এক গাছের ছাল অন্যগাছে লাগে না!'
মুখের উপর আমার বড় জা কথাটা বলে দিলেন। শাশুড়ি সামনে ই ছিলেন তবুও চুপচাপ। তিনিও এই কথায় সম্মত জানি আর এ জন্য গত এক সপ্তাহ ধরে এ বিষয়ে আমাদের মত বিরোধ চলছে।
প্রথমদিন যেদিন সায়মানকে কোলে নিয়ে বাড়ি আসি আমি আর আদিব সেদিন ই ঘরের পরিবেশ পাল্টে যায়।
আমার শাশুড়ির একটা ই কথা কোথাকার কার সন্তান এই বংশে এসে স্থান দখল করবে এটা উনি মেনে নিতে পারবেন না।
নিজের রক্তের কেউ ছাড়া এই পরিবারে আর কারো জায়গা নেই।
আমি অনেক ভাবে অনেক বার বুঝাতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি।
বরং উল্টো আমাকে ই কথা শুনতে হয়েছে কারণ আমি আর আদিব একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। আর
অন্যদিক দিয়ে গেলে আদিবের পরিবারের মত এত বড় আর প্রভাবশালী পরিবারে বিয়ে হওয়ার কথাও না।
আমি মফস্বল এলাকার মেয়ে। পড়ালেখার সুবাদে আদিবের সাথে পরিচয় আর সেখান থেকে প্রণয়।
আমি নিম্নমধ্য বিত্ত পরিবারের মেয়ে।
যাই হোক বিয়ে নিয়ে অনেক চড়াই উৎড়াই হলেও শেষে সব ঠিক হয়ে যায়।
কিন্তু এটা শেষ হলেও আস্তে আস্তে বিপত্তি বাঁধে অন্যকারণে। আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনো কোন সন্তান নেই।
অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি এমন কোন টেস্ট নেইই যে করানো হয়নি কিন্তু ডাক্তার আমার আর আদিবের মাঝে কারো ই কোন সমস্যা খুঁজে পেলেন না।
সবকিছু নরমাল শেষে একটা কথা ই বললেন ডাক্তার আল্লাহ চাইলে সব হবে।
হ্যা সেই চাওয়ার অপেক্ষায় আরো দু বছর পার করি।
এরপরে অনেকের অনেক কথা শুনে কবিরাজিও করেছি কিছু ই হয়নি।
তবুও এ নিয়ে আজ অব্দি আদিবের মাঝে কোন আক্ষেপ বা আফসোস দেখিনি বরং সে আমাকে সাহস দিত ধৈর্য্য ধরতে বলতো সব ঠিক হবে একদিন।
আমিও সে আশায় রই।
কিন্তু আমাদের দুজনের সম্মতিতে আর সমাজ সংসার চলে না।
আমার ছোট জা'য়ের ছেলের আকিকাতে আসা আত্মীয়রা আমাকে অনেক আকার ইঙ্গিতে কটু কথা বলেন।
আমি শোনেও না শোনার ভান করি।
শেষ পর্যন্ত যখন আমার বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা নিয়ে কটু কথা বলে তখন আর সেখানে থাকতে পারিনি চলে আসি আমার রুমে।
সেই দিন রাত্রে আমার শাশুড়ি আদিবকে ডাক দিলেন। সে রুমে চলে যায় আর আমার ভিষণ মাথা ধরেছে চা বানানোর জন্য রান্নাঘরের দিকে চলে যাই।
মা'য়ের রুমের পাশ দিয়ে ই রান্নাঘরে যেতে হয়। চা বানিয়ে নিজের রুমের আসতে ই শুনলাম আমার শাশুড়ি বলছেন
__ এভাবে তো আর হয় না। জীবন তো এভাবে চলতে পারে না। তুই যদি ওকে ছাড়তে না পারিস থাক সমস্যা নেই তবুও আবার বিয়ে কর। তোর শেষ সময়ের কথা ভেবে কর আমরা তো আর সারা জীবন থাকবো না সাথে। আর শেষ সময়ে সন্তান নামক ছায়া না থাকলে কতটা অসহায় হয় জীবন ভাবতে পারবি না তুই।
এতটুকু শোনে আমি সেখান থেকে চলে আসি। হাতের চা টুকুও খাইনি। এমনকি আদিবের সাথে রাতে কথা পর্যন্ত বলিনি সেও মায়ের রুম থেকে এসে চুপচাপ শুয়ে পরে।
পরদিন আদিবকে আমিও বুঝাই নিজেকে অনেক শক্ত করে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি মায়ের কথাগুলো।
সে তখনো চুপ। তার এই নিরবতা দেখে আমার ভেতরে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। মেনে নিচ্ছিলাম নিরবতা হয়ত সম্মতির লক্ষণ।
আর কিছু করিনি সারাদিন হাতে যেন কোন কাজ ই উঠছিল না। অবশ লাগছিল পুরো শরীর। বিকেলো অফিস থেকে হুট করে চলে আসে আদিব এসে ই বলল রেডি হতে।
আমি কিছু বুঝিনি দেখে বলল এত ভাবতে হবে না তৈরি হয়ে নাও।
মা'কে বলে বাইরে যাই আমরা।
আর সেই পড়ন্ত বিকেলে এক টুকরো সোনালি সূর্য যেন আমার কোল জুড়িয়ে দিল আদিব।
আমি কার দিকে তাকাবো বুঝতে পারছিলাম না।
আদিবকে কিছু বলব নাকি এই পবিত্র নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবো বুঝতে পারছিলাম না।
আদিব শুধু বলেছিল
সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন উপায় আছে জীবনে!
