এরোলা (১)

0 12
Avatar for LittleBird
3 years ago

ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলাম আমার দেহের চামড়া কুঁচকে আছে, সম্পূর্ণ দেহ বৃদ্ধ লোকদের মতন জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে, নড়াচড়া করার পর্যাপ্ত শক্তিটুক পাচ্ছি না। কী অদ্ভুত ব্যাপার! অথচ কাল আমার বিয়ে! এই অবস্থায় বিয়ে করবো কীভাবে? আমার এই অবস্থা হলো কী করে? থমকে গিয়ে চারপাশ মাথা ঘুরিয়ে দেখছি আর ভাবছি। আশেপাশে কেউ নেই। পাশে একটি ইলেকট্রিক যন্ত্র দৃষ্টিগোচর হলো, মেশিনের ডিসপ্লেতে লাইটগুলো এলোমেলো ভাবে অবিরত জ্বলছে নিভছে। মেশিন থেকে দুটো পাইপ এসে আমার পায়ের গোড়ালি দিয়ে ঢুকে গিয়েছে। থেমে থেমে কম্পন তুলে কিছু তরল পদার্থ শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। পাইপ দুটো কোন পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে সঠিক বুঝতে পারছি না। দেহ অসার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে আমি প্রচন্ড রকমের অসুস্থ অবস্থায় আছি। কিছুক্ষণ বাদে এক বাচ্চা মেয়ে আমার রুমে প্রবেশ করলো। হাতে টেডি বিয়ার ঝুলানো, পড়নে ফ্রক টাইপের কিছু একটা হবে, দেখে মনে হচ্ছে শোকেসে সাজিয়ে রাখা বাচ্চা পুতুল হেঁটে হেঁটে রুমে চলে এসেছে। আমার নড়াচড়া দেখে সে থমকে যায়। কয়েক সেকেন্ড চোখেচোখ পড়তেই সে আম্মি... বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।

 

কে এই বাচ্চা সঠিক চিনতে পারলাম না। কিছুক্ষণ বাদে হুলস্থুল হয়ে কয়েকজন লোকের এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেলাম। রুমের দরজা খুলে যুবতী বয়সী একটি মেয়ে খুব একসাইটেড অবস্থায় আমার বেডের কাছে ছুটে এলো। পরনে এপ্রোন দেখে ডাক্তার নার্স এরকম কিছু একটা ভেবে নিয়েছিলাম পরে বুঝতে পারলাম মেয়েটির গায়ে কিচেন এপ্রোন জড়ানো। গা থেকে মসলার ঝাঁজালো গন্ধ নাকে এসে লাগছে। মনে হচ্ছে উনি এতক্ষণ রান্নাঘরে ছিলেন। বাচ্চার ডাকে এক দৌড়ে রান্না রেখে ছুটে এসেছেন।

আমার কাছে দাঁড়িয়ে বিনম্র স্বরে বলছেন.. "বাবা আপনি ঠিক আছেন? আমাদের কথা ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছেন?" আমি মাথাটা উপর নিচ নাড়লাম। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটির দিকে.. চেনা পরিচিত মুখ অথচ কতটা অচেনা। মনে মনে ভেবে গেলাম.. কে এই মেয়ে?! আমাকে বাবা ডাকছে কেন? আমি বিছানায় পড়ে আছি কেন? প্রশ্নগুলো মনের মাঝে চেপে রেখেদিলাম। এলোমেলো প্রশ্ন ছোড়ার থেকে পরিবেশ বুঝে নেওয়াটা জরুরী। মাথার ভেতর খুব শীতল অনুভব হচ্ছে। ম্যানথল ফ্লেভারের কিছু খেলে যেমন ঝাঁজালো ঠান্ডা অনুভূত হয় অনেকটা ঠিক তেমন। শুধু সামান্য একটু ঘারে জ্বালাপোড়া করছে।

 

