সন্দেহ
পর্বঃ_১২
চিঠিতে লেখা ছিলো,,,,,
হৃদয়ের অদৃশ্য শূন্য ডায়েরীর পাতায় অনেক কথা জমা হয়ে আছে কিন্তু কীভাবে লিখবো বুঝতে পারছিনা। আছে শুধু বুক ভরা এক নদী কিংবা পাহাড় সমান কষ্ট।
তবুও লিখছি কারণ এই মূহুর্তটাই আমার জীবনের শেষ মূহুর্ত,,,শেষ সময়। জানিনা আমার মতো একটা প্রতারক,,বিশ্বাস ঘাতকের লেখা এই এক টুকরো কাগজে তুমি কতটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়বে আমার জানা নেই। তবে না পড়লে ও কোন ক্ষতি নেই। ইচ্ছে করলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারো। একটু ও কষ্ট পাবোনা আমি। কারণ আমি ততোক্ষণে দূর আকাশের তারা হয়ে যাবো। এই পৃথিবী ছেড়ে অনেক,,,,অ-নে-ক দূরে চলে এসেছি। মেঘলা তুমি আমাকে এতটা অবিশ্বাস করবে আমি কখন ও ভাবতে পারিনি?? প্রকৃত সত্যিটা হয়তো আজকে তুলির কাছ থেকে জানতে পারবে। আমি শুধু এটাই বলবো আমার কোন দোষ নেই। আমার দোষ শুধু এতটুকু তোমার কথা আমি ফেলতে পারিনি। কারণ তোমাকে যে কসম করে বলেছি।
বিদায়ের বেলায় আজ কত কথা যে মনে আসছে মেঘলা,,,,কত সহস্র স্মৃতি চোখের সামনে ভিড় জামাচ্ছে ভাবতেই বুকটা ফেটে যেতে চাইছে। আর সেসব কথা বলেই বা লাভ কী?? সবতো শেষ হয়ে গেছে। দুঃখ শুধু একটাই মৃত্যুর আগে তোমার কাছে মনের কথাগুলো বলতে পারলাম না। কত আসা ছিলো তোমার হাত ধরে দুজনে একসাথে সংসার করবো। তোমার কোল জুরে আমার সন্তান খেলা করবে। সব আসাগুলো আজ ফিকে হয়ে গেলো।
বিয়ের পরে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। সন্দেহ করেছি। কিছুদিনে আগে যখন ভালোবাসতে শুরু করলাম ঠিক তখনই সেই সুখ আমার ভাগ্যে সইলো না।
মেঘলা তুমি হয়তো ভাববে আমি ভিরু কাপুরুষ তাই আত্মহত্যা করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো এছাড়া আমার কোন পথ ছিলোনা। তুমি নিজেই আমাকে এই পথ বেছে নিতে বাধ্য করেছে। আমি তুলিকে কখন ও মেনে নিতে পারতাম না।
আর একটা সহজ সরল মনের মেয়েকে কীভাবে আমি সারাজীবন ঠকাবো??? আমার প্রতিটা শিরা- উপশিরায় এমন কী রক্তে ও তোমার নাম লেখা। আর তাকে হারিয়ে আমি নতুন করে কারো সাথে সংসার করতাম কীভাবে??
মেঘলা আমার সাথে তুমি তুলিকে ও ক্ষমা করে দিও। আমি এখানে তুলির দোষ দেখছিনা। আসলে তুলি খুব ভালো মেয়ে। হয়তো ওর দোষ শুধু এতটুকু যে ও আমাকে পাবার জন্য বানিয়ে বানিয়ে তোমার কাছে মিথ্যা কথা বলছে।
""ভালো থেকো"" আজ আর একথা বলবোনা। কারণ বললেও তুমি আর কোনদিন ভালো থাকতে পারবেনা। প্রিয়জনের মৃত্যুর পর কেউ কোনদিন ভালো থাকতে পারবেনা। আমি তোমাকে কোন দিন ক্ষমা করবোনা মেঘলা,,,কোনদিন ক্ষমা করবোনা। আমার জীবনের সব কষ্টের বোঝাগুলো আজ আমি তোমায় উপহার দিয়ে গেলাম। আমার একটাই মাত্র কামনা যে কষ্টের বোঝা তুমি আমাকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলে,,,,এখন সেই কষ্টের বোঝা সারাজীবন তুমি বয়ে বেড়াবে। আর কিছু চাইনা আমি। তোমার কষ্টই হবে মৃত্যুর পরে আমার
সুখ।
ইতি,,,,,
নীল
চিঠি পড়া শেষ হতেই আবার ও কান্নায় ভেঙে পড়ে মেঘলা। নীল তুমি এটা কী করলে?? শুধু কী আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য???তোমাকে হারিয়ে কী আমি সুখে থাকবো?? এত অভিমান করবে আমি বুঝতে পারিনি। আমি তো তুলির কথা বিশ্বাস করেছি। ভাবিনি প্রেগন্যান্ট হওয়ার ব্যাপারটা এতটা গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে। হয়তো এটাই আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল। এ ভুলের মাশুল আমাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। কিন্তু তুমি আমাকে একেবারে নিঃশ্ব করে দিয়ে চলে গেলে। তোমাকে ছাড়া আমি কীভাবে বাঁচবো বলো?? তুমি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও।
সারাটা দিন প্রায় কাঁদতে কাঁদতে কেটে যায় মেঘলার। এ কান্নার শেষ কোথায় জানা নেই তার। নিজের জীবনে এত কষ্ট লেখা থাকবে কোনদিন কল্পনাও করেনি।
চিঠির উল্টো পিঠে নীল বিশেষভাবে লিখেছে""কেঁদো না মেঘলা। এখনই এতো কাঁদলে চোখের পানি শুকিয়ে যাবে যে। তাহলে সারাজীবন ধরে কীভাবে কাঁদবে??
