ভ্রমন

4 15
Avatar for LittleBird
3 years ago

#আজমির_ও_তারাগাহ_পাহাড়_দেখা

আটশ' বৎসর পূর্বে বিয়ের আসরে বসেছিলেন পৃথ্বিরাজ। সে সময়ে যুদ্ধ শুরু হয়। মা পৃথ্বিরাজকে বললেন - বাবা এখন যুদ্ধে যাও, পরে বিয়ে করো। রাজা যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁর কবর এবং কাঁচের বাক্সে বিয়ের পাগড়ী তারাগাহ পাহাড়ের চূড়ায় দর্শনীয় বস্তু। এ দু'টো দেখার জন্য পদব্রজে দীর্ঘ কষ্টকর পথ অতিক্রম করতে হয়। ১৯৮৫ সালে তারাগাহ পাহাড়ের চূড়ায় উঠে অবর্ণনীয় দৃশ্যাবলী দেখে বিস্মিত হয়েছি। সেসময়ে যাঁরা আজমীর শরীফের তারাগাহ পাহাড় সম্পর্কে জানেন তাঁরাও আমার পদব্রজে পাহাড় দর্শনের কথা শুনে চোখ কপালে তুলেছেন। "যৌবনে দাও রাজটীকা"। সপরিবারে সিঙ্গাপুরের সন্তোষা ডিজনীল্যান্ডে যাবার পর (১৯৯৯) ক্যাবল কারে উঠেছিলাম। এখন মনে হয় তারাগাহ পাহাড়ে যাবার জন্য যদি ক্যাবল কারের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে পা দুটো অপরিসীম কষ্ট থেকে রেহাই পেতো।

আজমীরের মানুষ বেশ সহনশীল। পুরানো ছেঁড়া টাকা দেখে কেউ বলে না পাল্টে দাও। ভাংতি বা খুচরা টাকার বেশ অভাব দেখেছি তখন। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে যেমন বিস্মিত হয়েছি তেমনি পাহাড় থেকে নামতে গিয়েও অবাক হয়েছি। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিরাজ্যে বিস্ময় সর্বত্র। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় বলেছেন - "যে বিস্মিত হতে জানে না, সে মৃত"। পাহাড় পরিবেষ্টিত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর মাজার, শহরটিও মাজারকেন্দ্রিক। জেনারেশন থেকে জেনারেশন চলছে খাদেম প্রথা। খাদেমদের পেশা জেয়ারতকারীদের সেবা দিয়ে অর্থোপার্জন। জেয়ারতকারীদের জন্যই দোকান পসরা সাজিয়ে বসেছে। শীত বস্র, সুয়েটার, নকশী করা শাল ইত্যাদি।

যে কয়দিন আজমীর ছিলাম প্রতিদিন ফজর নামাজের পর পরই খাজার মাজারের পা-এর কাছে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেছি। অবলোকন করেছি - কে কিভাবে অর্থ দান করছে ও জিয়ারত করে। খাজার মাজারে তাঁর পা-এর কাছে জেয়ারতকারী নতজানু হলে খাদেম খাজার পায়ের কাছে গিলাফ একটু উঠিয়ে জিয়ারতকারীর মাথা ঢেকে দেন। এরপর জিয়ারতকারী শ্রদ্ধায় - আবেগে নতজানু হয়ে খাজার পায়ে হাত রাখেন, চুমু দেন। খাদেম তাঁকে তাড়া দেন, কারণ অন্যরা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। খাদেম স্মরণ করিয় দেন - খাজাকে নজরানা দাও। জেয়ারতকারী মাথা তুলে উঠে আসার সময় খাজার পায়ের কাছে ছোট্ট গর্তে হাত মুঠি করে টাকা রাখেন। জেয়ারতকারীর নজরানার দেয় টাকা খাদেম সাহেব বা' হাতে গর্ত থেকে তুলে ডান হাতে নিয়ে নিজের পাঞ্জাবীর পকেটে রাখেন। এরপর জিয়ারতকারী স্থান পরিবর্তন করে মোনাজাত করেন। প্রতিদিন ভোরে দাঁড়িয়ে একই দৃশ্য দেখি। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে খাদেম আমার প্রতি সন্দিহান হন। রাগতস্বরে প্রশ্ন করেন - তুমি রোজ সকালে এসে এখানে দাঁড়িয়ে থাকো, কিন্তু নজরানা দাও না। কিঁউ? বাক্য ব্যয় না করে নীরবে সরে যাই। নেতৃত্বস্থানীয় খাদেমদের মধ্যে রোষ্টার লিষ্ট থাকে, কে কখন গদীতে বসে টাকা মুষ্ঠিবদ্ধ করে পকেটস্থ করবেন। আল্লাহ্ ছাড়া কোন পীর বা বুজুর্গ ব্যক্তির দরবার বা মাজারে নতজানু হওয়া যায় না।