তখন মনে হয়েছিল আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী নারী। আজ আমার স্বামী সংসার আর সন্তান মিলে পূর্নতা পেল।
বাড়ি ফেরার পথে এতটা কান্না করেছিলাম কেন জানিনা।
কিন্তু ঢুকতে ই বিপত্তি বাঁধে। এই বংশে এমন কোন সন্তানের স্থান নেই। গ্রামের মাঝে সৈয়দ বংশের আলাদা একটা নাম ডাক আছে সেখানে এই বেনামি সন্তানের জায়গা হবে না।
আমার শাশুড়ি এক কথার মানুষ। আমার শ্বশুর আছেন তবে অসুস্থ প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় ঠিক মত কথাও বলতে পারেন না। সবখানে শাশুড়ির আধিপত্য।
কোন ভাবে ই মেনে নেবেন না।
এক পর্যায়ে এই সন্তানের জন্য ঘর ছাড়তে হল আমাদের।
আদিবের একটা ই কথা কথা যে সন্তানকে নিজের করে নিয়েছি আল্লাহর নাম নিয়ে তাকে তো ছুড়ে ফেলতো পারবো না। তবে মা বাবার দায়িত্ব আমরাও ভুলে যাই নি।
শহরের বাসায় নিজেদের মত ঘর নিলাম।
সপ্তাহে একদিন শ্বশুরবাড়ি যেতাম যদিও শাশুড়ি অনেক সময় কথা বলতেন আবার না ও বলতেন। এতে আমরা কিছু মনে করতাম। মাসের নির্দিষ্ট একটা তারিখে বাবা মার একাউন্টে টাকা চলে যেত।
বাবার চিকিৎসার খরচও অনেকটা আদিব নিত শ্বশুরকে আমাদের বাসায় এনে কয়েকদিন রাখতাম যত্ন নিতাম আদিবের আদেশ। আমার এসবে আপত্তি নেই
শুধু একটা ই আফসোস নিজের গর্ভের সন্তান নেই বলে আজ আমার এই সন্তানকে মেনে নিতে এত আপত্তি এমনকি আমার ভাসুরদেরও।
এভাবে দিন চলতে লাগলো। সায়মান একটু একটু করে বড় হচ্ছিল। আমি খুব খেয়াল রাখতাম ওর সবার সাথে মিশতে দিতাম ওকে। এমনকি ভিক্ষুক আসলেও আমি সায়মানকে দিয়ে চাল/ টাকা কিংবা খাবার পাঠাতাম যখন তারা সায়মানের হাত থেকে কিছু নিয়ে ওর জন্য খুশি হয়ে দোয়া করতো আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিত সায়মান এত খুশি হত আর হাসতো বলে বুঝানোর মত না। ছোট্ট বাচ্চা কি বুঝতো কে জানে!
সে ভিষণ পরিপাটি ওর আমি কিংবা আদিব কেউ ই নই।
স্কুলে যাওয়া যখন শুরু হয় আমার মনে আছে হাতে গোনা কয়েকদিন ছাড়া আমাকে ওর বইখাতা জিনিসপত্র গুছিয়ে দিতে হয়নি।
বাসায় কাজ করা রহিমাবুর ছেলে যখন আসতো তখন সে যা খেত তাকেও তা দিতে হত!
আর দেখতে এত সুন্দর একদম রাজপুত্রের মত এমনকি স্কুলে আমাকে আর আদিবকে দেখে কেউ বিশ্বাস করেনা আমাদের ছেলে অনেক মজা করে কোন দেশ হতে চুরি করেছেন। তখন ই বুকটা ধক করে উঠত।
একদিন হুট করে ই বলল। মা আমার একটা বোন এনে দাও!
তখন আমার মুখের কথা আটকে গিয়েছিল। অনেক কথা বলার তবে ছেলেকে বলার মত কিছু ই ছিল না।
যখন জানতে চাইলাম কেন এমন কথা?
