……তনয়াকে চড় মেরে আয়াত নিজেও অনেকটা কষ্ট পেলো।
পরোক্ষণে নিজের হাত সজোড়ে দেয়ালে একটা ঘুষি মারল। তনয়া আয়াতের উপর কোন কথা বলল না। চুপচাপ ওখান থেকে চলে গেলো। আয়াতের খাবার টেবিলে দিয়ে তনয়া অন্য রুমে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলো।
কিন্তু ওর চোখ দুটো চুপ থাকতে পাড়ছে না। নিজের গতিতে জল গুলো বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে তনয়া ঘুমের ভান ধরে রইলো।
আয়াত চুপচাপ ওর পাশে এসে বসল। আয়াত দেখছে তনয়ার গালে ওর চড়ের দাগটা লাল হয়ে আছে। আলতো করে তনয়ার গালে হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর তনয়ার হাতটা ধরতে যাবে তখন দেখে তনয়ার হাত বাঁধা। কিন্তু বাঁধনের উপর দিয়েও চুইয়ে চুইয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আয়াতের বুকটা কেঁপে উঠলো।
ও তাড়াতাড়ি ফাস্টএইড বক্স এনে তনয়ার হাতের কাপড়টা খুলে দেখে অনেকটা কেটে গেছে। জায়গাটা ধীরে ধীরে ভালো করে পরিষ্কার করে ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো। তনয়ার গালে ব্যথার মলম লাগিয়ে দিলো।
তারপর তনয়ার কপালে একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে কোলে তুলে নিজেদের রুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আয়াত যেতে চাইলে তনয়া আয়াতের হাতটা ধরে আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল,
_" এত ভালোবাসেন তাহলে এত কষ্ট দেন কেন? আর এত ঘৃণা করেন কেন?
আয়াত কি বলবে ঠিক ভেবে না পেয়ে তনয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
_" তনয়া আমি জানি তুমি ঘুমাওনি! ঘুমালে তোমার চোখ থেকে জল পড়তো না।
তনয়া অভিমান করে বলল,
_" এতটা ভালোবাসা দেখানোর কোন প্রয়োজন নাই? আপনার ভালোবাসা ঠিক কি আমি জানি? আমাকে কষ্ট দেয়াটাই আপনার ভালোবাসা। তাই না?
আয়াত কোন কথা বলছে না। চুপ করে তনয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তনয়া আবার বলল,
_" বুঝলাম নাহয় আপনি আমার ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন। কিন্তু কী কারণে নিচ্ছেন? সেটা নাহয় নাই বললেন, কিন্তু আপনি আগে থেকে জানতেন যে নীলয় আপনার বন্ধু রাহাত?
..... এ প্রশ্নের উত্তর আজ আপনাকে দিতে হবে? আর আমি এমন কি করলাম যার কারণে আপনি আমায় এমন নোংরা কথা বললেন যে আমার এক ছেলেতে হয়না! বলুন?
আপনি নিজের বুকে হাত দিয়ে বলুনতো আপনার মন কি সত্যিই শায় দেয় যে আমি এতটা নোংরা।
আয়াত কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বলল,
_" নাহ। আমি জানি তুমি এমন নোংরামি কখনো করতে পারো না। তবুও-----
_" তবুও কী বলুন? তাহলে আপনি আমায় এত বড় নোংরা উপাধি দেয়ার আগে একবারও ভাবলেন না? যে সত্যিই আমি এমন কি না?
_" কি করবো বলো মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিলো।
_" কেন? এমন কী হয়েছিলো যার কারনে আপনার মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিলো?
_" আজ অফিস থেকে আসার সময় আমার একটা বন্ধুর সাথে দেখা হলো। ও আমার মোবাইলে তোমার ছবি দেখে বলল, রাহাতের গার্ল ফ্রেন্ড এর ছবি তোর মোবাইলে কেন?
