চুক্তির বিয়ে

0 60
Avatar for Koly
Written by
3 years ago

চুক্তির বিয়ে!! - ৭ম পর্ব

.

.

.

দিন যতই যাচ্ছে, ততই মনে হচ্ছে কেউ যেন একটু একটু করে আমার প্রান বের করে নিচ্ছে। আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি! এরপর সব শেষ হয়ে যাবে!! আমার সংসার, আমার পরিবার, আমার বর সবাই কে ছেড়ে অনেক দুর চলে যেতে হবে। আর আমার স্থান এ ইরা আসবে এই পরিবারের বউ হয়ে, অভ্রের স্ত্রী হয়ে আর ওই অভ্রের সন্তানের মা হওয়ার সৌভাগ্য পাবে! বিধাতার কাছে প্রশ্ন! সবাই বলে উনি যা করেন ভালোর জন্যে করেন! তাহলে আমার এই সর্বনাশের পর কোন ধরনের ভালো হবে। এই এক সপ্তাহ আমি আমার শাশুড়ি আম্মু, আব্বু আর অভ্রের সাথে খুব ভালো ভাবে কাটাতে চাই!! প্রত্যকটা দিন আমার জিবনে সরনীয় করে রাখতে চাই। যদি পারতাম এই সপ্তাহ টা কোনোদিন শেষ হতে দিতাম না, কিন্তু কথায় আছে, সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করেনা। তেমনি আমার জন্য ও করবেনা। এতক্ষন ছাদের এক কোনে দাড়িয়ে এইসব ভাবছিলাম। সূর্য অনেক আগেই অস্ত গেছে। কিন্তু আমার কষ্ট আগের মতই আছে।। শাশুড়ি আম্মুর ডাকে নিচে গেলাম। আমি গিয়ে দেখলাম আজ শুশুর আব্বু রান্না করছেন! আমি যেতেই.... , বাবা:------ দেখ তৃষ্ণা মা!! তোমার শাশুড়ি আম্মু আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, আজকে ডিনার আমাকে রান্না করতে হবে! , শাশুড়ি আম্মু:---- খুব তো বলো, রান্না করা নাকি তোমার বাম হাতের খেলা! আজ আমি ও দেখব কেমন খেলা দেখাও! , আমি:---- ছাড়ুন না আম্মু, উনি এইসব পারেন! আমি থাকতে শুধু উনি কেন কষ্ট করবেন। বাবা আপনি আমাকে দিন! , শশুর আব্বু:---- না মা! আজকে আমাকে প্রমান করতেই হবে..... আমি ও কম না! , শশুর আব্বুর জেদের কাছে আমাকে হার মানতে হলো। তাই দাড়িয়ে থেকে ওনার রান্না করা দেখছিলাম! অভ্র অফিস থেকে ফিরে এসে আমাদের সাথে যোগ দিল!! , অভ্র:---- কি ব্যাপার মা?? আজকে বাবুর্চি টাকে চেনা চেনা লাগছে। অনেক টা আমার বাবার মতো দেখতে। বাবার কি ডুপ্লিকেট আছে নাকি?? , শুশুর আব্বু:----হারামি! আমি ডুপ্লিকেট না, তোর বাবার অর্জিনাল কপি! , অভ্র:---- তা বাবা আজকে তোমার ট্রেন হঠাৎ টিবি রুম ছেড়ে কিচেনের দিকে ব্রেক করল কেন? , শশুর আব্বু:---- আমাকে তোর মাদার ইন্ডিয়া চ্যালেঞ্জ করেছে আজকে ডিনার রান্না করে সবাই কে খাওয়াতে হবে! , অভ্র:----- তা তুমি একা করছো কেন? তৃষ্ণা তোমাকে হেল্প করবে! কি ব্যেপার হেল্প করবানা? , আমি:---- আজ ছেলেদের রান্নার চ্যালেঞ্জ আমি কেন হেল্প করব, পারলে তুমি হেল্প করো!( ওনাদের সামনে আমরা একে অপরকে তুমি করে বলি) , অভ্র:----- বেশ তাহলে! বাবা চলো কাজে লেগে পড়ি!! , , আমাকে শাশুড়ি আম্মু টেনে টি,ভি রুমে নিয়ে এলেন। আমরা টি.ভি দেখছি। আর কিচেন থেকে ঠুস!! ঠাস আওয়াজ আসছে!! শাশুড়ি আম্মু একটু হেসে বললেন, , :----- কে যানে আজ কপালে ডিনার জুটবে কিনা? ওনার কথায় আমি ও হেসে দিলাম। বাপ ছেলে ঠিক ৯ টায় খাবার টেবিলে আমাদের ডাকলেন। আমরা গিয়ে তো অবাক, ওনারা অনেক রান্না করেছেন। মাছ,মাংস,সবজি, ডাল,লাচ্ছি আরও অনেক কিছু। আমি আর শাশুড়ি আম্মু তো খেয়ে অবাক। তারা এত রান্না করল কিভাবে আর এত টেস্টি রান্না তো ওনাদের জন্য অসম্ভব। আমি যতটুকু শুনেছি, অভ্র ডিম অমলেট করা ছাড়া আর কিছুই পারেনা। তাহলে আজ এত কিছু। যাইহোক সবাই খাওয়া শেষে নিজেদের রুমে চলে গেল। আমি বাকি খাবার ফ্রিজে রাখতে কিচেনে এলাম। কিচেনে