শিলা পর পর কয়েকবার ডোরবেল বাজাল। দরজা খুলল রোদেলার বাবা। উনি পুলিসে চাকরি করেন। সাধারনত বিকেলের এই সময়টা উনি বাসায় থাকেন না। কিন্তু আজ বাসায়। বোধহয় ঘুমিয়ে ছিলেন। খালি গা'য়ে ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠে এসেছেন । কালো মোটা শরীর বড় বড় লোমে ঢাকা। হটাত দেখলে কেমন গরিলা গরিলা লাগে।
শিলা খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করল। সালাম দিয়ে বলল, "রোদেলা নেই?"
"ও গেছে ওর খালাত বোনের বার্থডে অনুষ্ঠানে।"
" ও আচ্ছা। আপা নেই?"
"না, ও রোদেলার সাথে গেছে।"
খানিকটা দ্ধিধাদন্ধে নিয়ে শিলা বলল,"তাহলে আজ বরঞ্চ আমি আসি.."
" একটু অপেক্ষা করতে পারেন। ওরা বোধহয় এখনি চলে আসবে।"
ঠিক তখনি হাত ব্যাগে শিলার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। মোবাইল নিতেই দেখল রোদেলার আম্মুর ফোন।
ওপাশ থেকে বলল, "হ্যা শিলা হটাত করে বোনের বাচ্চার জন্মদিনে চলে এসেছি। তুমি একটু বসো।পরশু দিন রোদেলার অংক পরীক্ষা কীনা তাড়াতাড়ি চলে আসব।"
ততোক্ষনে রোদেলার বাবা ভিতরে গেছেন।
শিলা নিরুপায় হয়ে বসবার ঘরটায় বসলো। দুই রুমের ফ্লাট। এই ঘরের সব কিছু তার পরিচিত। এক সেট সেগুন কাঠের সোফা। পশ্চিম কোনায় রোদেলার পড়ার টেবিল। সাথে দুটো চেয়ার। টেবিল ঘেসা দেয়ালটার উচুতে একটা দেয়াল ঘড়ি। ঘরের দুই দেয়ালে দুটো ক্যালেন্ডার ঝুলছে।
রোদেলা এবার ক্লাস সেভেনে পড়ে । বিকেলের এই সময়টা সে রোদেলাকে পড়াতে আসে।
রোদেলার বাবা হটাত আবার ঘরে ঢুকলো। এবার গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। শিলার সামনের সোফাটায় বসলো। বললেন,
"রোদেলার মাকে এত করে বললাম,পরশুদিন মেয়ের অংক পরীক্ষা - জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাওয়া বাদ দাও। কিন্ত ও কিছুতেই শুনল না। আমার আবার মেয়েছেলেদের সাথে ঝগড়া ফ্যাসাদ করা একদম পছন্দ না।"
শিলা ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। কেবল সৌজন্যতার হাসি মুখে ঝুলিয়ে রাখল।
"আপনি যেন কিসে পড়েন?"
"জ্বি অনার্স ফাইনাল ইয়ারে।"
"গুড।.. বিয়েথা মনে হয়নি?"
" জ্বি.. জ্বি না।"
"সেটাই বরং ভাল। সংসার ধর্ম মানেই হচ্ছে একটা বিরাট যুদ্ধ। মন না চাইলেও একটা মানুষের সাথে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে হবে। তার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে প্রায়রিটি দিতে হবে। কমপ্লিটলি ডিসগাস্টিং।..কি আশ্চর্য আপনাকে এতক্ষন খালি মুখে বসিয়ে রেখেছি.." বলতে বলতে উনি উঠে দাড়ালেন।
শিলা সলাজ গলায় বলল, "না না আমি কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি থেকে নাস্তা করে বেরিয়েছি।"
উনি শিলার কথা শুনলেন না। ভেতর বাড়িতে গেলেন।
শিলার খুব লজ্জা করছিল। এরকম পরিস্থিতিতে সে আগে কখনো পরেনি। রোদেলার বাবার সাথে যে আগে কখনো কথা হয়নি তা কিন্তু নয় । হটাত দু'এক দিন সামনে পরে গেলে সৌজন্যতা হিসেবে সালাম দিয়ে ক্ষান্ত থেকেছে।
হটাত ডান পায়ের পাতায় কিসের একটা কামড় অনুভব করল শিলা। ভাল করে তাকাতেই দেখল একটা লাল পিপড়া তার পা কামড়ে ধরে আছে। তার স্কুল পড়ুয়া ছোট বোন বিনা এটাকে বিষ পিঁপড়া বল। বিষ পিঁপড়াটা আঙ্গুলে চিমটি করে ধরে নিয়ে আসলো শিলা। কত ক্ষুধে একটা কীট।চাইলেই নিমিষে পিষে মেরে ফেলা যায়। কিন্তু শিলা মারল না। ছেড়ে দিল।
হটাত উনি একটা ট্রেতে করে চা, বিস্কুট আর আর চানাচুর নিয়ে ঢুকলেন।
শিলা খুব অস্বস্তিতে পরে গেল। বলল, আমি খুব একটা চা খাইনা। আপনি কেন এসব ..?
" আমি যে খুব ভাল চা বানাই- আপনার আপা কি কখনো সেটা বলেছে ?"