মেয়েটা তার পাশে থাকা গৃহকর্মীকে বললো "সাজ্জাদ দ্রুত ডাক্তারকে বাসায় আসতে বলো" আদেশ পেয়ে ছেলেটা হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেন ছুটে গেল। এরপর মেয়েটা তার হাতে থাকা আংটি থেকে কিছু একটা খুলে কানে লাগিয়ে কথা বলা শুরু করে দিল। মেয়েটা ব্যস্ত হয়ে কাকে যেন বলছেন.. "হ্যালো.. কই তুমি? দ্রুত বাসায় আসো, বাবার জ্ঞান ফিরেছে"

কথা বলতে বলতে মেয়েটি রুম থেকে বাহিরে চলে গেল।

 

রুমে এই মুহূর্তে আমি আর সেই বাচ্চা মেয়েটি রয়েছি। বাচ্চাটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। একপর্যায়ে কাছে এগিয়ে এসে খুব নমনীয় গলায় আমাকে প্রশ্ন করছে.. "দাদাই সত্যিই কি তুমি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছো?" আমি আবারও মাথা নাড়লাম। "দাদাই তুমি এখন আগের মতো কথা বলতে পারবে? আমাকে আবার গল্প শোনাতে পারবে?"

আমি বাচ্চাটিকে চিনতে পারছিলাম না তবুও তাল মিলিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ, খুব কষ্ট হচ্ছিলো উত্তর দিতে তবুও মুখ ফোটে বাচ্চাকে উত্তর দিলাম "হ্যাঁ পারবো"

বাচ্চার এসব প্রশ্ন শুনে বাচ্চার মা তাকে ধমক দিয়ে রুম থেকে নিয়ে যায়, যেতে যেতে বলতে থাকে.. দাদা ভাইকে এভাবে জ্বালাতন করবে না, তোমার দাদাই এখনো অনেক অসুস্থ, উনাকে রেস্ট নিতে দাও। কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম এরা সবাই আমাকে চেনে, খুব আপনজন অথচ আমি কাউকে চিনতে পারছি না। তবে কি আমার স্মৃতি শক্তি হারিয়ে গেল! কিন্তু... এমন কিছু হলেতো আমি সবকিছুই ভুলে যেতাম, তা তো যাইনি, আমার স্পষ্ট মনে আছে কাল আমার বিয়ে। আমি কিছুক্ষণ আগে সেলুন থেকে চুল কাটিয়ে এসেছি। এরপর যেন কি হল? নাহ, কিছুতেই মনে পড়ছে না৷ কোত্থেকে কি হচ্ছে হিসেব মেলাতে পারছি না। চুল কাটিয়েছি মনে পড়তেই মাথায় হাত বুলালাম, আবিষ্কার করলাম আমার মাথার ঝাকড়া চুলগুলো আর নেই! তৎক্ষণাৎ মুখ গাল হাতিয়ে শিওর হলাম আমি সত্যিই আর আগের মতো নেই, আমার সবকিছুতেই অস্বাভাবিক পরিবর্তন। আবিষ্কার করলাম এমুহূর্তে নিজের পুরো দেহ পরিপূর্ণ এক বৃদ্ধের রূপধারণ করে আছে!

 