......তখন আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। কারণ আমি সত্যিই জানতাম না যে তোমার যার সাথে সম্পর্ক ছিলো সে রাহাত মানে নীলয়। হ্যাঁ রাহাতের নিক নেইম হিসাবে রাহাত নীলয় লেখে কিন্তু ও নামে ওকে তেমন কোন লোকই চেনে না। তাই তুমি যখন নীলয়ের কথা বলেছিলে তখন আমি স্বপ্নেও ভাবতেও পারিনি নি যে রাহাত ই নীলয়।
তারপর আমি সত্যিটা কনফ্রম হবার জন্য রাহাতের কাছে গেলাম। ওকে বললাম তুই তনয়াকে আগে থেকে চিনতিস। কিন্তু ও তোমার বিষয়ে অনেক নোংরা কথা বলেছিলো। ও তারপর বলল, ওর সাথে নাকি তুমি আবার রিলেশন শুরু করছো।
......কথাটা শুনে মেজাজটা অনেক খারাপ হয়ে গেছিলো। তারপর ওর ফোনে তোমার ফোন নাম্বার দেখালো। তুমি আজ সকালে ওকে ফোন দিয়ে কথা বলছো তার ডিটেলস দেখালো। যেটা দেখে আমার মেজাজটা গরম হয়ে গেলো। রাহাতের সাথে কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হলো।
রাহাত তোমাকে নিয়ে অনেক নোংরা কথা বলছিলো । তাই ওকে কয়েকটা চড় মেরে বাড়ি চলে আসলাম। কিন্তু তুমি রাহাতকে ফোন দিয়েছিলে কেন?
_" আপনি যদি সত্যিটা আমার কাছে একবার জিজ্ঞেস করতেন আমি আপনাকে বলে দিতাম। রাহাত যে নীলয় সেটা আমি সেদিন জেনেছি যেদিন ও আর আপনার এক বন্ধু আমাদের বাসায় দুপুরে খেতে আসছিলো।
......তারপর আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার খুব ভয় লাগতেছিলো। আর ভেবেছিলাম আপনাকে বললে আপনি হয়তো আমায় বিশ্বাস করবেন না। কারণ পৃথিবীতে সব থেকে ঘৃণাতো আপনি আমায় করেন! আর শুধু সকালে না এর আগে আমি আরো একবার রাহাত কে ফোন করেছিলাম।
.......কিন্তু আমি ওর সাথে ঠিক কি কথা বলেছিলাম সেটা আপনি চাইলে শুনতে পারেন। কারন আমার মোবাইলে অটো কলরেকর্ডার চালু করা । কিন্তু আমি আপনাকে এখন সেটা শুনতে দিবো না।
.........কারন আপনি আমায় আজ চরম অবিশ্বাস করেছেন। হ্যাঁ আপনাকে এগুলো শুনতে দিবো কিন্তু যখন আমি নীলয় মানে রাহাতের সব ষড়যন্ত্রের কথা আপনার কাছে বলতে পারবো। তারপর তনয়া সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর আয়াত তনয়ার কাছে এসে বলল,
_" সরি তনয়া। প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও প্লিজ।
_" আয়াত কারো কোন কথা বিশ্বাস করার আগে সে কথা গুলো ভালোভাবে ভেবে দেখতে হয়। যে আদৌ কথা গুলো সত্যি কিনা?
_" বললাম তো সরি। প্লিজ তনয়া। মাফ করে দাও না। কী করবো বলো তখন আমার জায়গায় তুমি থাকলেও তোমার মেজাজও আমার মত গরম হতো।
তনয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
_" চলুন খেয়ে নিবেন।
তনয়া আয়াতের কথা গুলো এড়িয়ে গেছে। কারণ আজ সত্যিই ওর খুব কষ্ট লেগেছে। নিজের কাছের মানুষটার কাছে থেকে এমন অপবাদ কোন মেয়ের ই কাম্য নয়। তারপর আয়াত নিজের হাতে তনয়াকে খাইয়ে দিলো।
পরের দিন আয়াত সকালে অফিস গেলো। কিন্তু যাবার আগে তনয়ার জন্য রান্না করে গেলো। আর বলল, কোন কাজ যেনো না করা হয় হাতের ঘাঁ ঠিক হবার আগে।
তনয়া একা একা বসে আছে। খুব বোরিং লাগছে। এর মধ্যে ওর বান্ধবী অনু ফোন করলো । অনু তনয়ার বিষয়ে প্রায় সব কিছুই জানে। অনু বলল,
_" কেমন আছিস তনয়া?
