কালো মেয়ে

1 4
Avatar for Koly
Written by
3 years ago

আমার কালো মেয়েটাকে একটু আগেই, রাজপুত্রের মত ছেলের কাছে বিয়ে দিলাম। পুরো মহল্লার সবাই মাতামাতি করছে। রানার মেয়েটা এত সুন্দর জামাই পেয়ে গেলো। সবাই যখন আহামরি করে, দেখে আমার ভিতরে আনন্দের শেষ নেই।

এইতো ২৭-২৮ বছর আগের কথা। বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসলাম সুরাইয়াকে। দুজনের বিবাহ জীবন ভালো কাটছে। একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরলে দেখি সুরাইয়া অনেক খুশী। আমিও তার মুখ দেখে বুঝে যেতাম কি হয় তার মনে। আমি জানতে চাইলাম তার খুশীর কারণ কি?

সে বললো আমি বাবা হবো। কতটা খুশী হয়ে ছিলাম, তা বলে বুঝাতে পারবো না। জীবনে সবচেয়ে আনন্দময় সময়, যখন প্রথম সন্তানের পিতা হওয়ার কথা শুনে। সুরাইয়াকে সে খুশীতে একটা লাল শাড়ি এনে দিয়ে ছিলাম। সুরাইয়া শাড়ীটা হাতে নিয়ে বলে যদি মেয়ে হয়। এই শাড়ীটা পরিয়ে বিয়ে দেবো মেয়েকে আর ছেলে হলে ছেলের বউকে দিবো। সে দিন অনেক হেঁসে ছিলাম তার কথা শুনে।

দেখতে দেখতে সুরাইয়ার বাচ্চা হওয়ার সময় হলো। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, যদিও আমার পরিবারের কেউ চাইছে না। সবাই বলে টাকা আছে বলে নাকি এত আল্লাদ বউকে।

বড় ভাইয়ের বড় খোঁচা মেরে নানান কথা বলে।

হাসপাতালে নিয়ে গেলে সবাই থাকে হাসপাতালে। বাবা, মা, সবাই চায় ছেলে হউক। ঘন্টা খানিক পরই ডাক্তার বলে মেয়ে হয়েছে। আমি অনেক খুশী হয়েছি।

সবার মুখ তখন দেখার মতো না। ডাক্তার মেয়েকে এনে আমার কোলে দিলো। গায়ের চামড়া কালো। আমারই মেয়েতো, সবাই দেখে বলে কালা মাইয়া হইছে রানার। এত কালা মানুষ হয়? বড় ভাইয়ের বউয়ের মুখে এই কথা শুনে, কিছু বলি নাই তখন। আমার পরিবারের কেউ মেয়েটাকে কোলে নিলো না।

সুরাইয়া ও মেয়েকে একাই নিয়ে আসি বাসায়।

কালো মেয়ে বলে সবাই নানান কথা বলে। আর এইসব শুনে সুরাইয়াও ভেঙে পড়ে। আমি আমার মেয়েকে ভালবাসায় কমতি রাখি নি। বড় হচ্ছে আস্তে আস্তে। নাম রাখলাম দুজনের সাথে মিল রেখেই , "সুমাইয়া ইসলাম রাইসা। "

মেয়ের নাম সবার কাছে কালি হয়ে ছড়ালো। সবাই কালো বলে ডাকে কালি। সবার মুখতো আর আটকে রাখতে পারি না। বয়স যখন ৪বছর। রোজার ইদের দিন। বাবা সব নাতী-নাতনীদের টাকা দিচ্ছে।বড় ভাইদের ছেলে-মেয়েদের টাকা দিছে আমার মেয়েটাকে একটা টাকাও দেয় নাই। এটাই বলে, কালি তুই টাকা দিয়ে কি করবি যা।

মেয়েটা আমার কাছে এসে বলে বাবা টাকা। আমি সেদিন শত টাকার ৫টা নোট দিয়ে ছিলাম মেয়েকে। একটা পরিবার অনেক ভালো করে চলতে পারে ৫শত টাকা দিয়ে সে সময়। আর আমার আয় ছিলো তখন ৩০হাজার টাকা। আল্লাহ সব দিয়েছে মেয়ে কালো বলে সবার কটু কথায় কষ্ট পেতাম আর কিছু না।

