#নাম_ভালবাসার_সেই_তুমি,,,,#পর্ব_১
#
বউ ইদানীং সাজগোজ করে আশেপাশে ঘুরে! মাঝে মাঝে চোখ মারে! মিষ্টি মিষ্টি হাসে! ব্যাপার কী বুঝতে পারছি না! আমার ব্যাংক কার্ড তো তাঁর কাছেই। নতুন করে চাচ্ছে কী? আমি কোনো লটারি ধরিনি যে সেটার জেতার খবর বউ আগেই পেয়ে গেছে! অনেকদিন পর আমার পছন্দের খাবার রান্নায় বেশ মনোযোগী হয়ে উঠেছে।
একদিন পরা হয়েছে এমন শার্ট তো ধৌত করছেই। আলমারি থেকে নতুন শার্টও বের করে ধৌত করছে! তাও আবার নিজের হাত লাগিয়ে, শরীরের বল-বেগ ক্রয় করে! ওয়াশিং ম্যাশিনের সাহায্য নিচ্ছে না! টিভি দেখতে বসলে রিমোটের উপর কোনো জোর দেখাচ্ছে না!
মাঝেমধ্যে এমন রোমান্টিক চাহনি দিচ্ছে। আমার কলিজা সহ নড়ে যাচ্ছে! তাঁর হঠাৎ এই আমূল পরিবর্তনের কারণটা কী বুঝে আসছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর পাসওয়ার্ড দিয়ে দিলাম। ব্যাংক কার্ড দিয়ে দিলাম। বাসার আলমারি সিন্দুকের চাবি তাঁর কাছে। আমার কাছে আছে আর কী? অনেক ভেবেচিন্তেও কিছু পেলাম না!
সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া করার পরে নুভা, নোহা আর আমি শোবার ঘরে আসলাম। নোহা আমার মেয়ের নাম। সে বিছানায় উঠার আগেই নুভা বলল।
“ নোহা, মামনি তোমার ফুপ্পির সাথে থাকতে অনেক ভালো লাগে বুঝি? "
নোহা মাথা নাড়িয়ে বলল।
“ নাহ! ”
নাহ বলেছে সে ভয়ে। আসলে সে সুরাইয়ার সাথে থাকতে পাগল। সারারাত দুজনে মিলে যা খুশি তা করতে পারে তো। টিভি দেখতে দেখতে, গেমস খেলতে খেলতে রাত তিনটা বেজে গেলেও সুরাইয়া কিছু বলে না। সাধারণত নোহা সপ্তাহে একদিন সুরাইয়ার কাছে থাকার অনুমতি পায় মায়ের কাছ থেকে। বৃহস্পতিবার রাতে। কিন্তু ইদানীং নোহাকে সুরাইয়ার কাছে রাতে পাঠিয়ে দেওয়াতেই বেশ আনন্দ পাচ্ছে বউ! মায়ের কথা না শুনলে ধুমধাম মার শুরু করে দেয়! এজন্য নোহা খুব ভয় পায়।
“ নাহ? মিথ্যা বলছো আম্মুর সাথে? "
“ নাহ! "
নুভা একটু হাসল।
“ ভালো, আম্মুকে ভয় পাওয়া ভালো। আজকালকার মেয়েরা আর আম্মুকে ভয় পায় না! আচ্ছা, যাও আজকে ফুপ্পির কাছে গিয়ে থাকো। ”
বেশ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল নোহা।
“ কেন? "
জবাব দিল না বউ। নোহার চোখে চোখ রাখতেই সে হনহন করে সুরাইয়ার কাছে চলে গেল! নোহা চলে যেতেই সে বলল।
“ তোমার শরীর কি ব্যথা করে? "
আপনি থেকে তুমিতেও নেমে এসেছে! কী হচ্ছে মাবুদ!
