যেদিন অভির আমাকে বিয়ে করার কথা ছিল তার পরের সপ্তাহেই অভি একটা মেয়ের সিথিতে সিঁদুর রাঙিয়ে তাকে ঘরে এনে তুললো আর আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারিনি।
অভির অবশ্য এ ছাড়া কিছু করার ও ছিলো না। আমার উপর জেদ করেই বিয়েটা করেছিল।
অভিকে আমার বাসার বিষয়টা জানানোর পরে অভিই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। অভি ওর বাসায় বলেছিলো ও কিন্তু অভির বাবা মা আমাকে মেনে নেয় নি। মুসলিম একটি মেয়েকে মেনে নেওয়া অত সহজও নয়। শুনেছিলাম অভির প্রপিতামহ পুরোহিত ছিলেন। সেক্ষেত্রে অভির ফ্যামিলি যে ধর্মকর্মর দিকে পাকাপোক্ত হবে সেটা অভি না বললেও আমি বুঝে নিয়েছিলাম। আর আমার পরিবারে অভির কথা আমি বলিনি। কারন বললেও শুধু অশান্তিই হতো। বাবা কখনোই কিছুতেই অভিকে মেনে নিতেন না।
তারপরেও আমাদের ভালোবাসা এতই গভীর ছিল যে আমরা সবকিছু ছেড়ে হলেও আমাদের ভালোবাসার পূর্ণতা দিতে চেয়েছিলাম। অভি আমাকে বলেছিল প্রয়োজনে নিজের ফ্যামিলি ছেড়ে আসবে তাও আমকে ছাড়তে পারবেনা।
যেদিন আমাদের বিয়ে করার কথা অভি স্বাক্ষী হিসেবে রিয়াদসহ আরো কয়েকটা ফ্রেন্ডকে বলেছিল আসতে। রিয়াদ অভিকে বলেছিল যাওয়ার ওর বাসা থেকে নিয়ে যেতে। অভি যখন রিয়াদের বাসায় এল আমি তখন সোফায় রিয়াদের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছি আর রিয়াদ আমাকে জড়িয়ে রেখেছে।
ঠিক যেই মুহূর্তে অভি এলো রিয়াদ তখুনি বলছে,
-নিরু তুই আমাকে সত্যিই ভালোবাসিস?
-হ্যা রে হ্যা (আমি ভালোবাসা মিশ্রিত কন্ঠে বললাম)
-তাহলে অভি?
-ওর সাথে তো নাটক করছি। ভালো আমি তোকেই বাসি। হিন্দু একটা ছেলেকে ভালোবাসবো কোন দুঃখে বল.....
কথা শেষ করার আগেই রুমের দরজা ক্যাঁচক্যাঁচ করে খুলে গেল। দরজা ভেজানোই ছিল। অভির অপ্রত্যাশিত আগমনে আমি আর রিয়াদ দুজনেই অবাক হয়ে গেলাম। দুয়ারে অভি একমিনিট দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে দেখলাম অভি ফোনে টেক্সট দিয়েছে,
"নিরুপমা আমার ভালোবাসা কতখানি নিখাদচছিল সেকথা আমার থেকে তুমি ভালো জানো বলেই সে প্রমাণ আমি তোমাকে দিচ্ছিনা। ধর্ম, সমাজ, সংস্কারের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি যে পাপ করেছি তার ফল আমাকে কোন না কোনভাবে দিতে হবে সেকথা জেনেই আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। আমি অনুতপ্ত বলেই বাবামায়ের কথা শুনে সেই পাপ মোচন করার চেষ্টা করবো। তুমি সমাজের সর্বনিম্ন স্তরে নামলেও নিরুর জন্য বুকের বামপাশে যে জায়গাটা আছে সেটা কাউকে দিতে পারবোনা। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক। আমাকে আর কখনো খুজতে যেওনা। তোমার আশেপাশে অভিকে আর কখনোই পাবে না"
অভির টেক্সট দেখে আমি আমি কাঁদলাম না পাথর হয়ে বসেছিলাম। রিয়াদ আমার হাত ধরে বললো, আমি জানি সব ঠিক হবে না নিরু, কিন্তু এসবের মাঝেই ভালোথাকার চেষ্টা করতে হবে।
অভি যেদিন বিয়ে করলো আমি দূর থেকে অভির বউকে দেখেছিলাম। অভির পাশে মেয়েটাকে বেশ মানিয়েছে। সিথিতে রাঙা সিঁদুর। মেয়েটাকে পুতুলের মত লাগছিল। অভির পাশে মেয়েটাকে দেখে আমার কষ্টে বুক ফেটে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা না হয়ে মুখে বিজয়ীর হাসি দিয়ে বধুবরন দেখতে লাগলাম। কারন আমি যে আমার কথা রাখতে পেরেছি। ভালোবাসা তো আমাকে বহু আগে থেকেই পোড়াচ্ছে নতুন করে পোড়ানোর কিছু নেই।
কিন্তু এর পেছনের কাহিনীটা অতি সংক্ষিপ্ত। বেশকয়েকদিন আগে একদিন দুপুরে যখন অভির ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলাম তখুনি মা এসে বললো এক মহিলা আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। মা ওনাকে আমার রুমে দিয়ে গেলেন। তিনি আমার রুমে এসে দরজা লক করে বললেন, আমি অভির মা। আমি অভির মাকে আগে কখনো দেখিনি। তাকে সালাম দিব না নমস্কার দিব ভাবতে ভাবতে সালামই দিলাম।
তিনি আমায় বললেন,
-তুমিই তো নিরুপমা তাই না?