পাশে থাকা ডেস্ক হাতরে আমার মেডিকেল ফাইলটা খুঁজে পেলাম। মলাটে চাইনিজ ভাষায় কত রঙে ঢঙে কি সব লেখা বুঝতে পারলাম না। পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে ইংলিশ অক্ষর খুঁজে পেলাম। সেখানে লিখা শিয়ান চি হোম ক্যাবিনেট হসপিটাল, চায়না। অর্থাৎ এই মুহূর্তে আমি চায়নাতে অবস্থান করছি। ফাইল থেকে রোগীর বিবরণী পাতা খুঁজে নিলাম। সেখানে নাম দেখতে পেলাম। বয়সের স্থানে সংখ্যার দিকে স্থীর চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আমার ৮০ বছর কীভাবে হয়ে গেল কিছুতেই বুঝে আসছে না! তারিখের দিকে চোখ বুলালাম, এখন ২০৭২ সাল! আমার হিসেবে এখন ২০২০ থাকাটা স্বাভাবিক ছিল, এখন আমার বয়স হওয়ার কথা ছিল ২৮ বছর। ২০৭২-২০২০ বিয়োগ করে ব্যবধান চলে এল ৫২ বছরের। এদিকে কাগজে বয়স লিখা রয়েছে ৮০। তাহলে ৮০ থেকে ৫২ বিয়োগ করে পেলাম ২৮। অর্থাৎ ২০২০ সালে আমার বয়স আসলেই ২৮ ছিল, হিসেব একদম পরিষ্কার। সালের সাথে বয়সের হিসেবটা স্বাভাবিক হারে এগিয়েছে। শুধু মাঝের ৫২ বছর আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। এই বাহান্ন বছর কি হয়েছে কিছুই মনে করতে পারছি না। আমার চিন্তাশক্তি সমস্ত কিছু আটাশ বছরের মধ্যে আটকে আছে। শুধু যে চিন্তাশক্তি আটাশে আটকে আছে তা নয়, এতক্ষণে হিসেব কষে এটাও বুঝলাম মস্তিষ্ক কর্মদক্ষতাও আগের মত ঠিকঠাক রয়েছে। এত লম্বা হিসাব নিকাশে হাতের কর গণনার প্রয়োজন হয়নি, মুহূর্তেই কয়েক সেকেন্ডে বের করে ফেললাম। অবশ্যই আশি বছরের কোন বৃদ্ধের দ্বারা এত দ্রুত কয়েক সেকেন্ডে ক্যালকুলেশন সম্ভব হতো না। ফাইল হাতিয়ে বুঝতে পারলাম এক মাস ধরে আমি অসুস্থ অবস্থায় আছি। এত বছর মোটেও ঘুমিয়ে কাটাইনি। আশেপাশে সকলেই আমার আপনজন। এদের সবাইকে আমি অনেক দেখেছি, এদের সাথে আমার নিয়মিত উঠাবসা হয়েছে, শুধু কাউকে চিনতে পারছি না। সর্বশেষ আমি বিছানায় পড়েছি কীভাবে জানার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠলো। কেউ মনে করিয়ে দিলে ধীরে ধীরে হয়ত সব মনে পড়ে যাবে, সেই আশায় মনকে শান্ত করে রাখলাম।

 

রুমে যুবক বয়সী এক লোক প্রবেশ করলেন। পড়নে সুট প্যান্ট। সম্ভবত মেয়েটি যাকে কল দিয়েছিল তিনি চলে এসেছেন। লোকটিকে চিনে নিতে খুব বেশি কষ্ট হল না। লোকটির অবয়ব দেহাবরণ আপনা আপনি জানান দিচ্ছে সে আমারই দেহাংশ, আমারই রক্তের সন্তান। তার চেহারাতে আমি যুবক বয়সী নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি। পিতার চোখ কখনো সন্তান চিনতে ভুল করে না। সে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছে..

– বাবা ঠিক আছো তুমি? কেমন লাগছে এখন?

– হুম ভালো

– হাত পা নাড়াতে পারো?

– হুম

– কোনো অসুবিধা লাগছে? এসি বাড়িয়ে দেব?

– না। আচ্ছা শোনো, কী নাম যেন তোমার?

– একি বলছো বাবা, আমাকে চিনতে পারোনি?

– চিনেছি তবে কিছু মনে করতে পারছি না

– বাবা আমি আফনান

– আচ্ছা, আমি কয়দিন ধরে বিছানাতে পড়ে আছি?

– প্রায় এক মাস তো হবেই

– তার আগে আমি ঠিক ছিলাম? কোনো সমস্যা ছিল আমার? স্মৃতিভ্রম এমন কিছু?