"জ্বি.. জ্বি না।"
"আমি শিউর দিয়ে বলতে পারি আমার চা একবার খেলে আপনার আবার খেতে ইচ্ছে করবে। খেয়ে দেখেন একবার ..। চা খেতে হয় গরম থাকতে।" বলেই তিনি নিজে এক কাপ চা তুলে নিয়ে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ শব্দে খেতে লাগলেন।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিলাকে নিতে হল। চায়ে চুমুখ দিয়ে মনে হল আসলে চা ভাল হয়েছে। চা খেতে খেতে শিলার একবার মনে হল রোদেলার বাবার জিহ্বাটা কেমন লম্বা। সাপের মত লকলকে।
সময়টা শ্রাবন মাস। শেষ বিকেল। হটাত কালো মেঘে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। দেখতে না দেখতে শুরু হল ঝুম বৃষ্টি। তার সাথে ভয়ানক বজ্রপাত।
শিলা প্রচন্ড অস্থিরতায় ভোগতে লাগল। কথায় আছে বনের বাঘে না মনের বাঘে নাকি মানুষকে খায়। ভয়ে তার হাত পা কেন যেন অবশ হয়ে আসছিল ।
তার কিছুক্ষণ বাদেই শিলা নির্মম সত্যটা উপলব্ধি করল। তার হটাত মনে হল সে সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা দেখছে। সামনে যেদিকেই তাকায় রোদেলার বাবা। চোখের পাতা খুলে রাখতে পারছে না। মাথাটা কয়েক মন ভারী মনে হচ্ছে। তার বুঝতে বাকী রইল না চায়ে এমন কিছু মেশানো হয়েছে যার কারনে তার সবকিছু এমন ওলোটপালট লাগছে। সে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই পারছিল না। মুহুর্তে সে সোফায় এলিয়ে পরল।
"শিলা শিলা আপনার কি খুব খারাপ লাগছে?" বলেই রোদেলার বাবা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
"ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে অনেক.. অনেক.. ভালবাসি। যাকে ভালবাসা যায় কখনো তার ক্ষতি করা যায় না.. "
বলতে বলতে উনি শিলার গালে,কপালে, চিবুকে জোর করে পর পর কয়েকটি চুমু খেল।
শিলা নিজেকে কয়েকবার ছাড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। লোকটা তার ঘাড়ের কাছে কামড় বসিয়ে দিল। এরপর লোকটা তার বুকে হাত রাখল। শিলা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু লোকটার অসুরে শক্তির সাথে সে পেরে উঠল না। দু'জনের মধ্যে অনেক ধস্তাধস্তি চলল। হটাত তার পাজামার ফিতায় টান পরতেই শিলা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ভয়ানক চিৎকার করে উঠল...
আর তখনি তার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল...
শাহানা বেগম পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন।
" কি হয়েছে শিলা? কি হয়েছে মা? "
শিলা উদভ্রান্তের মত এদিকওদিক তাকায়। পাশেই ওয়ারড্রবের উপর থেকে সাইলেন্ট করা মোবাইলটা ছুটে গিয়ে হাতে নেয়। দেখে রোদেলার নামে ছয়টা মিসকল। সে ভয়ে ভয়ে কল ব্যাক করে।
রোদেলার মা ফোন ধরে।
"হ্যা শিলা কি হয়েছে, ফোন ধরছো না কেন?"
শিলা ভয়ার্ত গলায় বলল, "ফোন..সাইলেন্ট.. করা ছিল।"
"তোমাকে যে কারনে ফোন দিয়েছিলাম--বিকেলে আমার ছোট বোনের মেয়ের বার্থডে ।আজকে তোমাকে আর আসতে হবে না। কাল একটু তাড়াতাড়ি চলে এসো।"
শিলার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। তার বুক এখনো ধড়ফড় করছিল।
মা বলল, তোর কি হয়েছে মা?
"মা আমার কিছুই হয়নি। প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও।"
শাহানা বেগম অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। মেয়েরা যতবড়ই হোক মায়ের সাথে সব শেয়ার করে। অথচ তার মেয়েটা হয়েছে সম্পুর্ন চাপা স্বভাবের। মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। ভাল একটা পাত্র দেখা দরকার। রফিক ঘটককে একবার খবর দেয়া দরকার। তিনি একবার দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
শিলা অসহায়ের মত বসে রইল। এমন ভয়ংকর দিবাস্বপ্ন দেখার মানে কি সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। রোদেলার মায়ের ফোনটাও তাকে খুব অবাক করল। স্বপ্ন ও বাস্তবকে সে মেলাতে পারছে না। বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝখানে সে দুলছে।
স্বপ্নের বিষ পিঁপড়াটা এখনো তার চোখে ভাসছে। পিপড়াটা কি তাকে কোন কিছু সতর্ক করতে এসেছিল? হয়তো ঠিক। হয়তো ঠিক না। হতে পারে সবই তার মনের কল্পনা প্রসূত ভাবনা। তবে স্বপ্নটা সে ভুলতে পারেনা। ক্ষনে ক্ষনে সময়ে অসময়ে মনে পড়ে। পুরুষ মানুষ দেখলেই তার মধ্যে আজকাল একটা ভীতি কাজ করে।
(একটি সতর্কতামূলক গল্প)