-হু আমি নিরুপমা।
-তুমি কি জানো অভি তোমাকে বিয়ে করবে বলে আমাদের ছেড়ে আসবে বলেছে।
-জ্বী জানি।
-দেখ মা তুমি আমার সব শেষ করে দিওনা। তিনি আমাকে বোঝালেন, "আমার একটাই ছেলে। অভি যদি তোমাকে বিয়ে করে অভির বাবা কোনদিন ও মানবেনা। আর মানলেও সমাজ আমাদের একঘরে করে দিবে। অভি তোমার সাথে চলে আসলে সে দুঃখ অভির বাবা সইতে পারবেন না। তা কিছু হয়ে গেলে আমি বিধবা হয়ে যাব। আমাদের পরিবারটা ধংস হয়ে যাবে মা। অভি ছাড়া আমাদের চারকুলে আর কেউ নেই। আমি নিঃসন্তান থাকার পর অনেক সাধনার পরে অভি আমাদের জীবনে এসেছে তাকে তুমি দূরে সরিয়ে দিওনা। তুমি যদি আমাদের ধর্মের নিচু জাতের হতে তাও তোমাকে মেনে নিতাম। তাছাড়া তোমাদের ধর্মেও তো নিষেধ আছে।
আমি অভির মা না তোমার মা হয়ে বলছি তুমি কি পারতে তোমার মা কে বিধবা করতে?
আমি সব বুঝেও বললাম আমকে কি করতে হবে?
-তুমি অভির জীবন থেকে সরে যাও। কথা দাও ও যাতে তোমাকে বিয়ে না করে আমাদের সাথে থাকে সেই ব্যাবস্থা তুমি করবে। আর অভিকে জানাবেনা যে আমি তোমার সাথে দেখা করেছি।
আমি অভির মাকে সেদিন বুকে পাথর বেধে কথা দিয়েছিলাম। সেই কথা রাখতে গিয়েই রিয়াদের সাথে এই নাটক করা। অভির বিয়ের পরে রিয়াদ আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল তবে আমিই রিয়াদকে রিজেক্ট করেছি। রিয়াদ আমাকে আগে থেকেই পছন্দ করতো বুঝতাম তবে ওকে বিয়ে করলে ওকেই ঠকানো হত কারন কখনই রিয়াদকে আমি ভালোবাসতে পারতাম না। তারপরে অভির সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি। করলেও লাভ হতনা। তিক্তস্মৃতির দরকার কি বরং যে মধুর স্মৃতিটুকু আছে তাই নিয়ে বেচে থাকতে চাইলাম। নিজের ক্যারিয়ারে মন দিলাম সেই সাথে ধর্মে। ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলার সর্বোত্তম চেষ্টা করলাম। বোরকা, নিকাব ছাড়া কখনো বের হতাম না বাইরে। তবে অভিকে আমি কখনই ভুলে যাইনি। খুব জানার ইচ্ছা করতো ওর বৌ কি জোৎস্না রাতে পায়ে আলতা লাগায়। অভি কি তা মুগ্ধ হয়ে দেখে। অভি কি একবারো ভাবেনা যে এখানে হয়তো তার নিরু থাকতে পারতো। আসলে মানুষ কখনো কঠিন হয়ে জন্ম নেয় না বরং পরিস্থিতিইই তাকে কঠিন হতে বাধ্য করে। তারপরো আমি চেয়েছি অভি ওই মেয়েটাকেই মুগ্ধ হয়ে দেখুক। তাকে এতটাই ভালোবাসুক যা আমাকেও বাসেনি। নির্দোষ সে কেন আমার দোষের ভাগ নিবে।