“ না তো! শরীর ব্যথা করবে কেন? "
“ নাহ, এমনিই মনে হলো। যদি হাতে পায়ে ব্যথা করে আমাকে বলবে। আমি মালিশ করে দিব। "
“ আচ্ছা, বলব! "
বৃটিশ আমলের পরে তাঁর মুখ থেকে এমন কথা আমি শুনিনি! আগে এমন বলত। সে অনেক আগের কথা। সারাজীবন সে শাড়ি কিনেই গিয়েছে। পরে আর দেখেনি। নতুন নতুন কাপড় আলমারিতে রেখে পুরনো কাপড়চোপড় পরে বাসায় থাকত। এখন হয়েছে উল্টা। নতুন নতুন সব শাড়ি পরে শেষ করছে। পুরোনোগুলো তুলে রাখছে আলমারিতে! বেশ নরম স্বরে সে জিজ্ঞেস করল।
“ আচ্ছা, আমি যে প্রতিদিন সাজি, তুমি যে কিছু বলো না! আমাকে কি দেখতে ভালো লাগে না? "
সত্যি বলতে সে দেখতে চমৎকার। তাঁকে প্রথম দেখাতেই মায়ের পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। এই মেয়েকেই পুত্রবধূ করবেন। আর কাউকেই না। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল।
“ লাগে, ভালোই লাগে। "
“ শুধুই ভালো? "
“ নাহ, একটু বেশিই ভালো লাগে। "
“ শুধু একটু বেশি? আচ্ছা বাদ দেন। আপনার গবেষণা কেমন চলছে? "
“ ভালোই, বেশ বেগ পেতে হচ্ছে এই গবেষণাটা করতে গিয়ে। কিন্তু ভালোই লাগছে। ”
“ আপনার মাথা তো মাথা না। যেন বিদ্যাসাগরের বই পুস্তক। "
“ তুমি ইদানীং আমার বেশি প্রশংসা করছো লক্ষ্য করছি। কারণটা কী? "
“ ইদানীং না। সবসময়ই করতে মন চায়। সমস্যা হলো আপনি আমার কথা গুরুত্বসহকারে নেন না। "
“ কী লাগবে সেটা সোজাসুজি বললেই পারো। ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কী লাভ? ”
“ কেন মনে হলো আমার কিছু লাগবে? আমার মা আছে, বাবা আছে। এত লক্ষ্মী একটা মেয়ে আছে। তার উপর স্বামী হিসেবে পেয়েছি একজন বীরপুরুষকে। আর কী চাই? "
“ তুমি আবার তুমি থেকে আপনিতে চলে গেছো! "
“ ঐ একটু মাঝেমধ্যে এদিক সেদিক হয়ে যায়। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। "
বিয়ের প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল বোবা একটা মেয়ে করে এনেছি! সারাক্ষণ চুপচাপ। দিনরাত বাড়ির মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে। ফলশ্রুতিতে কিছুদিনের মধ্যেই সবার মন জয় করে নিল। সবাই এখন তাঁকে বাড়ির রাণী বানিয়ে রেখেছে! বিয়ের সাত বছর হয়ে গেল। সে তুমি ডাকার চেষ্টা করল না। কিছুদিন যাবৎ খুব চেষ্টা করছে। দাঁত মুখ এক করে দিচ্ছে!
বাতি নেভানোর কিছু মিনিট পর খেয়াল করলাম বউ আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে! এত ভালোবাসা আমি কোনোদিন পাইনি! ঠিক কী কারণে আচানক আমার প্রতি তাঁর প্রেম ভালোবাসা বেড়ে গেছে সেটা জানার আগ পর্যন্ত চোখে ঘুম আসছে না! ইদানীং আরো একটা পরিবর্তন বিষয় লক্ষ্য করছি তাঁর মধ্যে। সেটা হলো উঠতে বসতে হাতে চিমটি কাটা! আমি দিতে চাইলে সে এমন লজ্জা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে পরশু আমাদের বিয়ে হয়েছে! অথচ বিয়ের সাত বছর পেরিয়ে গেছে!