সে বলল
__ ওর বন্ধু ওর বোনের জন্য আইসক্রিম কিনে পেন্সিল কিনে নিয়ে যায়। কত রকমের চকলেট কিনে বলে এগুলা না নিয়ে গেলে নাকি বোন ওর সাথে খেলবে না। কিন্তু আমি কার জন্য আর কার সাথে খেলবো কেউ তো নেই।
আমি জানিনা কি জন্য শুধু কান্না ই করছিলাম হঠাৎ দেখলাম আদিব পেছনে দাড়িয়ে।
আবারো জীবনের আরেকটা সিদ্ধান্ত নিতে হল আমাদের তবে আগেরটা ছিল নিজেদের জন্য আর এখন সন্তানের জন্য।
নিয়ে আসলাম একটা ফুটফুটে মেয়ে। সেদিন সায়মানের খুশি দেখে কে!
ফোন দিয়ে বন্ধুকে বলছে বোনের কথা।
এভাবে ই চলতে লাগল জীবন। শ্বশুর শাশুড়ি কেউ নেই জা ভাসুর কেউ দেশে কেউ দেশের বাইরে।
সায়মান ইন্টার পরিক্ষা দিল। এডমিশনের জন্য বিভিন্ন কাগজপত্র বের করতে করতে হঠাৎ ওর এডপ্টের পেপার দেখে ফেলে!
সে কাগজটা হাতে নিয়ে দাড়ায় সামনে! আমি কাগজ ছুড়ে ফেলে জড়িয়ে ধরে বলি এগুলো মিথ্যা তুই আমার নাড়ি ছেড়া ধন। ওগুলো কিছু না বাবা।
সায়মান বলল
__এ জন্য আমি তোমাদের কারো মত হইনি দেখতে!
কথাটা শুনে মনে হচ্ছে কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে কিভাবে বুঝাবো চেহারা না বাপ একবার যদি তোকে বুকের ভেতরটা দেখাতে পারতাম।!
অনেক কান্না করলাম অনেক কিছু বললাম কিন্তু আমার ছেলে আর কিছু ই বললো না। সে খুব কম কথা বলে তবে যতটুকু বলে সে কথায় কোথাও হেরফের থাকে না।
রাত পেরিয়ে গেল আমি আর আদিব চুপচাপ দুজন দুপাশে বসে রাত কাটিয়ে দিলাম মুখে কোন কথা নেই। ফজরের আজান পরে ই হুট করে সায়মান রুমে আসলো। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার সন্তানের চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে ঘুমায়নি সারারাত। নাকের ডগা অসম্ভব লাল হয়ে আছে ফর্সা চেহারায় চোখের পাশের শিরা গুলো স্পষ্ঠ ভাসছে।
রুমে এসে ই আমার পায়ের কাছে বসে পড়লো। আমাকে আদিবকের কাছে নিয়ে গিয়ে বসালো বলল
__আমি তোমাদের সন্তান এই কাগজ গুলো মিথ্যা আমি দেখতে চাইনা এগুলো আর। বলে ই দেয়াশলাই দিয়ে পুড়িয়ে ফেললো কাগজ গুলো।
আমি আর আদিব দুজন দুপাশ থেকে ঝাপ্টে ধরলাম সায়মানকে।
আমাদের সন্তান চোখ মুছে দিল আমাদের।
মনে হল প্রাণ ফিরলো আমাদের। পেছন থেকে আরো একটি কাগজ বের করলো সেই কাগজ গুলোও অপরিচিত নয় আমাদের মেয়ের তিতলির এডপ্টের কাগজ!
সেগুলো পুড়িয়ে দিয়ে বললো
__আমার বোন যেন কখনো এই শব্দ কানেও না শুনে।
এই তো এভাবে চলে গেছে কত বছর!
কই জীবন তো কোথাও আমাদের অপূর্ণ রাখে নি। কানায় কানায় পূর্ণ জীবন আমাদের। সায়মান আর তিতলি শুধু সন্তান না তারা আমাদের দুজনের প্রতিটি নিশ্বাস। যেমন পেটে ধারণ করা সন্তানের চেয়ে কোন অংশে কম নয় সেটা।
আজ সে কোথায় জানি নিয়ে গেল!
গিয়ে দেখলাম একটা বৃদ্ধাশ্রম শ'য়ের উপরে মানুষ আজ নাকি দুবছর হল এটার।
আমি আর আদিব অবাক হয়ে আছি সায়মান আমাদের জড়িয়ে ধরে আছে বলছে দেখো তোমরা আমার একটা পৃথিবী আর এই একটা পৃথিবী আমার।
তোমাদের মত মা বাবারা যেন কখনো কষ্ট না পায় আমার একটু চেষ্টা শুধু।
এত ভীড়েও কেউ একজনে চিনতে ভুল হল না আমার। হা সেই জা আমার! একসময় ছেলেমেয়ের সাথে দেশের বাইরে ছিলেন আর আজ তাদের জীবন থেকে বাইরে।
শুধু একটি কথা বললাম উনাকে
__ এক গাছের ছাল আরেক গাছে না লাগিয়ে বরং তাকে বটগাছ বানালে সে অনেকের মাথার উপর ছায়া হতে পারে।
#_পূর্ণতা
ফাবিহা ফেরদৌস
খুব সুন্দর