_" ভালো তুই?
_" ভালো থাকলে তোর গলার স্বর এমন কেন? কি হয়েছে বল?
_" কিছু নারে ভালো লাগছে না।
_" হুমমম বুঝলাম। এখন বল সেদিন যে তুই একজনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি সে কি বলল?
_" সেদিন আমি সেই দোকানে চাচার কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম চাচা এক দেড় বছর আগে এখান থেকে কী কেউ মাসে দু'বার চিঠি নিতো?
চাচা অনেক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে তারপর বলল,
_" হ্যাঁ। প্রায় এক দেড় বছর আগে পর্যন্ত একটা ছেলে এখানে আড্ডা দিতো। আর প্রত্যেক মাসে দু'বার চিঠির জন্য পাগল হয়ে থাকতো। তারপর আমি নীলয় মানে রাহাতের একটা পিক দেখিয়ে বললাম এই সেই ছেলে কিনা?
চাচা বলল, নাতো! এটা তো সেই ছেলেটা না। সেই ছেলেটা দেখতে অনেক সুন্দর। লম্বা ফর্সা অনেক সুন্দর। যাকে তোমরা স্মার্ট বলে থাকো। চাচার বর্ননায় মনে হলো আয়াত ! তাই আমি চাচাকে আয়াতের একটা ছবি দেখালাম। চাচা বলল, হ্যাঁ ওই তো। ছেলেটা ভীষণ ভালো।
কিন্তু একটু পাগলাটে টাইপের। মানে একটা মেয়ে ওকে চিঠি পাঠাতো। আর যখন চিঠিটা হাতে পেতো তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতো। চিঠিটা নিয়ে ছেলেটা ঐ যে একটা বেষ্টনি ঘেরা বড় বাড়ি দেখো? সেখানে চলে যেতো। কিন্তু গত একবছর ধরে কোন চিঠি আসেনি। বা ছেলেটাকেও দোকানে আর তেমন দেখতাম না। তবে হ্যাঁ মাঝে মাঝে ঐ বাড়িতে এখনো আসে।
তারপর আমি চাচার কথা মত সেই বাড়িতে যাই। দরজায় বেল বাজানোর পর এক ভদ্র মহিলা দরজা খুললেন। আমি তাকে বললাম,
_" আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
_" ওয়ালাকুম আসসালাম।
_" আন্টি আপনি আমাকে চিনবেন না? ইনফ্যাক্ট আমিও আপনাকে চিনি না। আমি কি আপনার সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলতে পারি? যদি আপনি কিছু মনে না করেন?
_" তুমি তনয়া না? আরে হ্যাঁ তনয়াই তো। আরে তুমি কোথায়? দেখো কে এসেছে তনয়া! আয়াতের মেঘ পরী।
আমি আন্টির কথা শুনে অনেকটাই অবাক হলাম তারমানে আন্টি আমাকে চেনেন।কিন্তু কিভাবে?
_" আন্টি আপনি আমাকে চেনেন?
_" কেন চিনবো না! তুমি আমার আয়াতের জান! আর তোমাকে চিনবো না? আয়াত দশটা কথা বললে তার নয়টা তোমাকে নিয়ে বলে।
_" আন্টি আয়াত আপনাদের কি হয়?
_" সম্পর্কের দিক দিয়েতো কিছু না। তবে মনের দিক দিয়ে অনেক কিছু। আমরা আয়াতদের বাড়ির পাশে থাকতাম। তখন থেকে আয়াতদের সাথে পরিচয়। আমরা সিলেট আসার পরও আয়াত সবসময় আমাদের সাথে যোগাযোগ রেখেছে। আমাদের কোন সন্তান নেই। আয়াত আমাদের ছেলের মত। আরে ভিতরে বসো। এর মধ্যে এক ভদ্রলোক আসলো আন্টি বললেন তার স্বামী।
_" আন্টি আপনারা আমাকে কিভাবে চিনলেন?