তারপর অনেক বছর চলে গেছে। হুট করেই রাস্তায় একদিন অভির সাথে দেখা তাও প্রায় আটবছর পরে। আমি রাস্তা পার হচ্ছিলাম তখন দেখলাম একটা বাচ্চা মেয়ে রাস্তা পার হচ্ছে একা একাই। একটু হলেই বাচ্চাটা গাড়ির নিচে পড়তো। আমি ভাগ্যিস হাত ধরে টান দিয়েছিলাম বলেই রক্ষে। তখনি পুতুলের মত সেই মেয়েটা এসে বাচ্চাটাকে জরিয়ে ধরলো। তাহলে এটা অভির মেয়ে। বাহ ওর বৌয়ের মতই কিউট। মেয়েটা আমার হাত ধরে বললো, আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। তবে আজ যে উপকার করলেন তা হয়তো কখনো শোধ করতে পারবো না। আসলে মেয়েটা এত দুষ্ট। মেয়েটার কথায় বোঝা গেলল বেশ অমায়িক। অভি তাহলে ভালো একটা মেয়েকেই বিয়ে করেছে। মেয়েটাকে আট বছর আগে যেমন দেখেছিলাম তেমনই আছে। শুধু একটু মোটা হয়েছে। ফোলা ফোলা গাল দুটিতে গোলাপি আভা। অভি তখন আস্তে আস্তে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। তারপর ওর বৌ কে উদ্দেশ্য করে বললো, স্মৃতি তুমি ওকে নিয়ে এগোও আমি আসছি। অভির বৌয়ের নাম তাহলে স্মৃতি। অভি নিশ্চই আমাকে চিনতে পারেনি। কারন বোরকা নিকাব পড়া ছিলাম। অভি নিচের দিকে তাকিয়েই বললো ধন্যবাদ আপনাকে। তারপর হুট করেই আমার চোখের দিকে তাকালো। অভির সুক্ষ্ম দৃষ্টি যেন আমার হৃদয় এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছিল। অভি চলে যেতে নিলে আমি বললাম, অভি তুমি কেমন আছো।
অভি ফিরে ঠিক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-মিসেস নিরুপমা চৌধুরী আমি জীবনে সবচেয়ে বেশি ঘৃনা করি প্রতারকদের। আর ঘৃনিত মানুষদের সাথে কথা বলা আমার সবথেকে অপছন্দ।
অভি চলে যাচ্ছে আর আমি ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার খুব ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে অভিকে বলি, অভি আমি কারো মিসেস হইনি। আমি পারিনি তোমার জায়গাটা অন্য কাউকে দিতে।কিন্তু একটা অদৃশ্য শিকল আমার পা বেধে রেখেছে যেন। আমি অভির চলে যাওয়া দেখলাম। অভি আমাকে কখনোই ফেলে যেত পারতোনা কিন্তু আমার সামনে দিয়ে অভিষেক দেবনাথ চলে যাচ্ছিল। অভিকে আমি আটকাতে পারতাম কিন্তু অভিষেক দেবনাথকে আটকানোর সাহস বা অধিকার কোনটাই আমার নেই। আটবছর আগের মত অভি চলে গেল আমার দৃষ্টি ছাড়িয়ে বহুদূরে।
আমি জীবনে আর বিয়ে করিনি। অনেকেই বলতো হিন্দু একটা ছেলের জন্য এভাবে লাইফ নষ্ট না করাই বেটার। সে যেহেতু তার ধর্ম মেনে বিয়ে করে নিয়েছে আমারো তাই উচিত। কিন্তু তারা আমার বাহিরটাই দেখে। ভিতরটা দেখে না। আমি যে অভিকে ভালোবেসেছি অভিষেক দেবনাথকে নয়। ভালোবাসার সবটুকু জুড়ে যে শুধু অভির বসবাস। কাউকে সৎভাবে মন থেকে চাওয়া পাপ নয়। ভালোবাসা সবসময়ই পবিত্র শুধু আমরাই কিছু ভুলভাল সমীকরণ আর নিজেদের লোভ লালসাকে ভালোবাসার নামে চালিয়ে দিয়ে তাকে অপবিত্র করে ফেলি।
*সমাপ্ত*