– না বাবা, তুমি সুস্থই ছিলে। হুট করে সেদিন সকালে তুমি চিৎকার দিয়ে উঠলে। এসে দেখি বিছানায় কাতরাচ্ছ। এরপর আর উঠে দাড়াতে পারনি। কাশতে কাশতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে। হসপিটালের ডাক্তাররা দুইরাত আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা চালালো তোমার। পরে উনারা জানিয়েছেন ক্রিটিকাল প্যারালাইজড। অবস্থা অত্যন্ত জটিল। সুস্থ হওয়া অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যপার। তাই হসপিটাল থেকে সপ্তাহ খানিক আগে তোমাকে বাসায় আনা হয়েছে। এখানে হোম সার্ভিসে তারা নিবিড় চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। বাবা তোমার কি কিছুই মনে পড়ছে না?

আমি অস্বীকার করে গেলাম। শুধু বললাম মনে করতে একটু সমস্যা হচ্ছে। আমি যে সব ভুলে পুরনো অবস্থায় ঠেকে আছি, কাল আমার বিয়ে হওয়ার কথা, আমি মাত্রই একটু ঘুম থেকে উঠেছি, আমার চিন্তাশক্তি সমস্তকিছু ঠেকে আছে আটাশ বছরে এসব বিস্তারিত তার সাথে কিছুই শেয়ার করলাম না। কোনোকিছু জানানোর পূর্বে নিজে কী অবস্থানে রয়েছি তা বুঝে নেওয়াটা জরুরী।

 

ছেলেকে পাশে বসিয়ে একেরপর এক প্রশ্ন করে গেলাম। প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছিল, এত বড় সিনিয়ন মানুষকে আমি তুমি করে বলছি, এই ভারীসারি লোকটি আমার সন্তান, মেনে নিতে অনেক অস্বস্তি লাগছে, কী অদ্ভুত! নিজেকে সামলে ছেলেকে পাশে বসালাম। নিজের মাঝে বড় বড় ভাব নিয়ে একেরপর এক প্রশ্ন করে গেলাম।

বিস্তারিত উত্তর শুনে জানতে পারলাম আমি এখন চীনের একটি শহরে আছি। ছেলে সবাইকে নিয়ে এখানেই বসবাস করে। পরিবারে সদস্য বলতে ছেলে, ছেলের বউ, তাদের এক মেয়ে এবং আমি। অর্থাৎ বাচ্চা মেয়েটি আমার নাতনী। এই কয়জন ছাড়া পরিবারে আর কেউ নেই। আমরা বাংলাদেশ ছেড়েছি তাও বিশ বছর হয়ে গিয়েছে। দুই তিন বছরে একবার করে দেশে ঘুরতে যাই। আমার পেশা ছিল একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকতা বেছে নিলাম আমি কোন দুঃখে নিজেও জানি না। আমার জানামতে আমি টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছি, ছোটবেলা থেকে এসবের দিকে তীব্র ঝোক ছিলো। লেখালেখি সাহিত্য এসবের ধারের কাছেও ঘেঁষে দেখিনি। উপন্যাস বই পড়া ছিল আমার সবচেয়ে বড় ধৈর্যের পরীক্ষা। এখনো মনে আছে পাঠ্যপুস্তকে হাজার বছর ধরে, পদ্মা নদীর মাঝি এসব উপন্যাস পড়তে কষ্ট হতো বলে উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করা সিনেমাগুলো দেখে পরীক্ষার কাজ চালিয়ে দিতাম। সেই ছেলেটির হঠাৎ লেখালিখির দিকে ঝুঁকে যাওয়াটা চারটি খানি কথা না। যে ছেলের দিন রাত কেটে যেত ল্যাপটপে কোডিং করতে করতে সেই ছেলে নাকি পরবর্তীতে হয়েছে সাংবাদিক! আরও স্তব্ধ হয়েছি যখন শুনলাম আমার নাকি বেশ কয়েকটা উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে! এসব লেখালেখিতে ঢুকলাম কিভাবে মাথায় খেলছে না।