ল্যাবে আমার সহযোগী আছে তিনজন। অর্পিতা, বীণা আর প্রণব বাবু। এদের মধ্যে অর্পিতা অবিবাহিত। বাকি দুজনের বিয়ে হয়েছে। আমার মত বাচ্চাকাচ্চাও আছে। আজকে আমাকে চিন্তিত দেখে অর্পিতা হাসছে! এই মেয়েটা হাসতে পারে আমার জানা ছিল না! সে শুধু পড়ে আর নানান কিছু আবিস্কার করার চেষ্টা করে।
“ হাসছো কেন? "
“ স্যার, আমার বয়স তো কম হয়নি। কিন্তু বাবা বিয়ে দিতে চাইছে না! "
“ এই ঘটনায় হাসির কী আছে? "
“ আছে, অনেক কিছুই আছে। কালকে বাবাকে বিয়ের কথা বলার পর কি হয়েছে জানেন? "
“ একজন বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে বাচ্চাদের মত প্রশ্ন কেন করো? তুমি না বললে আমি জানবো কীভাবে? "
“ শুনেন স্যার কালকে কী হয়েছে। ল্যাব থেকে যাওয়ার পথে একটা ছেলে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। ভয়ে তাঁর হাত পা কাঁপছে। আমি ভাবলাম ফুল-টুল দিয়ে প্রেম নিবেদন করবে। কিন্তু না সে বলল, আমি যেন তোমাকে আর মামুন সাহেবের সাথে না দেখি। তাহলে খারাপ কিছু হবে! "
“ কি বলো? কেন? "
“ হ্যাঁ, তো আমি জিজ্ঞেস করলাম জনাব কারণটা কী? সে উত্তর দিল, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার ধারণা তোমাদের মধ্যে কিছু চলছে।
আমি আবার বললাম, হ্যাঁ। তা তো চলছেই। গভীর গবেষণা চলছে। সফল হতে পারলে আন্তর্জাতিক পুরষ্কার নিশ্চিত।
সে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, এটা কোনো মজার বিষয় না। তুমি জানো আমি নুভা ম্যাডামকে এই বিষয়ে সেদিন জানিয়েছি।
‘ বাহ, তো ম্যাডাম এই বিষয়ে কী বললেন? '
‘ কিছু বলেনি, শুধু একটু মনমরা লেগেছিল। আমার মনে হচ্ছে তোমাকে অতি শীঘ্রই ল্যাব থেকে বের করে দেয়া হবে। তাই আগেভাগেই তুমি ল্যাবটা ত্যাগ করো। সম্মানও থাকবে। উনার পরিবারও বাঁচবে! "
আমি অর্পিতার কথা শুনে হাসলাম। এই হলো তাহলে ম্যাডামের অতি পেয়ার মোহাব্বতের আসল কারণ! বেশ উৎসাহী হয়ে জানতে চাইলাম।
“ তারপর কী হলো? ”
“ তারপর আমি কথা পাকাপোক্ত করে নিলাম। এই ছেলেটাকেই বিয়ে করব। তাঁর সাহস আছে বলতে হবে। যেই ছেলে ম্যাডামের কাছে তাঁর স্বামীর ব্যাপারে বাজে কথা বলতে পেরেছে। সে জীবনে যে কোনো দুরূহ কাজ করতে পারবে। বাড়িতে গিয়ে সোজা বাবাকে এই ছেলেটার কথা বললাম। কিন্তু বাবা বলল আমি নাকি এখনো বাচ্চা! ”
“ তুমি বাচ্চা নাকি বুড়ি সেটা পরের কথা। আগে বলো সেই ছেলেটাকে কোথায় পাওয়া যাবে? তাঁকে আমার ধন্যবাদ দিতে হবে। পুরস্কৃত করতে হবে। ”
“ আশেপাশে কোথাও আছে। যাবার সময় নিশ্চিত আজকেও সামনে দাঁড়াবে। ”
“ আজকে তোমার সাথে আমিও যাব। ”
