হ্যান্ডকাফ খুলে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিল। শুনেছিলাম পুলিশের তেমন শাস্তি হয়নি।
অসহনীয় ক্ষুধার জ্বালা একটা মাসুম বাচ্চা আর তার বাবাকে দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় করে দিলো। আত্মহত্যা মহাপাপ অস্বীকার করি না, তবে তারচেয়েও বড় পাপী তারা যারা ফজলুদের সে পাপের পথে ঠেলে দেয়। একমুঠো ভাত হয়তো বাঁচাতে পারতো একটা কচি মুখ আর এক অসহায় বাবাকে।