সময়ের রহস্যময় জগতে
-----------------------------------------------------------
ধরা যাক, আপনারা যমজ দুই ভাই। ১৯৮০ সালের কোন একদিনে আপনারা এই পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখেছিলেন।
সেই হিসেবে এই ২০২০ সালে আপনাদের বয়স ৪০ বছর চলে।
সামনের জন্মদিন উপলক্ষে আপনার যমজ ভাইটি আপনার বাবা মায়ের নিকট এক অদ্ভুত দাবী করে বসল।
সে আগামী জন্মদিনে উচ্চগতিসম্পন্ন একটা রকেট চায় যাতে করে জন্মদিন পালন শেষে আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে মহাশূন্য ভ্রমনে বের হতে পারে।
অনেক পীড়াপীড়ির পর আপনার বাবা মা আপনার ভাইকে এরকম একটি রকেট উপহার দিলেন।
পরিকল্পনামত ৪০ তম জন্মদিন পালন শেষে আপনার ভাই আলোর বেগের শতকারা ৯০ ভাগ বেগ নিয়ে অর্থাৎ সেকেন্ডে এক লক্ষ সাতষট্টি হাজার চারশত মাইল বেগে রওনা হল মহাশূন্য ভ্রমনে।
সাথে নিল একটি নিঃখুত ঘড়ি এবং ক্যালেন্ডার।
সে তার ঘড়ি এবং ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০ বছর মহাশূন্যে কাটিয়ে পৃথিবীতে ফেরত আসল।
তার ঘড়ি এবং ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তার বয়স হবে তখন ৪০+২০ অর্থাৎ ৬০ বছর এবং ফিরে এসে সে তার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রত্যাশা করবে পৃথিবীতে তখন ২০৪০ সাল চলছে (কারণ সে ২০২০ সালে পৃথিবী থেকে রওনা দিয়েছিল এবং তার ক্যালেন্ডার অনুয়ায়ী ২০ বছর মহাশূন্যে কাটিয়ে আসছে)।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল পৃথিবীতে ফিরে এসে সে কী দেখবে জানেন?
দেখবে পৃথিবীর লোকজন তখন ২০৬৬ সাল পালন করছে অর্থাৎ পৃথিবীতে অবস্থিত সকল ঘড়ি এবং ক্যালেন্ডার অনুয়ায়ী পৃথিবীতে তখন ২০৬৬ সাল চলছে। সে দেখবে তার ভাই তার ৮৬ তম জন্মদিন পালন করছে। কিন্তু তার ঘড়ি এবং ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তার ভাইয়ের বয়সও তো তার সমান অর্থাৎ ৬০ বছর হওয়ার কথা ছিল এবং পৃথিবীতে ২০৪০ সাল চলার কথা ছিল।
অর্থাৎ পৃথিবীতে থাকা ঘড়ি এবং ক্যালেন্ডারের সময়ের সাথে তার ঘড়ি এবং ক্যালেন্ডারের সময় মিলছে না, দুইটি ঘড়ি এবং ক্যালেন্ডার ভিন্ন ভিন্ন সময় প্রদর্শন করছে।
আপনি হয়ত ভাবছেন আমি হয়ত গাজাখুরি কোন গল্প বলছি, এ আবার কী করে সম্ভব!
তাহলে কী ক্যালেন্ডার অথবা ঘড়ির যান্ত্রিক ত্রুটির ফলে এরকমটি দেখা গিয়েছে?
এক কথায় এর উত্তর হলঃ না।
ঘড়ি, ক্যালেন্ডার সবই ঠিকই আছে কিন্তু এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে মহাবিশ্বের এক বিরাট রহস্য।
এই রহস্য উন্মোচন করেই আইনস্টাইন বিশ্ববিখ্যাত হয়ে আছেন বিজ্ঞানের ইতিহাসে।
আইনস্টাইন এটিকে ব্যাখ্যা করেছেন "থিউরি অব রিলেটিভিটি" বা "আপেক্ষিক তত্ত্ব" প্রদানের মাধ্যমে।
মূলত উপরের উদাহরণটির অবতারণাই হয় আইনস্টাইনের বিখ্যাত আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রদানের পরে। এই ধরণের অদ্ভুত সিচুয়েশনের কারণে অনেকেই তখন আইনস্টাইনের তত্ত্বকে প্রচণ্ড সন্দেহের চোখে দেখেছিল, এমনকি অনেকেই তখন অবিশ্বাসও করেছিল।
আপাত দৃষ্টিতে উপরোক্ত ঘটনাকে কাল্পনিক, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা বিরোধী এবং অসম্ভব মনে হলেও এটা একেবারেই কাল্পনিক এবং অবাস্তব নয়।
এমনকি এটি পরীক্ষায় সত্য বলেও প্রমাণিত হয়েছে।
তাই এতদিন যারা আইনস্টাইনের তত্ত্বকে কেবলমাত্র "প্রমাণবিহীন তত্ত্ব" হিসেবে জেনে আসছেন, তারা আসলে ভুল জেনে আসছেন (এটির সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে বিভিন্ন উচ্চতায় এটমিক ঘড়ি রেখে যেটি এক সেকেন্ডের মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সময় ব্যবধানও মাপতে সক্ষম)।
এটি তাই এখন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত সত্য।
আইনস্টাইনের পূর্বে সবার ধারণা ছিল এই মহাবিশ্বে 'ভর', 'সময়' এবং 'স্থান' হল পরম ধ্রুবক অর্থাৎ আপনি গতিশীল হউন আর স্থির থাকেন, সব সময় এদের মান একই পরিমাপ করবেন। কিন্তু পরবর্তীতে আইনস্টাইন প্রমাণ করেন যে এই মহাবিশ্বের কোন কিছুই পরম নয়, সবই আপেক্ষিক, এমন কি স্থান, সময় এবং ভরও।
ব্যাপারটিকে একটু ক্লিয়ার করা যাক।
ধরা যাক, আপনি দুটি ঘড়ি পর্যবেক্ষণ করছেন। ঘড়ি দুটোতে কোন যান্ত্রিক ত্রুটি নেই এবং এরা নিঃখুত সময় দিতে সক্ষম। একটি ঘড়ি আপনার সাপেক্ষে স্থির, অন্যটি গতিশীল (আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে)। এখন যদি আপনি দুটো ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার দিকে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন আপনার সাপেক্ষে স্থির ঘড়িটির সেকেন্ডের কাটাটি যে হারে টিক দিচ্ছে, গতিশীল ঘড়ির সেকেন্ডের কাটাটি সেই একই হারে টিক দিচ্ছে না, গতিশীল ঘড়ির সেকেন্ডের কাটাটি ধীরে চলছে। এটা যে কোন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঘটছে, তেমনটি কিন্তু নয়। এটার কারণ হল সময়ের আপেক্ষিকতা। সময়ের আপেক্ষিকতার সূত্র আমাদের বলে থাকে যে "কোন একজন পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে স্থির কাঠামোর ঘড়ি অপেক্ষা গতিশীল কাঠামোর ঘড়ি ধীরে চলে"।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সময়ের ব্যবধান বা পরিমাপ গতির উপর নির্ভর করে এক এক পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে এক এক রকম হয়ে থাকে।
সময়ের উপর শুধুই কী রয়েছে গতির প্রভাব?