_" আঙ্কেল বললেন, গত দেড় বছর ধরে তোমাকে আমরা চিনি। আয়াত সবসময় তোমার কথা বলে। তুমি ওর সবকিছু। তোমায় ভীষণ ভালোবাসে। তোমার চিঠি পাবার পর কি যে খুশি হতো। আয়াতও তোমার মত শব্দ আর অক্ষর নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। আমি আয়াতকে ফোন করে তোমার কথা বলছি!
_" না আঙ্কেল প্লিজ। আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে। আর প্লিজ আঙ্কেল কথা গুলো আয়াতকে বলবেন না। বললে ও আমায় ভুল বুঝবে!
_" কি হয়েছে মা?
তারপর আমি সব কিছু খুলে বললাম। কারণ মানুষ দুটোকে আমার খুব ভালো মনে হয়েছিলো। তারা তো আমার কথা শুনে হতবাগ। আমি বললাম আন্টি আমি এটা তো বুঝতে পারছি যে আমি যাকে ভালোবাসতাম সে নীলয় নয় আয়াত। কিন্তু আয়াত নিজের নাম লুকিয়ে ওর বন্ধুর নাম কেন বলল?
_" আন্টি বললেন, না তনয়া! আয়াত বন্ধুর নাম ভেবে বলেনি? আয়াতের নীলয়ের নীল শব্দ বা নাম যাই বলো ওর ভালো লাগতো। তাই ও দুষ্টুমি করে নিজের নামের জায়গায় নীলয়ের নীল দিতো। কিন্তু আয়াত হয়তো বুঝতে পারেনি ওর দুষ্টমিটা ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে?
_" কিন্তু আন্টি আমি ভাবছি তাহলে আয়াত আমায় এত ঘৃণা করে কেন? আর নীলয় ই বা আমাদের মধ্যে কোথা থেকে আসলো ? আর কিভাবে?
_" আঙ্কেল বললেন, সেটাতো আমরাও চিন্তা করছি। তুই ভাবিস না মা এ বিষয় জানতে আমরা তোকে সাহায্য করবো।
_" আঙ্কেল প্লিজ এ বিষয়ে আয়াতকে কিছু বলবেন না।
_" তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আমরা আয়াতের খুশির জন্য সব করতে পারি।
অনু বলল,
_" তারপর?
_" তারপর আর কি? আঙ্কেল আন্টির কাছ থেকে আরো কিছু কথা জেনে চলে আসলাম। কিন্তু আমি ভাবছি আমাদের ভিতর নীলয় মানে রাহাত কিভাবে ঢুকে পরলো? আর কেন? ওর উদ্দেশ্য কি?
_" আমার তো শুনেই মাথা ঘুরাচ্ছে! তাহলে তুই কিভাবে সহ্য করছি আল্লাহ জানে?
_" আমি আয়াতের জন্য সব পারবো রে?
_" দোয়া করি তোর ভালোবাসা পূর্নতা পাক।
তারপর আরো কিছু টুকিটাকি কথা বলে ফোন রাখল।রাতে আয়াত আসার পর খাওয়া শেষে তনয়া বলল,
_" আমি কি আপনার ল্যাপটপটা একটু ইউস করতে পারি? কিছু কাজ ছিলো।
_" তাতে অনুমতি নেবার কি আছে? আমার যা সবইতো তোমার?
_" ধন্যবাদ।
তনয়া ল্যাপটপে নিজের কাজ সেরে বের হতে যাবে ওমনি একটা ফাইলে ওর চোখ আটকে গেলো। ফাইলটার নাম "মাই ডায়রি"। তনয়া বুঝলো আয়াত তার কথাগুলো এখানে লিখে রাখে। কিন্তু সেটা পাসওয়ার্ড দেয়া। তনয়া ভাবলো যে ভাবেই হোক আমি এটা পড়বোই। হয়তো এটা পড়লে আমার প্রশ্নের কিছু উত্তর জানতে পারবো…………
চলবে,,,,,,
🌴🌴🌴🌴🌴🌴🌴🌴🌴🌴🌴🌴🌴🌴🌴🌴🌴
❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