দোতলায় গিয়েই তিরা ওদের শোবার ঘরে চলে যাচ্ছিল। আরশি
বলল,
"একদম ঘরে যাবিনা। তোর জন্য এতক্ষণ সময় নষ্ট করেছি এবার
কাজ করবি আমার সাথে।"
তিরা মুখ কাচুমাচু করে বলল,
"করতেই হবে?"
"হ্যাঁ করতেই হবে। আমি জানতাম তুই এসে পল্টি নিবি এজন্যই
যেতে চাইনি।"
"আচ্ছা সরি বাবা! বল কি করতে হবে।"
"চাল ডাল ধুয়ে চুলায় বসিয়ে দে। আমি বাকীসব রেডি করি।"
তিরা চাল ধুতে ধুতে বলল,
"আচ্ছা আরশি তুই কি অবজার্ভ করলি?"
"তুই কি আমাকে অবজার্ভ করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলি?"
"না কিন্তু এটাও একটা কারণ। কোথাও গেলে তুই সবকিছু
যেভাবে অবজার্ভ করিস, এতকিছু তো আমার চোখে পড়ে না।
এবার ঝটপট বলে ফেল তো কাব্যকে কেমন মনে হলো।"
আরশি পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বলল,
"এটা তোর সবচেয়ে জঘন্যতম চয়েজ।"
তিরা আহত চোখে তাকিয়ে বলল,
"কী বলছিস? এমন কেন মনে হলো? তোর দলের লোক তো, অনেক
বই পড়ে।"
"বই পড়লেই সে ভালো হয়ে গেল? ড্রয়িং রুমের সেন্টার
টেবিলের উপর দেখেছিস অ্যাসট্রে ভর্তি সিগারেটের
ফিল্টার? আর বুকসেল্ফের পাশের সোফাটা দেখেছিস
একপাশে দেবে গেছে? তার মানে ওই সোফাটায় শুয়ে শুয়ে বই
পড়ে আর সিগারেট খায়।"
"সিগারেট তো অনেক ছেলেই খায়, এটা কি কোনো দোষ হতে
পারে?"
"সবার খাওয়া আর এই ব্যাটার খাওয়া এক না। সে প্রচুর
সিগারেট খায়। যে মানুষ পুরো ঘর এত পরিস্কার করে রেখেছে
সে অনেকদিনের ফিল্টার অ্যাসট্রেতে জমিয়ে রাখবে না। তাই
যতগুলো ফিল্টার ওখানে ছিল সবগুলো আজকের।"
"এত সিগারেট খেলে তো ও ক্যান্সার হয়ে মারা যাবে, আমি
অল্প বয়সে বিধবা হব।"
আরশি অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
"তুই তো রকেটের গতিতে ছুটছিস!"
তিরা চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলল,
"শোন আমি ওর সিগারেট খাওয়া ছাড়িয়ে ফেলব দেখিস
তাহলেই তো হয়।"
"তুই ভাতটা বসাবি প্লিজ?"
তিরা ভাত ও ডাল বসিয়ে দিয়ে আরশির সামনে এসে দাঁড়িয়ে
মিনমিন করে বলল,
"আমার কেন যেন ওকে খুব ভাল লেগে গেছে।"
"কারণ ওর গালে একটা কাটা দাগ আছে। এই জিনিসের প্রতি
তোর অনেক দূর্বলতা। আজ পর্যন্ত যত গাল কাটা, কপাল কাটা
ছেলে দেখেছিস সবার উপরেই তো ক্রাশ খেয়েছিস!"
তিরার চোখ নাচিয়ে বলল,
"সিরিয়াসলি কাব্যর গালে কাটা দাগ আছে?"
"এতক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী দেখলি? আমি তো বই চাওয়ার সময়
একবার তাকাতেই দেখলাম!"
"দাঁড়া ফেসবুক থেকে ছবি দেখি।"
"একদম না। রান্না শেষ হওয়ার আগে একদম উঠবি না। সাহায্য
করবি বলেই তোর সাথে নিচে গিয়েছি।"
অগত্যা তিরা মুখ কালো করে বসে রইলো।
কাব্য ক্লাস থেকে ফিরে মূল ফটকের তালা খুলছিল। ঠিক তখন
চোখ পড়লো ছাদে। সূর্য ডুবে গেছে কিন্তু প্রকৃতিতে তার রেশ
এখনো রেখে গেছে। ছাদের কার্ণিশে দুহাতে ভর দিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে আরশি। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের
দিকে। বাতাসে তার সাদা ওড়না উড়ছে। কাব্য অনেকক্ষণ
সেখানে দাঁড়িয়ে আরশিকে দেখলো। আরশিও নড়ছে না,
কাব্যও নড়ছে না। হঠাৎ কোত্থেকে তিরা দৌড়ে এলো আরশির
কাছে। মোবাইলে কিছু দেখাতে দেখাতে খিলখিল করে হেসে
উঠলো। আরশি একবার তাকিয়ে দেখলো। হাসি হাসি মুখ করে
তিরার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। এরপর হটাৎই তিরা
আরশিকে টেনে ছাদ থেকে নিয়ে গেল। মেয়েটির নীরবতাই
প্রতিনিয়ত মেয়েটির প্রতি আগ্রহী করে তুলছে কাব্যকে।
যতবারই আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার
চোখদুটি যেন কাকচক্ষু জলের দিঘি। এত গভীরতা কেন ওই
দু'চোখে? কীসের এত বিষন্নতা? একটা কারণ সেদিন অবশ্য
জানা গেছে৷ মেয়েটির বাবা মা নেই। সেজন্যই কি এত বিষন্ন
দুঃখ ভারাক্রান্ত ওই চোখ নাকি অন্যকিছু?
সেদিন দুপুরেই তিরা কাব্যকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট
পাঠিয়েছিল। কাব্য দেখেও ফেলে রেখেছিল। আজ এক্সেপ্ট
করলো। তারপর সোজা চলে গেল ফ্রেন্ডলিস্টে। কিন্তু
ফেন্ডলিস্ট হাইড করা। এরপর ছবিতে ঢুকতেই দুই বোনের
একসাথে অনেক ছবি পেয়ে গেল। সব ছবিতেই তিরার ঠোঁটে
লম্বা লম্বা হাসি ঝোলানো। কিন্তু আরশির মুখ স্বাভাবিক।
বড়জোর হাসি হাসি মুখ। মেয়েটির মুখে হাসি নেই কেন?
ছবিগুলোয় ট্যাগ করা আরশির আইডিও পেয়ে গেলো, আরশি
মেহনাজ। আইডিতে ঢুকলো কাব্য। এখানেও কোনো হাসিমুখের
ছবি নেই। ওই বিষন্ন ছবিগুলোই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল কাব্য।
ওই বিষন্ন চোখের অনেক না বলা কথা শুনতে ইচ্ছে করছে
কাব্যর। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে গিয়েও নিজেকে
থামালো কাব্য। তার মত ছেলের এত অল্পতেই কারো প্রতি
এতটা আগ্রহী হওয়া উচিৎ না।
চলবে,,,,,,,,,,