অব্যক্ত_সত্য

4 13
Avatar for LeoBanna
3 years ago

মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলো অনিমেষের। হঠাৎ, কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় তার মাথা ভার হয়ে গেলো।

“এখন এই ভার ভার শরীর নিয়ে সারারত আর ঘুম হবে না। ফলে, কাল সারাদিন কাটাতে হবে জঘন্য এক মাথাব্যাথা নিয়ে।” কথাগুলো মাথায় আসতেই অনিমেষের মনে বিরক্তি ধরে গেলো। সেই বিরক্তি নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে বা'পাশ ফিরে তাকিয়ে সে দেখলো, রুমা বিছানায় নেই। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ রুমার শূণ্যস্থানে তাকিয়ে থেকে সে ভাবলো, হয়তো, রুমা ওয়াশরুমে গিয়েছে।

কথাটি ভাবতেই সে ডান পাশ ফিরে তাকালো ঘরের সাথে লাগানো ওয়াশরুমের দিকে। কিন্তু সেখানে কোনো বাতি জ্বলছে না। বিষ্মিত হয়ে অনিমেষ ধীরে ধীরে চোখ বুলিয়ে নিলো তার ঘরের চারপাশে। তবু কোথাও সে রুমার কোনো হদিশ পেলো না।

নিজেরে ঘরে রুমাকে না দেখে অনিমেষের মাথায় প্রশ্ন এলো, "এতোরাতে রুমা কোথায় গেলো?" প্রশ্নটা মাথায় আসতেই তড়িঘড়ি করে বিছনা ছেড়ে উঠে পড়লো অনিমেষ। তারপর, বিছানার নীচে থাকা রাবারের স্যান্ডেল জোড়া পাঁয়ে গলিয়ে সে জ্বালিয়ে নিলো ঘরের বাতি। অনেকক্ষণ অন্ধকারের ভেতরে থাকায় হঠাৎ আলো চোখে পড়ায় সবকিছু কেমন যেনো ঝাপসা হয়ে গেলো তার কাছে। সেই ঝাপসা চোখেই জামা গায়ে জড়িয়ে সে ধীর পায়ে ঘুরে দেখতে থাকলো সমস্ত ঘর। রান্নাঘর থেকে শুরু করে বারান্দা- সব জায়গায় খুঁজে দেখলো। কিন্তু, কোথাও রুমার কোনো চিহ্ন নেই।

“তাহলে, রুমা কই গেলো?", প্রশ্নটা মাথায় আসতেই বুকের ভেতর কেমন যেনো একটা কুঁ ডাক দিয়ে উঠলো। "তবে কী রুমার কিছু একটা হয়ে গেছে?" আপনা আপনি প্রশ্নটা মাথায় চলে আসলো। প্রশ্নটি মাথায় আসার সাথে সাথে আর একমুহূর্ত দেরি না করে চিন্তিত ভঙ্গিতে অনিমেষ সিড়ি ভেঙে উঠে গেলো দোতালায়।

অনিমেষের বাড়িটা ডুপ্লেক্স। নীচতালায় থাকে অনিমেষ আর রুমা। আর, দোতালায় থাকেন বাবা। সচরাচর তারা দু'জনের কেউই প্রয়োজন ছাড়া দোতালায় যায় না। কেননা, বাবা একা থাকতে পছন্দ করেন।তবুও, আজ এই মধ্যরাতে তার উপরে উঠতেই হলো। তারপরও, সে চেষ্টা করলো নিশব্দে হাঁটতে, যেনো বাবা জেগে না উঠেন।

দোতালায় হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ সবগুলো ঘরে ঘুরে খুঁজতে থাকলো রুমাকে। কিন্তু, কোথাও রুমা নেই। হতাশ হয়ে অনিমেষ দাঁড়িয়ে রইলো দোতালার করিডোরে। তারপর, চিন্তা করলো, “এবার বোধহয় নিজের রুমে ফিরে যাওয়াই উচিত।” আপনমনে কথাটি ভেবে অনিমেষ উদ্যত হলো নিজের ফিরে যাওয়ার। ঠিক সেসময় তার কানে ভেসে আসলো,একটি নারী কন্ঠের মৃদু চিৎকার। চিৎকারটি শুনে অনিমেষ থমকে দাঁড়ালো। তারপর, চেষ্টা করলো, কান পেতে চিৎকারটির উৎস খুঁজে বের করার।

নিশব্দে দাঁড়িয়ে শব্দটির উৎসটি খুঁজতে গিয়ে তার মনে হলো, চিৎকারটা ঠিক যেনো তার বাবার ঘর থেকে আসছে। কিঞ্চিৎ বিষ্ময় আর কৌতুহল নিয়ে ধীরে ধীরে সে এগিয়ে আসলো তার বাবার ঘরের সামনে। তারপর, কান পেতে ভেতরে কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করলো।