গোধূলির সময় ল্যাব থেকে আমরা বের হয়েছি। নয় নাম্বার রোডের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। সাতাশ কী আটাশ বছরের একটা ছেলে এসে সামনে দাঁড়াল। আমি তাঁকে বললাম।
“ চা খেতে খেতে তোমাদের বিয়ে নিয়ে আলাপ করা যাক। ”
ছেলেটা বিয়ের কথা শুনে খুব খুশি হলো মনে হচ্ছে। চোখমুখ ভয়ের ছাপও স্পষ্ট। দীর্ঘ তের বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় কোনো ছাত্রকে দেখিনি আমাকে ভয় পেতে। কিন্তু নুভাকে দেখলেই ভয়ে কাঁপতে দেখেছি অনেককেই! এই ছেলের ক্ষেত্রে ঘটল অন্য কিছু।
পাশের একটা ক্যান্টিনে ঢুকলাম আমরা। তিন কাপ চা টেবিলে দেয়া হলো। আমি বললাম।
“ তুমি আমার কাছে কী চাও বলো? আমার সাধ্য থাকলে তা তোমাকে অবশ্যই দিব। তুমি আমার যা উপকার করেছো। তুমি তো জানো না। বিয়ের পরে এত সুখ আমি কখনো পাইনি। উঠতে, বসতে, খেতে, দেখতে, ঘুমাতে শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা! ”
ছেলেটা মনে হয় লজ্জা পেয়েছে।
“ স্যার আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আসলে ম্যাডামকে বেশি কিছু বলিনি। শুধু বলেছিলাম, স্যার আপনার উপর খুবই অসন্তুষ্ট এবং বিরক্ত। এজন্য তিনি অর্পাকে বিয়ে করার চিন্তা করছেন! ”
“ এতেই যা কাজ হয়েছে তুমি জানো না। আচ্ছা তুমি করো কী? ”
“ কিছু করি না স্যার। সাঁতার কাটি শুধু। জলে থাকি। ”
অর্পিতা মুখ খুলল।
“ ওয়াও, ইন্টারেস্টিং তো। আপনি কি ডুবুরি? ”
“ হ্যাঁ, কিছুটা ওরকমই। "
আমি আবার বললাম।
“ চিন্তা করো না। তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে আমি অর্পিতার বাবার সাথে কথা বলব। তবে একটা শর্ত আছে। নুভাকে ফোন করে একটা কথা বলতে হবে। "
“ আর না স্যার। এমনিই খুব ভয়ে আছি। কখন না জানি আমার নাকমুখ ফাটিয়ে দেয়! "
“ এইটুকু তো করতেই হবে। সামান্য নাকমুখ না ফাটালে প্রেম সার্থক হয় না। তুমি এক্ষুণি নুভাকে ফোন করে বলো। আমি আর অর্পিতা কালকে পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি! "
অর্পিতা মুখে হাত দিয়ে বলল।
“ স্যার, তাহলে আপনাকে মেরেই ফেলবেন ম্যাডাম! "
“ এরকম মনে হচ্ছে তোমার? আমার তো মনে হচ্ছে ভালোবাসাটা আরো বাড়বে। "
ছেলেটা ফোন বের করলো। নাম্বার তাঁর কাছে আছে। আমি যেভাবে বলেছি সেভাবেই সে নুভাকে এই কথাটা বলল। আমি আর অর্পিতা কালকে পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজকে বাড়িতে গেলে অনেক মজাই হবে। নুভার প্রতিক্রিয়া কিরকম হয় এই কথা শুনার পর তা দেখার তর সইছে না আমার।
কলিং বেল চাপার পরপরই দেখি বাড়ির সবাই বেশ মনমরা হয়ে আছে! সুরাইয়ার চোখে পানি! মা চুপ, ভাবী চুপ। হলোটা কী? নীরবতা ভেঙ্গে সুরাইয়া বলল।।।।।
#চলবে,,,,,
0
22