মেয়েটা তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে । ইদের দিনই আগের মতোই বাবা টাকা দেয় নাই। অথচ মাসিক বাবা-মাকে ২-৩হাজার টাকা দিতাম আমি। আর আমার মেয়েকে টাকা দিতো না। টাকা না পেয়ে মেয়েটা এসে কান্না করে। বুঝতে শিখে গেছে কেনো কেউ পছন্দ করে না।

এভাবে চলতে থাকলো। আরেকটা ছেলে হয় আমার। নাম রাখলাম আরিয়ান। একেবারেই সুরাইয়ার মতো সুন্দর। যেনো মায়ের চামড়া দিয়ে তাকে বানানো।

একদিন এক বন্ধু হাসি দিয়ে বলে, "রানা তোর মেয়ে এত কালো। ভাবি কি পরকীয়া করছে নাকি? তুই সুন্দর, ভাবিও, মেয়ে কালো কেন?"

সেদিন একটা চড় মেরে বলেছি, "আল্লাহ যাকে যেমন বানায়। সাদা কালো সব আল্লাহর হাতে"

সেদিনই সেই বন্ধুত্ব শেষ। পরে অনেক ক্ষমাও চাইছে। বলে মজা করে বলছে।

সবাই নানান কথা বলতো রানার মেয়ে কালো, এন তেন।

মেয়েটা দেখতে দেখতে এস এস সি পরীক্ষার দিয়ে ফেলছে। পুরো চট্টগ্রাম বোর্ডে প্রথম হয়েছে। আমাদের জেলা খাগড়াছড়ির স্থানীয় পত্রিকা গুলো বড় বড় করে লেখে আমাদের খাগড়াছড়ির গর্ব "সুমাইয়া ইসলাম রাইসা"

কিছুদিন পরই স্কুলে সম্মানিত করতে সকল পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক দের ডাকা হলো। যারা ভালো করছে তাদের পুরষ্কার দেওয়া হবে।

আমিও সে দিন মেয়ের সাথে গিয়ে ছিলাম। আমরা বাবা মেয়ে একসাথে বসে আছি।

পিছনে শুনি এক মহিলা বলে, কেমন কালা মাইয়া রে বাবা। তাও আবার অনুষ্ঠান দেখতে আসছে হা হা হা।

আমি রাইসার দিকে তাকিয়ে দেখি চোঁখে পানি টলমল করছে,পিছনের কটু কথা শুনে।

আমি মেয়েকে বললাম একটু পরই তারাই হাতে তালি দিবে।

কিছুক্ষণ পরই ঘোষণা করে,"সুমাইয়া ইসলাম রাইসা আমাদের খাগড়াছড়ির গর্ব। যে পুরো চট্টগ্রাম বোর্ডে সেরা হয়ে আমাদের জেলার নাম উজ্জ্বল করছে। এখন আমাদের জেলার এমপির হাত থেকে সংবর্ধনা পুরুষ্কার নিবে তার বাবার সাথে এসে।

আমি ও রাইসা উঠে মঞ্চের দিকে যাচ্ছি তখন পিছিনে বসা মানুষ গুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রাইসার দিকে। সেই দিনই রাইসার মন শক্ত হয়ে গেলো।

বাসায় এসে বললাম, মা তুমি যদি ভালো কিছু করো, তাহলে যার সমালোচনা করে, তারাই তোমার জন্য হাত তালি দিবে।

মেয়ে বলে তখন বাবা আমি এমন কিছু হবো যাতে অনেক সুন্দর -সুন্দরী এসে আমার সাথে দেখা করতে সিরিয়াল দিতে হয়।