আসতেই ওদের রান্নার সিক্রেট আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল, সব রান্না ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে আনিয়েছে। আর প্যেকেট গুলা ফ্রিজের পিছনে লুকিয়ে রেখেছে, যাতে আমরা টের না পাই! হায়রে কপাল! আমার শশুর আব্বু শেষ পর্যন্ত চিটিং করে চ্যালেঞ্জ জিতলেন। আমি ও প্যাকেট আগের জায়গায় লুকিয়ে রেখে আমার রুমে চলে আসলাম। এসে দেখি অভ্র ল্যাপটপ নিয়ে কি যেন করছে! আমি যেতেই বলল, , অভ্র :---- বাবা মায়ের জন্য হজ্জে যাওয়ার জন্য টিকেট বুক করছি। তুমি কোথায় যাবে ঠিক করেছো?? তাহলে তোমার জন্য ও টিকেট বুক করে দিই। আমার ভিতর টা যেন দুমড়ে মুছড়ে উঠল। আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার এত তাড়া! অভ্রের কথায় ভাবনায় ছেদ হলো, , :---- কি হলো কিছু বলছো না কেন?? , :----- আমাকে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা! সময় মত আমি চলে যাব। আর চুক্তির মধ্যে তো এটা লিখা ছিলনা যে আমি কোথায় যাব, সেটা আপনাকে বলে যেতে হবে! , অভ্র :---- এজ ইউর ওইশ !! গুড নাইট! , এই বলে অভ্র সোফায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি ও গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আর মাত্র ৩ টা রাত আমি এই বাড়িতে আছি। আর মাত্র ৩ দিন পর আমার আর অভ্রের বিবাহ বার্ষিকী। আর এই বিবাহ বার্ষিকীর সবচেয়ে বড় উপহার ওইদিনই আমরা চিরকালের মতো আলাদা হয়ে যাব! অনেকদিন হলো আমার ঘুম আসেনা। আমি সারারাত জেগে কাটিয়ে দিই। এখন ও জেগে আছি ঘুমাতে মন চায়না! কেটে যায় আমার নির্ঘুম রাত। সকাল হলো, অভ্র এখন ও ঘুমাচ্ছে! কিচেনে গিয়ে নাস্তা বানালাম। সবাই উঠে ফ্রেস হলো, নাস্তা করে অভ্র প্রতিদিনের মতো অফিসে চলে গেল। কাল শাশুড়ি আম্মু আর আব্বু চলে যাবেন। তাই ওনাদের ব্যাগ গোছাতে সাহায্য করছিলাম। তখনই, :----- মা!! আমরা যাওয়ার পর অভ্রের খেয়াল রেখো! কখন ও ওকে ছেড়ে যেওনা। তুমি ওর জিবন সাথী। সারাজিবন ওর পাশে থাকবে। কথা দাও আমায়!! , আমি আর কান্না ধরে রাখতে পারলাম না। কেদেই যাচ্ছি, বুঝতে পারছিনা ওনাকে কি জবাব দেব! উনি আমার কান্না দেখে অবাক হচ্ছেন। আমাকে জিজ্ঞাস করলেন। , :---- কি হয়ছে মা?? কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলো!! আমি কি করছি, শেষ মহুরতে আমি অভ্রের ভালবাসা কে হারতে দিতে পারিনা।। আমাকে শক্ত হতে হবে! , :---- না মা! আপনাদের ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হবে তাই! নিঝেদের খেয়াল রাখবেন আপনারা! , :------ হুম তা তো রাখবোই। আমাদের তো বেচে থাকতে হবে, তোর কোলে অভ্রের সন্তান দেখা ছাড়া আমরা কোথাও যাবনা! আমরা এসে যেন সুসংবাদ টা পাই! আমি কিছু না বলে রুমে চলে এলাম। ওনারা আমার উপর এতো দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন আর আমি কিনা একটা ও পুরন করতে পারবোনা। আরেকটি নির্ঘুম রাত শেষে সকাল হলো। বাবা মা রেডি হয়ে বের হচ্ছেন। অভ্র তাদের এয়ারপোর্ট অবদি এগিয়ে দিয়ে আসবে। ওনারা শেষবারের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। মন ভরে তাদের দেখে নিচ্ছি, হৃধয় ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আজ সব হারিয়ে যাবে আমার কাছ থেকে। আমি আর সেখানে দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। অভ্র ওনাদের নিয়ে চলে গেল। আমার কাল যাওয়ার কথা, কিন্তু না আমি অভ্র কে আর আমাকে