প্রথম দিন আজমীর শরীফ পৌঁছার পর খাদেম তাঁর দলসহ আমাকে নিয়ে মাজার আঙ্গিনায় গোল হয়ে বসলেন। পরিচয় পর্বের পর খাদেম আমাকে বললেন - তুমি আমাকে দশ হাজার রূপি দাও, আমি বাবার দরবার গিলাফ চড়িয়ে দেই। বললাম - না, অতো টাকা তো দিতে পারবো না। আচ্ছা, তা'হলে পাঁচ হাজার রূপি দাও। না, সেটাও পারবো না। ঠিক আছে, দুই হাজার দাও। সে নাছোড়বান্দা, এজন্য আমি খাদেমকে বললাম - দেখো, আমি মাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করেছি। তেমন টাকা-কড়ি নিয়ে আসিনি। তুমিই বরং আমাকে এক হাজার রূপি লোন দাও, ঢাকা গেলে নিয়ে এসো। এবার সে আর একটি তীর ছুঁড়লো, বললো - ঠিক আছে, তুমি তাহলে দশ হাজার রূপির গিলাফ দেয়ার জন্য রাজি হয়ে যাও, ঢাকা গেলে আমি রূপিয়া নিয়ে আসবো। না, এটা পারবো না। তা'হলে কি করতে চাও? দশ রূপির বেশি পারবো না। দেখো, কিভাবে জিয়ারত করতে হয় আমি তা' জানি। ডালায় দশ রূপির গাঁদা ফুল নিয়ে অগত্যা আমার পিছু নিল তাঁর দল। মনে হলো, তাঁর রাগ সজারু হয়ে দলের পিছু নিয়েছে। দোকান থেকে তৈরী দশ হাজার রূপির গিলাফ মাজারে দিয়ে জিয়ারত করে চলে আসার পর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই খাদেম গিলাফটি মাজার থেকে তুলে সেটি আবার দোকানে ফেরৎ দিয়ে সাত-আট হাজার টাকায় ঐ দোকানেই গিলাফটি বিক্রী করবেন। জিয়ারতকারী এ বিষয়ে কখনোই কিছু জানবে না। প্রচলিত রয়েছে যে - খাজার দরবারে গেলে কেউ ফিরে না খালি হাতে। কোনো মৃত ব্যক্তির কোনো কিছুই দেবার ক্ষমতা নাই। একমাত্র নবীজীর (সাঃ) রওজা ব্যতীত আর কোনো বুজুর্গ ব্যক্তির মাজারে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাওয়া ইসলাম সম্মত না। জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা শরীফে নবীজীর (সাঃ) রওজার দিকে লক্ষ্য করে দাঁড়িয়েছি (২০০৪ সালে), সিকিউরিটি অফিসার বললেন - বডি টার্ণ করে দাঁড়াও। অর্থাৎ রওজার দিকে পিঠ থাকবে।

তারাগাহ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হলো - খাজা এ দেশে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসেন এবং তার মৃত্যুর পর তাঁকে কেন্দ্র করেই এ শহর গড়ে উঠেছে। আজ যদি মাজারটি এ স্থান থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় তা'হলে শহরটি কি মৃতপুরীতে পরিণত হবে? পাহাড়ের উচ্চতা ২৯৫০ ফুট। পদব্রজে পাহাড়ে উঠতে ও নামতে সময় লেগেছে ৫ ঘন্টা। আরেকটি দল পাহাড় দর্শনে গিয়েছিলেন। এ দলের এক ভদ্রলোক অসুস্থ থাকার কারণে পাহাড় থেকে নামার সময় পুরো পথটাই আমার কাঁধে ভর দিয়ে নেমেছেন। উপরে উঠার সময় দেখেছি তিনি বন্ধুদের সাহয্যে হাঁটার চেষ্টা করছেন। উপরে উঠতে কষ্ট বেশি, এজন্য সঙ্গী বদল করছেন বারবার। সমতল ভূমিতে আসার পর আপ্লুত হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন বেশ কয়েকবার।

