মৈমনসিংহ গীতিকা একটি সংকলনগ্রন্থ যাতে ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রচলিত দশটি পালাগান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।[১] প্রথম খণ্ডের দশটি পালার রচয়িতা ভিন্ন ভিন্ন হলেও সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে।[২] এই গানগুলো প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে ১৯২৩-৩২ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই গানগুলো অন্যান্যদের সহায়তায় সংগ্রহ করেন এবং স্বীয় সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়হতে প্রকাশ করেন। তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার আইথর নামক স্থানের আধিবাসী চন্দ্রকুমার দে এসব গাথা সংগ্রহ করছিলেন। এই গীতিকাটি বিশ্বের ২৩টি ভাষায় মুদ্রিত হয়।
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের আনুকূল্যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ড.দীনেশ চন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গাথা সংগ্রাহক হিসেবে চন্দ্র কুমার দে মহাশয়ের কাছ থেকে নিম্নের পালাগুলো সংগ্রহ করেন।
ক)মহুয়া
খ)চন্দ্রাবতী (রচয়িতা নয়নচাঁদ ঘোষ)
গ)কমলা
ঘ)দেওয়ানা মদিনা (রচয়িতা মনসুর বয়াতী)
ঙ)দস্যু কেনারামের পালা (রচয়িতা চন্দ্রাবতী)
চ)কঙ্ক ও লীলা (দামোদর দাস, রঘুসুর, শ্রীনাথ বেনিয়া এবং নয়ানচাঁদ ঘোষ প্রণীত)
ছ)মলুয়া (এই পালাটির সূচনাতে মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর একটি বন্দনা রয়েছে বলে এর রচয়িতা হিসেবে চন্দ্রাবতীকে মনে করা হয়)
জ)দেওয়ান ভাবনা (চন্দ্রাবতী প্রণীত)
ঝ)কাজলরেখা
ঞ)রূপবতী
মহুয়া পালাসম্পাদনা
মহুয়ার পালার রচয়িতা দ্বিজ কানাই।। রসের দিক থেকে রোমান্টিক ট্র্যাজেডি ঘরানার কাব্য মহুয়া পালার সংগ্রাহক দীনেশচন্দ্র সেন। এর চরিত্রগুলো হলো- নদের চাঁদ, মহুয়া, হুমরা বেদে। এর রচনাকাল ধরা হয় ১৬৫০ সাল। এই পালায় মোট ৭৮৯টি ছত্র আছে। দীনেশচন্দ্র সেন মহুয়া পালাকে ২৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেন।
নদের চাঁদের বসতভিটা সুসং দুর্গাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে এবং ঝাঞ্ছাজাইল বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে বাউরতলা গ্রামের পাশে। সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদ ছিলেন এক জমিদারের দেওয়ান। অপর পক্ষে রূপবতি মহুয়া বেদে সরদার হুমরা বেদের পালিত কন্যা, যাকে শিশুকালে হুমরা বেদে নেত্রকোণার কাঞ্চণপুর থেকে ডাকাতি করে নিয়ে আসে। জানা যায়, বেদে মহুয়াও এক সভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। বেদেরা ঘাটে ঘাটে নোঙ্গর ফেলত ও হাট বাজারে পাড়ায় সাপের খেলা দেখাত। বেদে মহুয়া যখন নদের চাঁদের গ্রামে সাপের খেলা দেখাতে আসেন তখন মহুয়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে নদের চাঁদ তাকে প্রণয় নিবেদন করেন। মহুয়াও নদের চাঁদের প্রণয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। কিন্তু দুজনের প্রণয়ের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সরদার হুমরা বেদে। এক দিন নদের চাঁদ মহুয়াকে নিয়ে পালিয়ে যান। এদিকে হুমরা বেদে তা জানতে পেরে দলবল নিয়ে তাঁদের পিছু ধাওয়া করে। অবশেষে তারা মহুয়া এবং নদের চাঁদকে ধরে ফেলে। হুমরা বেদে নদের চাঁদকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সরদার মহুয়ার হাতে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে বলে ‘‘যাও নদের চাঁদকে মেরে ফেল’’। বিষলক্ষা ছুরি নিয়ে মহুয়া নদের চাঁদের দিকে এগিয়ে যান। নদের চাঁদের সম্মুখে পৌছে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে তিনি তাঁর নিজের বক্ষ বিদীর্ণ করেন এবং মাটিতে ঢলে পড়েন। প্রণয় পিয়াসী নদের চাঁদ মহুয়ার এই আত্মত্যাগ সহ্য করতে না পেরে প্রেমের প্রতিদান সরূপ বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে নিজ জীবন আত্মহুতি দেন। মহুয়া ও নদের চাঁদের এই আত্ম ত্যাগ চিরন্তন প্রেমকে মহিমান্বিত করেছে। আজও সেই প্রেমের অমর কহিনী লোক মুখে মুখে বিরাজমান
দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় লিখেছেন, ”মহুয়ার প্রেম কী নির্ভীক, কী আনন্দপূর্ণ! শ্রাবণের শতধারার ন্যায় অশ্রু আসিতেছে, কিন্তু প্রেমের মুক্তাহার কণ্ঠে পরিয়া মহুয়া চিরজীবী, মৃত্যুকে বরণ করিয়া মৃত্যুঞ্জয়ী হইয়াছে।"
মলুয়া পালাসম্পাদনা
প্রধান চরিত্র মলুয়ার নামে পালার নামকরণ করা হয়েছে "মলুয়া পালা"। মলুয়া পালার রচয়িতা অজ্ঞাত। তবে রচনার শুরুতে কবি চন্দ্রাবতীরএকটি ভণিতা থাকার কারণে ধারণা করা হয় এটি চন্দ্রাবতীর রচনা।কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খণ্ডে এই ধারণা অসত্য বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু বাংলার পুরনারী নামের বইয়ে মলুয়া চন্দ্রাবতীর রচনা বলা মন্তব্য করেন। মলুয়া গাথার মোট ছত্রসংখ্যা ১২৪৭। পালাটি মোট ১৯টি অঙ্কে বিভক্ত।
মলুয়া ও চাঁদ বিনোদের দাম্পত্য সম্পর্ক, কাজির ক্ষমতায় বিচ্ছেদ, উত্থান-পতন, ক্ষমতাবান কাজির দাপট ও তার কাছে হার না মানা এক বাঙালি নারীর কাহিনী হলো "মলুয়া পালা"।মলুয়া চরিত্র সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য করেন, " রাগে উজ্জ্বল, বিরাগে উজ্জ্বল, সহিষ্ণুতায় উজ্জ্বল এই মহিয়সী প্রেমের মহাসম্রাজ্ঞীর তুলনা কোথায়?"
কমলা পালাসম্পাদনা
মূল চরিত্র কমলার নাম থেকে পালার নামকরণ করা হয়েছে। পালাটির রচয়িতা দ্বিজ ঈশান। কমলা পালায় মোট ১৩২০টি ছত্র এবং ১৭টি অঙ্কে বিভক্ত।
প্রিয়তমা স্ত্রীর শখ পূরণে রাজা জানকীনাথ মল্লিক তার স্ত্রীর নামে কমলা সায়র দিঘি খনন করান। কিন্তু দিঘিতে জল না উঠায় রাজা নরকপ্রাপ্ত হওয়ার ভয় পেলে রানি কমলা স্বামীকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন। তিনি তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দাসীদের হাতে সমর্পণ করে সদ্যখোঁড়া দিঘিতে নিজেকে উৎসর্গ করে চিরতরে হারিয়ে যান। রানিকে হারানোর শোকে কিছুদিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। মৈমনসিংহ গীতিকার ভূমিকায় দীনেশচন্দ্র সেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা আলোচনা করে ধারণা করেন এই কাহিনীর মূল ঘটনা সত্য।
কাজল রেখাসম্পাদনা
মৈমনসিংহ গীতিকায় যুক্ত হওয়া একমাত্র রূপকথা কাজল রেখা পালা। এই পালার রচয়িতা অজ্ঞাত। এই পালার কিছুটা সংক্ষিপ্ত রূপ সংকলিত হয়েছে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলিতে।
ধনেশ্বর তার অর্থনৈতিক দুর্ভাগ্যের কারণের শুকপাখির উপদেশে কন্যা কাজল রেখাকে এক গভীর নির্জন বনের ভাঙা মন্দিরে রেখে আসে। সেই মন্দিরে এক সন্ন্যাসী কোনো এক মৃতপ্রায় রাজপুত্রের জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য সূঁচ বিঁধিয়ে রেখেছিলেন। পিতা ও সন্ন্যাসীর কথায় কাজল রেখা সেই সূচরাজপুত্রকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করে নেয়। তার সূচ তুলে রাজরানী হয়ে থাকার সময় আবার এক দুর্ঘটনা ঘটে। হাতে কাঁকন দ্বারা কিনে নেওয়া দাসীর কৃতঘ্নতায় কাজন রেখা দাসী হয়ে স্বামীর রাজ্যে বাস করতে থাকে। এক সময় সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে কাজল রেখা।
Good