না, এমনকি সময়ের উপর রয়েছে বস্তুর ভরের প্রভাবও। যেহেতু যেকোন বস্তুর ভর তার চারপাশে মহাকর্ষ বলের ক্ষেত্র তৈরি করে, তাই অন্যভাবে বলা যায় সময়ের উপর রয়েছে মহাকর্ষ বলের প্রভাব। এই মহাকর্ষ বল সময়কে স্লো বা ধীর করে দিতে পারে। যে বস্তুর ভর যত বেশি, তার কাছাকাছি মহাকর্ষ বলের মান তত বেশি এবং সেখানে সময়ও তত ধীর গতিতে চলে।
তাই আপনি যদি একটি এনালগ ঘড়ি নিয়ে কোন একটি ব্ল্যাক হোলের দিকে ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হন এবং পৃথিবী থেকে কেউ যদি আপনাকে পর্যবেক্ষণ করে, তাহলে সে দেখবে আপনি যতই ব্ল্যাক হোলের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন, ততই আপনার ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা স্লো হয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ সময় ধীরে চলা শুরু করেছে। এইভাবে এক সময় সে দেখতে পাবে যে সেকেন্ডের কাটাটি থেমে গিয়েছে অর্থাৎ সময় স্থির হয়ে গিয়েছে (উল্লেখ্য যে আপনি নিজে কিন্তু এই প্রভাব টের পাবেন না, আপনি দেখবেন সবই ঠিকঠাক চলছে, কারণ আপনার সাপেক্ষে ঘড়িটি স্থির)।
এইরকম একটা দৃশ্য আমরা দেখতে পাই ক্রিস্টফার নোলানের বিখ্যাত মুভি "ইন্টারস্টেলার"-এ, যেখানে একজন মহাশূন্যচারীকে ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি মাত্র এক ঘন্টা সময় কাটাতে দেখা যায় অন্য গ্রহে সেই সময়টিতে কেটে গিয়েছে সাত বছর।
পরিশেষে একটি মজার ঘটনা দিয়ে শেষ করা যাক।
আপনি জানেন কী আপনার মাথায় বয়স আপনার পায়ের পাতার বয়সের চেয়ে বেশি?
কেন বলুন তো?
ঐ যে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার প্রভাব।
আমরা জানি যে বস্তু যত পৃথিবীর পৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থিত, তার উপর পৃথিবীর মহাকর্ষ বল তত বেশি। আর যেখানে মহাকর্ষ বল যত বেশি, সেখানে সময় তত ধীরে চলে (আগের ব্ল্যাক হোলের উদাহরণটিতে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)। যেহেতু আমাদের পা থাকে ভূ-পৃষ্ঠের উপর এবং মাথা থাকে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে কিছুটা উচুতে, তাই আমাদের পায়ের কাছে অবস্থিত কোন বিন্দুতে সময় আমাদের মাথার কাছে অবস্থিত বিন্দুতে সময় অপেক্ষা ধীরে চলে, তাই আমাদের পায়ের পাতা আমাদের মাথা অপেক্ষা তরুণ।
বিঃদ্রঃ লেখাটিকে সাধারণ মানুষের সহজবোধ্য করার জন্য (যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড সাইন্স নয়) অনেক খুটিনাটি বিষয়ই আমি এড়িয়ে গিয়েছি। যেমন প্রথম উদাহরণে ভূপৃষ্ঠ থেকে রওনা দেওয়ার সময় রকেটের ত্বরন, ভূ-পৃষ্ঠের দিকে পুনরায় ফিরে আসার সময় রকেটের দিক পরিবর্তন করা এবং পৃথিবী-পৃষ্ঠে অবতারণ করার সময় রকেটের গতিবেগ হ্রাস, রকেটে গমনকারী যমজ ভাই নিজেকে একই ভাবে স্থির দাবি করে পৃথিবীতে অবস্থিত ভাইয়ের বয়স হ্রাস, ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ কাঠামোতে সময় বের করার জন্য আপেক্ষিকতার সূত্রাবলি ইত্যাদি।
-----------------------------------------------------------