কিন্তু, কান পাতার সময় হাতের আলতো চাপ লাগতেই ভেজানো দরজাটা খুলে গেলো। ভাগ্যক্রমে সে হাতের উপর পুরোপুরি ভর দেয়নি। তাই, দরজাটা খুলে একটু ফাঁক হয়ে যেতেই সে নিজেকে সামলে নিতে পারলো পড়ে যাওয়ার হাত থেকে।তারপর, তড়িঘড়ি করে দরজার হাতলটা ধরে সে দরজাটি পুরোপুরি খুলে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করলো। আর, তখনই সে স্পষ্ট শুনতে পারলো, ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে মেয়ে কন্ঠের আর্তনাদ। পাশাপাশি, মৃদু স্বরে ভেসে আসছে পরিশ্রমী বাবার ক্লান্ত নিশ্বাসের শব্দ।

ভেতরে কী হচ্ছে, তা বুঝতে আর অনিমেষের বাকী রইলো না। খুব অবাক হয়ে গেলো সে।

মা মারা যাবার পর বাবা আর বিয়ে করেননি। দীর্ঘ ১২ বছর একা একাই থেকেছেন। এর মাঝে অনেকবার তাকে বিয়ের কথা বলা হয়েছিলো, এমনকি অনিমেষও বেশ কয়েকবার বলেছিলো। কিন্তু, তিনি সম্মতি দেননি। বরং চারপাশে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে গেছেন, “মাকে ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো নারীর তার প্রয়োজন নেই। একমাত্র মাকেই তিনি ভালোবাসেন।”

সেই বাবা কি না রাতের অন্ধকারে, লোকচক্ষুর আড়ালে এসব করে বেড়ান। কথাটি মনে হতেই অনিমেষের বাবার প্রতি খুব ঘৃণা হলো। ইচ্ছে করলো, এখনই দরজা খুলে বাবাকে বলতে, "এসব কী করছেন আপনি? এই আপনার মায়ের প্রতি ভালোবাসা?" কিন্তু, সে কিছুই করলো না। পরিবর্তে নিশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

অনিমেষ যখন দরজা বন্ধ করলো তখন ভেতরের মেয়েটি কি যেনো একটা কথা বললো। তারপর, খিলখিল করে হাসতে থাকলো। সেই হাসির শব্দ আর কন্ঠস্বর শুনে অনিমেষ কেঁপে উঠলো। কেননা, কন্ঠস্বরটি তার খুব পরিচিত।

স্মৃতি হাতড়ে সে অনেক চেষ্টা করলো কন্ঠস্বরটি মনে করার। কিন্তু, কোনোভাবেই মনে আসছে না।

ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়লো রুমার কথা। "তবে কী মেয়েটা রুমা?" প্রশ্নটা মাথায় আসতে অনিমেষের নিজের উপর ঘৃণা ধরে গেলো। "এরকমও কিছু মাথায় আসতে পারে, তাও আবার রুমাকে নিয়ে?" প্রশ্নটা নিজেকে নিজে করে তার ইচ্ছা করছিলো এখনই মাটির নীচে ঢুকে যেতে। কেননা, রুমাকে বাবা নিজের মেয়ের চোখে দেখেন, আর রুমাও বাবাকে।

"তাহলে,মেয়েটি কে?" আপনমনে সে যখন ভাবতে থাকলো এই প্রশ্নের কথা, ঠিক তখনই তার মনে পড়ে গেলো, এ ঘরে তারা তিনজন বাদে আরও একজন থাকে। তিনি রাবেয়া খাতুন। রাবেয়া খাতুন অনিমেষের জন্মের আগে থেকে এ বাড়িতে কাজ করেন। বলতে গেলে তিনিই অনিমেষকে কোলে পীঠে করে মানুষ করেছেন। কেননা, অধিকাংশ সময় কাজের কারণে বাহিরে থাকতে হতো তার মাকে।

সেই মায়ের সমতূল্য একজন মানুষের সাথে বাবার এ কী ধরণের সম্পর্ক? এ সম্পর্ক কি মা বেঁচে থাকতেও ছিলো? না কি, মা মরে যাবার পর হয়েছে? প্রশ্নগুলো ভাবতে ভাবতে অনিমেষের মনটা বিষিয়ে গেলো। অনেকটুকু রাগ আর অভিমান নিয়ে ধীরে ধীরে সে চলে আসলো তার নিজের ঘরে। কিন্তু, ঘরে তার ভালো লাগছিলো না। কেমন যেনো অস্বস্তি হচ্ছিলো এই বদ্ধ পরিবেশে থাকতে। তাই, বিছানার পাশে থাকা ছোট টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট সাথে নিয়ে সে উঠে গেলো বাড়ির ছাঁদে।

রাতের আকাশটা মেঘে ঢাকা। কেমন যেনো এক গভীর দু:খবোধ ছুঁয়ে আছে পুরোটা আকাশ জুড়ে। সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো অনিমেষ। কেননা, ঘরের ভেতর এতক্ষণ তার মনে হচ্ছিলো, কে যেনো গলা টিপে ধরে রেখেছে।

একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে সে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে তুলে নিলো একটি সিগারেট। তারপর, ঠোঁটে সিগারেটটি চেপে ধরে লাইটারটি মুখের কাছে নিয়ে আসলো। সেই লাইটারে দু'বার চাপ দিতেই জ্বলে উঠলো আগুন। আগুনের লাল বহ্নিশিখায় সিগারেট ছুঁইয়ে সে লম্বা টান দিয়ে ধরিয়ে নিলো। সেই সিগারেটের ধোঁয়া ফুসফুস ছুঁয়ে আবার যখন বেরিয়ে আসলো মুখ দিয়ে, তখন সে খেয়াল করলো ছাঁদের একদম ডানপাশের কোণায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুমা।

বাহিরে দিকে মুখ করে মৃদু স্বরে সে ফোনে কথা বলছে যেনো দূর থেকে কেউ বুঝতে না পারে। এছাড়া, তার কথা বলার সময় শরীরের সতর্ক অঙ্গভঙ্গি দেখে বোঝাই যাচ্ছে এই বিষয়ে সে কাউকে জানাতে চায় না।

দৃশ্যটা দেখে খুব অবাক হলো অনিমেষ। কেননা, রুমার সাথে তার খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কফি হাউজে সেই যে প্রথম দেখা হয়েছিলো ১৪ বছর আগে, তারপর থেকে তারা একসাথে। এই দীর্ঘদিনের সম্পর্কে একটা দিনও তারা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। কখনও একে অপরের কাছে কোনো কিছু গোপন করে যায়নি। সেই রুমা কি না তার কাছে কোনো একটা বিষয় গোপন করে যাচ্ছে! বিষয়টা সে কোনোভাবেই মানতে পারলো না। রুমার উপর খুব অভিমান হলো তার, আবার কিছুটা অবাকও হলো। তখন মনে মনে সে ভাবতে থাকলো, “তবে কী রুমারও অন্য কোনো সম্পর্ক আছে, যেমনটা বাবার আছে?” কথাটা মাথায় আসতেই অনিমেষের শরীরটা কেমন যেনো কেঁপে উঠলো। তার মনে হলো, এই পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই। ঠিক তখনই তার মনে হলো, “এমনও তো হতে পারে, কোনো প্রয়োজনীয় কল এসেছিলো। আমার ঘুম ভেঙে যাবে দেখে ও ছাঁদে এসেছে।" কথাটি মনে হতে তার আবার মনে হলো, "রুমা যেহেতু ছাঁদে এসেছে, তাহলে সে’ও তো জেনে গেছে বাবার কথা। না কি, রুমা আগে থেকেই বাবার এই সম্পর্কের কথা জানে? তবে কী সে জেনেও আমার গোপন করে গেছে? আর যদি গোপন করেই যায়, তবে কী আরও অনেক কিছু আছে যা ও আমার সাথে আগেও গোপন করেগেছে?" প্রশ্নগুলো মাথায় আসতে সবকিছু কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে যেতে লাগলো। তার মনে হলো, সবকিছু এখনই ভেঙে পড়বে। তাই, দ্বিতীয় কোনো চিন্তা না করে সে রুমার কাছে এসে নিশব্দে দাঁড়ালো।

রুমা অনিমেষকে দেখে একটুও অবাক হলো না। খুব শান্ত ভঙ্গিতে বিষণ্ণ চোখে অনিমেষের দিকে তাকিয়ে হাত থেকে সিগারেটটি নিয়ে টানতে থাকলো। তারপর, কান থেকে ফোনটি নামিয়ে অনিমেষের চোখে চোখ রেখে বললো, "জানি, আজকের রাতটা তোমার জন্য পৃথিবীর দীর্ঘতম রাত। আজ রাতে যা যা দেখলে, তারপর আর কোনদিনও স্বাভাবিক হতে পারবে না। তবুও, তোমাকে একটি কথাই বলবো, নীচে যা দেখে আসলে তার কোনোটাই আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সত্য না।"

অনিমেষ রুমার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। বললো, "তাহলে, এরকম গোপনীয়তা রাখছো কেনো?"

রুমা তখন শূণ্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, "কিছু কথা আছে, যা কখনো বলা যায় না। বললে, বিপদ হয় আশেপাশের মানুষদের। ধরে নাও, এখানেও সেরকম কিছু হয়েছে। আমার কাছে তুমি কারণ জানতে চেয়ো না। আমি বলতে পারবো না। কেননা, জেনে বুঝে আমি আমার প্রিয়জনের ক্ষতি করতে পারি না।"

কথাগুলো বলেই রুমা অনিমেষের কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে এসে দাঁড়ালো। তারপর, লাফ দিলো ছাঁদ থেকে। সেদিকে বোকার মতো তাকিয়ে থেকে অনিমেষ চেষ্টা করলো ঘটনা কি ঘটেছে তা বোঝার। কিন্তু তা বুঝে উঠবার আগেই অনিমেষ হারিয়ে ফেললো তার পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে...

(চলবে....)

#পর্ব_১

-জিসান রাহমান

২৮.০৭.২০২০

6
$ 0.00
Sponsors of LeoBanna
empty
empty
empty
Avatar for LeoBanna
3 years ago

Comments