 

ছেলে সম্পর্কের এই ভদ্র লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম.. আমি পড়াশোনা কোথায় করেছি বলতে পারবে? উত্তর মিলিয়ে নিলাম তথ্য একদম ঠিকঠাক রয়েছে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করা। কীভাবে লেখালেখি পেশায় প্রবেশ করেছি জানো কিছু? ছেলে কিছুই বলতে পারলো না। তার না জানাটাই স্বাভাবিক, তখন তার জন্মই হয়নি। মনে প্রশ্ন আসলো, ছেলের মা তবে কে? যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সেই মেয়েটেই কি! তাকে কি আমি পরেরদিন বিয়ে করেছিলাম? সবকিছু একবাক্যে জানতে ভেতরটা ছটফট করছে। আমার স্ত্রীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে বসলাম। ছেলে আওয়াজ নিচু করে বললো মা তো অনেক আগেই... এটুক বলে থেমে গেল। কিভাবে কি হয়েছে জানতে চাইলে ছেলে কথা ঘুরিয়ে বলে উঠলো.. "সব পরে জানা যাবে এখন রেস্ট নাও" ছেলের বউ টপিক ঘুরাতে আলাপ জুড়িয়ে দিল.. "বাবা আজ কী রান্না করবো? আপনার কী খেতে মন চাচ্ছে বলুন? চিংড়ি মাছ ভেজে দেব? না-কি সুপ?"

 

অনেক কিছু জানার আছে, এক মুহূর্তে বারবার এত প্রশ্ন করার এনার্জি পাচ্ছিলাম না। নিজেও বুঝলাম আমার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। মনের লাগাম টেনে ধরলাম, নিজেকে স্বাভাবিক রাখলাম। এদিকে খবর পেয়ে এতক্ষণে বড় ডাক্তার চলে এসেছেন।

 

ডাক্তারের বেশভূষায় বেশ পরিবর্তন। সচারাচর দেখতে পাওয়া গলায় ঝুলানো স্টেথোস্কোপ আর নেই। হাতে আধুনিক ইলেক্ট্রিক গ্লাভস। আমার সাথে তিনি ভালোমন্দ কেমন লাগছে ইংলিশে কথা বলতে বলতে গ্লাভস দেহের বিভিন্ন অংশে স্পর্শ করে পর্যবেক্ষণ করছেন। কাজ শেষে ছেলেকে বলছেন দুশ্চিন্তার কিছু নেই, ব্লাড সার্কুলেশন হার্টবিট সব স্বাভাবিক আছে। দেহ দুর্বল আশাকরা যায় কিছুদিন ঘুমিয়ে উঠলে ঠিক হয়ে যাবে। স্মৃতি শক্তির ব্যাপারে আপাতত বলা যাচ্ছে না। উই হোপ এভরিথিং গোজ ওয়েল। ডাক্তার সহকারীকে নল দুটি খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে চলে গেলেন।

 

পরেরদিন যন্ত্র থেকে দেহ মুক্ত হবার পর শরীর কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠলো। উঠে দাঁড়িয়ে ধীরেসুস্থে হাঁটাচলা শুরু করলাম। সব ঠিকঠাক রয়েছে। রুম থেকে বের হয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়ালাম। বিশাল বড় ডুপ্লেক্স ফ্লাট। হেঁটে হেঁটে অনেকটাই ক্লান্ত। ব্যালকনিতে পেতে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লাম। এমুহূর্তে আমি ৯৫ তম ফ্লোরে ব্যালকনিতে বসে আছি৷ গ্লাস ভেদ করে গোটা শহরের দিকে তাকিয়ে আছি, কী অপূর্ব দৃশ্য! পুরো শহরটা যেন হাতের মুঠোয়। চায়না এখন পুরো বিশ্বের রাজত্ব হাতিয়ে নিয়েছে। সুউচ্চ ভবন ব্যতীত চোখে খালি যায়গা ধরা দিচ্ছে না। এত জনসংখ্যা সামাল দিতে এই ভবন গুলো তাদের জায়গা সংকট দূর করে নিয়েছে। শুধু তাই নয় বাহিরের দেশের লোকেরাও এখন চায়নাতে ভীড় জমাতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বৌমার মুখে জানতে পারলাম বেইজিং এখন বিশ্ব দরবারে স্বপ্ন রাজ্য। এখানে স্থায়ী বসবাসের ভিসা পেতে যোগ্যতার পাশাপাশি অনেক ভাগ্যের প্রয়োজন। আমার ছেলেও ভাগ্যবানদের মাঝে একজন। একটি চায়না কোম্পানিতে উচ্চপদে কর্মরত থাকার দরুন খুব সহজেই দেশটিতে জায়গা করে নিয়েছে।