নিয়ে ঝামেলা করতে দেবনা! দীর্ঘ এক বছর আমাকে সয্য করেছে ও। আমি ওকে আর কষ্ট দিতে পারবোনা। হ্যা আজকেই চলে যাব আমি। অভ্র ফেরার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে আমায়। আমি যত দ্রুত চলে যাব অভ্রের জিবন থেকে ততই তাড়াতাড়ি ইরা অভ্র কে পাবে। আমি আর দেরি করলাম না ব্যাগ ঘুছিয়ে একটা চিঠি লিখলাম অভ্রের জন্য, , অভ্র বাবু, জানি আপনাকে প্রিয় বলার অধিকার আমার নেই। আপনি এতদিন আমার জন্য যা করেছেন, তার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনার আর ইরার মাঝে একমাত্র বাধা আমি ছিলাম। আর চুক্তি অনুযায়ি কাল আমার অভিনয় শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু আমি চাইনা আমাকে নিয়ে আপনার আর ঝামেলা হোক। আমি আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী আপনার জিবন থেকে অনেক দুর চলে যাব। আমি চাই আপনি ইরাকে খুব শিঘ্রিই বিয়ে করেন। আর নতুন করে সংসার করুন। আর আমার মত অপয়ার কথা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভুলে যাবেন। দুঃখীত আপনাকে না বলে চলে যাচ্ছি। ভাল থাকেবেন। নিঝের আর বাবা মায়ের খেয়াল রাখবেন। ইতি, আপনার চুক্তির বউ! , চিঠি টা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে রুমে থেকে বের হলাম। আমি জানি অভ্রের ফিরে আসতে এখন ও ঘন্টাখানেক দেরি আছে, তাই বাড়ি টা একটু শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছি। ঘরের প্রত্যকটা কোনা নিজের হাতে সাজিয়েছি। আর আজ সব রেখে চলে যাচ্ছি। খুব মিস করবো এই বাড়ি টা কে আর এই বাড়ির সবাইকে। রাস্তায় এসে আরো একবার পিছন ফিরে তাকালাম। বিধায়!! মানুষ বাবার বাড়ি থেকে বিদায় হয়ে শুশুরবাড়ি আসে, আর আমি শুশুরবাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চিরতরে চলে যাচ্ছি! না আর দেরি করে লাভ নেই। কোথায় যাব জানিনা তবে হাতে বিশ হাজারের মত টাকা আছে। এগুলা অভ্রের দেওয়া নয়, শশুর আব্বু, আমার রান্নায় খুশি হয়ে মাঝে মাঝে আমায় টাকা দিতেন। ওগুলা জমিয়ে রেখেছিলাম অসময় কাজে লাগবে ভেবে। , একটা অটো তে উঠে বসলাম। স্টেশন যেতে বললাম। কোথায় যাচ্ছি জানিনা তবে এইটুকু জানি অভ্রের জিবন থেকে অনেক দুর চলে যেতে হবে অনেক দুর!!! ওর সুখের মাঝে আর বাধা হয়ে থাকতে পারবনা আমি! দেখতে দেখতে স্টেশন চলে এলো। ড্রাইবার অনেকক্ষন ধরে নামতে বলছে, আমার সেদিকে মন নেই! নিজে থেকে নেমে ড্রাইবারের পাওনা মিটিয়ে স্টেশনের ভিতরে গেলাম। মন যেদিকে সায় দিবে সেখান যাব। হঠাৎ একটা দৈনিক পত্রিকা উড়ে এসে পায়ে পড়ল। তুলে দেখলাম এটা চটগ্রামের পত্রিকা! ঠিক করে নিলাম চটগ্রামেই যাব। যদি ও সেখানে কোনো আত্তিয় নেই। না থাকাই ভালো কারো ওপর বোজা হয়ে থাকতে চাইনা আর। যেকোনো কাজ করে খাবো, আমি অনার্স করেছি ইংলিশের উপর। কিছু একটা হয়ে যাবে! চট্রগ্রামের টিকেট নিয়ে ট্রেন এ উঠলাম! ট্রেন চলা শুরু করল। জানালা দিয়ে ফোনের সিম খুলে ফেলে দিলাম। কি দরকার পুরোনো মায়ায় জড়িয়ে থাকার! ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম দুপুর ১২ টা বাজে। অভ্র হয়ত এতক্ষনে বাসায় চলে এসেছে। আমি চলে গেছি দেখে হয়ত মনে মনে খুশিই হবে। যাইহোক আমি তো আমার কথা রেখেছি, ওকে ওর ভালবাসার কাছে পৌছে দিয়েছি! সবদিক দিয়ে হেরে গেলেও এইদিক দিয়ে জিতে গেছি! মনে মনে একটা শান্তি অনুভব করলাম।

.

.

.

চলবে

1
$ 0.00
Avatar for Koly
Written by
3 years ago

Comments