জয়পুরে যাত্রাবিরতিতে দেখি জয়পুরের নয়নাভিরাম দৃশ্য। বাড়ির ছাদে ও সর্বত্রই ময়ূর দৃশ্যমান। ময়ূর দেখার পর চোখে ভেসে ওঠে ঢাকার কাক আর কাকের কর্কশ কন্ঠস্বর। সেইসাথে বেওয়ারিশ কুকুর এবং মধ্যরাতে ক্ষুধার্ত কুকুরের দলের গগনবিদারী ঘেউ ঘেউ শব্দে অমাবস্যার ঘন কালো রাত কিংবা জোৎস্নাস্নাত রাত ভেঙ্গে চুরমার হয় রাজপথে। কানাডায় রয়েছে শব্দহীন, নিভৃতচারী কাঠবিড়ালী ও কবুতর। স্থানভেদে প্রকৃতিতে রয়েছে কি এক বৈপরীত্য।

বাদশাহ শাহজাহান তাজমহল তৈরীর পর মাজারের পাশে পাথর দিয়ে একটি মসজিদ নির্মান করেছেন। পাথরে রয়েছে ফুলের কারুকাজ। বুদ্ধদেব বসু বলেছেন - "ভালো কবিতা যেমন বুঝা যায় না এবং বুঝানোও যায় না। এটি সম্পূর্ণ উপলব্ধির ব্যাপার মাত্র"। ভ্রমণযাত্রাও তেমনি, ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিখে হৃদয়গ্রাহী করার জন্য কলমের ও একইসাথে লেখকের দক্ষতা প্রয়োজন। মনে পড়ে সৈয়দ মুজতবা আলী'র "বিদেশ যাত্রা" ও আবদুল হাই - এর "বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন" এর কথা। ভ্রমণের তথ্য-উপাত্ত লিখে রাখলে বা নোট রাখলে এক ডজন দেশ ভ্রমণের গল্প লেখা যেতো। ১৯৮০ সাল থেকে নেশায় মত্ত হয়ে শুধুই ভ্রমণ করেছি, হায় হতোস্মি!

সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন - "বই পড়লে বা ভ্রমণ করলে মাছির মত চোখ গজায়"। তিনি অন্যত্র আবার বলেছেন - ভ্রমণের জন্য স্বাস্থ্য, সময় ও অর্থের প্রয়োজন। তাই স্বল্প বাজেটে বই-ই উত্তম। ভ্রমণে যাত্রা নাস্তি। ট্রেনে ফেরার সময় এক ভদ্রলোক বললেন - " হিন্দুস্থান এক আজিব দেশ হ্যায়, ক্যায়া খুউব সুরুত হ্যায়। ট্রেন প্লেন ক্যা তরফ হ্যায়, খানা ভি মিলেগা, বহুত আচ্ছি হ্যায়। খোদা ক্যা শুকরিয়া।

6
$ 0.05
$ 0.05 from @Eshan2742
Sponsors of LittleBird
empty
empty
empty
Avatar for LittleBird
3 years ago

Comments

অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ।আমিও সহমত প্রকাশ করি আপনার সাথে কারণ গত ২০১৭ সালে আমি যখন লাস্ট বার আজমির গেছি আমি প্রতিবারই উপলব্ধি করতে পারি।আজমিরী যখন দরগায়ও তারাগাহ পাহার দেখে মনটা শান্ত হয়ে যাবে। না বলে এত টাকা লাগবে।আমার বাসায় থাকো আমার এরিয়া থাক, যা পারো খাও এটা আল্লাহর দান খেয়ে যাও দলবেঁধে জিয়ারত করার একটা প্রশান্তি আসলো।এটার তুলনা নেই।আজমির যাওয়া আসার পথে আশেপাশে বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর স্থান আমিও দর্শণ করেছি।আপনি বলেছেন না বই পড়লে ভ্রমণ করলে মাছের চোখের মত চোখ গজায় আসলে দর্শন করার ভালো ভ্রমণে মন শান্তি অফুরন্ত শক্তি আহরণ করা যায় আপনাকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ এমন একটি পোস্ট আমাদের সাথে ভাগাভাগি করার জন্য আশা করি পরবর্তীতে এমন আরও অনেক পোষ্ট আপনি আমাদের সাথে ভাগাভাগি করবেন ধন্যবাদ।

$ 0.00
3 years ago

অবশ্যই এমন আরও গল্প পোস্ট করবো আপু যদি আপনাদের ভালো লাগে৷ অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে গল্পটি পড়ার জন্য৷

$ 0.00
3 years ago