 

আমি বাহিরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি৷ প্রথমত আটাশ বছর থাকাকালীন কোনো উন্নত দেশ কাছ থেকে দেখার ভাগ্য হয়নি, সেই উন্নত দেশ বাহান্ন বছর পেরিয়ে কতটা উন্নত পর্যায়ে ঠেকেছে যা দেখতে এখন নিজের কাছে ভিনগ্রহের রাজ্য মনে হচ্ছে। কিছু কিছু বাস্তব দৃশ্য হলিউড মুভি গুলোকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। আমিও আজ সৌভাগ্যবানদের মাঝে একজন। এই শহরে বহু বছর থেকেছি, কতকিছু ঘুরেছি, শুধু মনে না থাকায় প্রতিটি জিনিস বারবার অবাক করে দিচ্ছে। যেসব কাজগুলো অভ্যাসগত ভাবে মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছে সেগুলো ঠিকই করতে পারছি। এই যেমন ওয়াশরুম কোনদিকে আপনাআপনি চলে যাচ্ছি, ডিজিটাল দরজা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, কিভাবে লক করতে হয়, বিভিন্ন সুইচ কিভাবে ব্যবহার করতে হয় আপনা আপনি সেগুলো অভ্যস্ততার জন্য একাই করতে পারছি। এসব ছাড়া বাকি সবকিছুই আমার কাছে নতুন।

 

ব্যালকনিতে কিছুক্ষণের মধ্যে আমার নাতনী এসে হাজির। দুজন মিলে খোশগল্পে মেতে উঠলাম। নাতনীর নাম শুনে অবাক হলাম, তারা এই ফুটফুটে স্মার্ট বাচ্চাটির নাম রেখেছে হামিদা! তারা কি আর কোনো নাম খুঁজে পেল না? এই নামতো আমার দাদি নানির আমলের নাম। আসলে নাম কোনোদিন পুরনো হয় না একই নাম যুগের সাথে ঘুরেফিরে নতুন রূপে বারবার চলে আসে। এই জেনারেশনে আদিম কালের নাম গুলোই এখন স্মার্ট নেইম, ব্যবহার না থাকায় পুরনো নামগুলোই তাদের কাছে এখন ইউনিক রূপে ধরা দিয়েছে। হামিদা নামের আমার এক শিক্ষিকা ছিলেন, প্রচন্ড বদমেজাজি, নাম শুনলেই তার চোখ রাঙানো চোখদুটো ভেসে উঠে। এই ফুটফুটে বাচ্চাকে আমি কখনোই এই নামে ডাকতে পারব না। হামিদাকে হামি বলে ডেকে বললাম আমি তোমাকে আজ থেকে হামি বলে ডাকবো, ঠিক আছে?

বাচ্চাটি হি হি করে হেসে দিয়ে বলে "দাদাই তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ? তুমিতো আমাকে হামি বলেই ডাকো! হিহি, আর তুমি এভাবে তুমি তুমি করছো কেন? তোমার মুখে তুই শুনতেই বেশি ভাল্লাগে"

ওহ ডিয়ার, সরি, হ্যা তাইতো, আমিতো হামি বলেই ডাকি, তোর দাদাই সত্যিই পাগল হয়ে গেছে সব ভুলে যায় বারবার।

হিহিহি

 

এভাবে দুজন বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম। গল্পের ছলে জিজ্ঞেস করলাম তোর দাদীকে দেখেছিস?