আমি তখন এটাই বলি, এমন কিছু করো যাতে অন্যজন করার মতো হতে না পেরে আফসোস করে।

মেয়েটাকে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজেই ভর্তি করিয়ে দেই। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে জিপি-৫ পেয়ে। এক মাস কোচিং করে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেয়ে যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়। অনার্স ৪র্থে বর্ষে একবার বলে, তারই সময় বয়সী একজন তাকে পছন্দ করে। রাইসাকে বিয়ে করতে চায়। তখন মেয়েকে এটাই বললাম। ইসলামে যা নিষেধ করছে এমন কিছু করো না। আল্লাহর পথে থেকেই নিজের লক্ষ্য পুরুন করো। আগে ক্যারিয়ার গড়ো। দুজনই ক্যারিয়ার গড়ে নাও তারপর ভাববো,তাকে বলো।

মেয়েও তেমনই হয়তো বলছে। পড়াশোনা শেষ করেই বিসিএস দেয়। সেই ছেলে আর রাইসা দুজনই পাশ করে ফেলে বিসিএস। ছেলেটাও আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের। রাইসা উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে যোগ দেয় আমাদের জেলায়ই রামগড়ে। সরকারি বাড়ি, গার্ড সবই দেওয়া হলো।

আমার গর্ব হতে থাকলো মেয়েকে নিয়ে। যারা কালো বলছিলো তাদের সুন্দরী মেয়েরা, কোন প্রেম ভালোবাসা করে বাড়ি ছাড়ছে। আমারই বড় ভাইয়ের মেয়ে কয়েক বছর আগে এক নেশাখোরের সাথে পালিয়ে গেছে সুন্দরী বলে কথা। তার মা সেইদিন রাইসার জন্মের পর নানান কথা বলে।

আমি ও সুরাইয়া চলে গেছি তখন মেয়ের কাছে বাড়িতে ছেলে থাকে তার দাদীর সাথে। ও কলেজ পড়ে তাই নিতে পারি না। আর মেয়েকেও একা থাকতে দেওয়া যায় না।

একদিন রাইসার অফিসে গিয়ে দেখি কতজন ছেলে -মেয়ে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছে। যে মেয়ে গুলো আছে, তারা চেহারা দিয়ে মিস বাংলাদেশ হবে এমন। আর রাইসার চেহারা মায়ের মতো ভাল হলেও গায়ের রং কালো। তা নিয়েই সবাই মাতামাতি করতো।

আমি রাইসার কবিনে গিয়ে বললাম বাহিরে তারা কেন? রাইসা হেসে বললো, বাবা তোমার কালো মেয়ের সাক্ষর ছাড়া তাদের চাকুরী হচ্ছে না। বাপ মেয়ে অনেক হাসলাম।

কয়েক মাস পরই সেই ছেলে হাসান কুমিল্লা থেকে বাপ মা নিয়ে আসলো রাইসাকে বিয়ে করবে বলে। হাসান সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করে। বিয়ের পরই বদলি হয়ে রামগড় সরকারি কলেজে চলে আসবে। এখানেই সবাই থাকবে।

সব কিছু ভেবেই বিয়ে দিয়ে দিলাম হাসানের কাছে। হাসান একবারেই দেখতে রাজপুত্রের মতো। অনেক ভালো শান্তশিষ্ট। বউ নিয়েই হেলিকপ্টার করে উড়ে গেলো একটু আগে কুমিল্লার দিকে। বাকি আত্মীয় স্বজনরা গাড়ি করে চলে গেছে।

আজ সবার হাহাকার দেখে অনেক ভালো লাগছে। কালো মেয়ে মানেই যে কিছু পারবে না এমন নয়। আমার ও সুরাইয়ার ভালবাসায় রাইসা এত দূর গেলো। তা না হলে কটু কথায় অনেক আগেই ভেঙে পড়তো মেয়েটা।

কালো মেয়েকে আজ হাজার মানুষ ম্যাডাম ম্যাডাম বলে ডাকে। আজ মেয়ের বিয়েতে কষ্ট লাগেনি। কষ্ট লাগছে মেয়েটাকে যখন কালো বলতো সবাই তখন।

সমাপ্ত।

গল্প -কালো মেয়ে।

1
$ 0.00
Avatar for Koly
Written by
3 years ago

Comments

Asole amader somaj bebeosthar e dosh... Kalo sada lomba bete diye manush bichar hoy ekhane... Nice article...

$ 0.00
User's avatar Apu
3 years ago