– কোন দাদী?

– মানে তোর গ্রান্ডমাদার, আমার ওয়াইফ, দেখেছিস তাকে?

– ওহ দাদীমা! নাহ বাস্তবে পাইনি তাকে, ছবিতে দেখেছি, সে তো অনেক আগেই চলে গিয়েছে, আমার বাবা যখন ছোট ছিল তখন দাদীমা হারিয়ে যায়।

– কীভাবে মারা যায় তুই জানিস কিছু?

– এমা, মারা যায়নি তো, হারিয়ে গেছে, কীভাবে হারিয়ে যায় বাবা বলে না আমাকে, শুধু বলে ছোটদের এতকিছু জানতে নেই

– আচ্ছা হামি শোন, তোর দাদীমার ছবি আছে তোর কাছে?

– হ্যাঁ আছে

– দেখাতে পারবি

– কিন্তু দাদাই আম্মি শুনলে বকবে যে, আম্মি আমাকে তোমার সাথে দাদীমা নিয়ে কথা বলতে বারণ করেছে, বলেছে এসব বললে তুমি আবার অসুস্থ হয়ে যাবা

– না রে, আমি ঠিক আছি, তুই একবার তোর দাদীমার ছবি দেখা আমাকে, কেউ জানবে না, তোকে আমি রাতে গল্প শোনাবো অনেক। প্লিজ

– প্রমিজ?

– হ্যাঁ প্রমিজ

 

হামি ট্যাব থেকে কিছু ছবি বের করে দিল। আমি ট্যাব হাতে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছি। নিশিকে দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত আমি তাকেই বিয়ে করেছি যার সাথে কাল আমার বিয়ে হওয়ার কথা। ছয় বছর প্রেমের সম্পর্কের পর পারিবারিক নানান ঝামেলা পেরিয়ে অবশেষে আমি নিশিকে আপন করে পেয়েছিলাম, সংসার সাজিয়েছিলাম, কত সুখ দুঃখের মুহূর্ত কাটিয়েছি অথচ কিছুই মনে করতে পারছি না৷ প্রিয় মানুষের প্রিয় মুহূর্ত সরণ করতে না পারা কতটা যন্ত্রণার বলে বুঝানো সম্ভব না। কি হয়েছিল আমার নিশির? কেউ কিছু কেন বলছে না। যেভাবেই হোক নিশির অধ্যায়টুক আমাকে স্বরণ করতেই হবে।

 

হামি নিশিকে নিয়ে তেমন কিছু জানে না, তাকে আর এই বিষয়ে প্রশ্ন করলাম না। তার কাছ থেকে অন্যান্য অনেক অজানা তথ্য জেনে নিলাম যেগুলো আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমি কি কি করতাম, তাকে কি কি বলতাম, আমার কি কি ঘটনা সে জানে ইত্যাদি। দেশে দাদু বাড়িতে কয়বার গিয়েছে, সেখানে কে কে আছে বিস্তারিত জেনে নিলাম। বেঁচে থাকার মতো আমার আপনজন কেউ নেই শুধু ছোট বোনটা বেঁচে আছে। আমরা পিঠাপিঠি ছিলাম, বোন আমার বয়সে তিন বছরের ছোট। তবে সে এখন প্রচন্ড অসুস্থ, কানে শোনার ক্ষমতা দশ বছর আগেই হারিয়ে ফেলেছে। মেসিন লাগিয়ে যতটুকু শুনতে পায় সেটা দিয়ে কোনমতে দিন পার হয়ে যাচ্ছে। আমার কাছেতো মনে হচ্ছে এই তো দুদিন আগেই বোন আমাকে নিয়ে শপিংয়ে গেল, আমার বিয়ের কেনাকাটা করে দিল। দুজন ফুলের অর্ডার দিয়ে এলাম। নিশির টকটকে লাল জারবেরা খুব পছন্দের ছিলো। সেদিন শাহবাগ থেকে কাঁটাবন কোত্থাও লাল জারবেরা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পুরো শহর ঘুরে দুই ভাইবোন অনেক কষ্ট করে সেদিন জারবেরা সংগ্রহ করি। এরপর আর মনে নেই। চট করে মাথায় এলো আমার বোন নিশ্চয়ই জানে এরপর কি ঘটেছিল আমার সাথে!

 

সেই রাতে এসব পুরোনো স্মৃতি মনে করতে করতে ঘুমিয়ে যাই। আমি ঘুমের মাঝে এলোমেলো স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। দেখতে পেলাম সবাই মিষ্টিবিলি করছে, দেশের বাড়িতে লাইটিং করা হয়েছে, সবার মাঝেই আমোদ ফুর্তি বিরাজমান। স্বপ্নের মাঝেও উপলব্ধি করছি কাল আমার বিয়ে। আমি কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছি, স্থানীয় এক সেলুনে চুল কাটাচ্ছি, বরাবরের মতো কমবয়সী রাজন নামের ছেলেটা আমার চুল কেটে দিচ্ছে। ট্রিমারের ভাইব্রেশনে সম্পূর্ণ মাথা কাঁপছে, ভো ভো শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। এতটা তীব্র শব্দে মাথা ধরে গিয়েছে। ইয়ারফোন ছুড়ে ফেলে রাজনকে বলি এক্ষুণি ট্রিমার থামা, মাথা ধরে গেছে৷ রাজন মাথা এগিয়ে জিজ্ঞেস করলো স্যার মাথাটা মালিশ কইরা দেই? হ্যাঁ না কিছু বলার আগেই তার শীতল হাত দুটো আমার ঘার চেপে ধরলো। এরপর সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। আমি চিৎকার করে বলি,, কি রে লাইট বন্ধ করলো কে, লাইট জ্বালা, এই রাজন... এই ছেমড়া তুই গেলে কই। রাজন কথা শুনছে না, মাথাটা চেপে ধরে আছে, আমি বারবার চিৎকার করতে থাকি.. লাইট জ্বালিয়ে দে।

 

টুপ করে রুমের লাইট জ্বলে উঠলো। ছেলে ও বৌমা দু'জন ছুটে এসেছে। বাবা কি হয়েছে?? আমার ঘুম ভেঙে যায়। এতক্ষণ স্বপ্নের মাঝে ছিলাম, পানি খেয়ে নিজেকে ঠিক করে নিলাম। দুঃস্বপ্ন বলে এড়িয়ে গেলাম। আমাকে পানি পান করিয়ে তারা তাদের রুমে ফিরে গেল। দুঃস্বপ্ন হলেও এর সাথে যে অনেককিছু জড়িয়ে আছে বুঝতে বাকি রইলো না। আমার স্মৃতিশক্তি এখানেই সীমাবদ্ধ। ঠিক পরমুহূর্তের ঘটনা একমাত্র আমার বোন বলতে পারবে। আমার কি হয়েছিল তার বিস্তারিত বর্ণনা আমার বোন অবশ্যই দিতে পারবে। কেন আমার স্মৃতি বিয়ের আগের রাত পর্যন্ত থেমে আছে। এরপর বাসায় ফিরে কি হয়েছিল যারা চাক্ষুষ দেখেছে তাদের থেকে অবশ্যই কিছুনা কিছু জানা যাবে। আমি তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম আমি দেশে যাবো, আমাকে শিকড়ে ফিরে যেতে হবে, খুব দ্রুত যেতে হবে।

 

চলবে.....

Sponsors of LittleBird
empty
empty
empty

@TheRandomRewarder

2
$ 0.00
Sponsors of LittleBird
empty
empty
empty
Avatar for LittleBird
3 years ago

Comments