এই অংশটা মেঘলা যতবার পড়ছে ততবারই তার বুকের ভিতর থেকে হুহু করে কান্না বেরিয়ে আসছে। কথাটা নীল প্রচন্ড অভিমানে কটাক্ষ করে লিখেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মেঘলার ও প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে নীলের প্রতি। অভিমানী মন বারবার কেঁদে উঠে বলছে,,,নীল তুমি কী সত্যি চাও আমি সারাজীবন ধরে কাঁদি??? কেনো নীল?? আমি কাঁদলে তুমি সুখ পাবে?? তাই যদি হয় তাহলে তো এখন নিশ্চয় খুব সুখে পাচ্ছো?? আমি ও তাই চাই নীল,,তুমি সুখ পাও। আমার যত কষ্টই হোক আমি কাঁদবো। সারাজীবন আমি কেঁদে কেঁদে তোমায় সুখ দিবো।
শেষবারের মতো বলছি নীল তুমি আমার বুকে ফিরে আসো। কথা দিচ্ছি দ্বিতীয়বার তোমাকে কিছু বলার সুযোগ দিবোনা।
.
পরপর কয়েকদিন একটানা অর্ধহারে অনাহারে এমনিতেই মেঘলার শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেছে।
নীলের মৃত্যু তার জীবনের সবচেয়ে বড় দূর্ঘটনা,,,সবচেয়ে দামী জিনিসটা হারিয়ে ফেলেছে।
ক্লান্ত শরীরে অনেকটা কষ্টের মাঝেও শেষ রাতে মেঘলার চোখে কখন যে ঘুম এসে যায় বুঝতে পারেনা সে। আজ কয়েকদিন অনেক চেষ্টা করেও সে সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। আজ হঠ্যাৎ ঘুমিয়ে পড়তেই নীল এসে সামনে দাঁড়ায়। ঠিক সেই পুরনো ভঙ্গি,,,পরিপূর্ণ বিনয়ীভাব।
হঠ্যাৎ চমকে উঠে ঘুম ভেঙ্গে যায় মেঘলার। তন্দ্রার আবেশে হাত বাড়িয়ে এদিক ওদিক কী যেনো খোঁজে। কিন্তু পুরোপুরি সজাগতা ফিরে আসতেই ভুল ভেঙে যায় তার। মনে পড়ে নীল আর নেই,,কোনদিন আসবেনা তার কাছে। চিরদিনের জন্য এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে নীল। আর কোনদিন তার সামনে এসে ওইভাবে দাঁড়াবে না।
মেঘলার বুকটা হাহাকার করে ওঠে। প্রচন্ড ব্যাথায় বুকের ভেতর একবার কঁকিয়ে ওঠে। মনে মনে বলে,,,নীল,,আর কতো কষ্ট দিবে আমাকে?? তুমি কী আমাকে একটু ও ঘুমাতে দিবেনা?? বলতে বলতে মেঘলা বিছানায় মুখ লুকিয়ে খুঁক্ খুঁক্ করে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে বালিশের একাংশ ভিজিয়ে ফেলে।
হঠ্যাৎ নীলের মায়ের ঘুম মেঘলার কান্নার শব্দে ভেঙে যায়। উঠে এসে মেঘলার রুমে ঢুকে দাঁড়িয়ে চুপ করে মেঘলার কান্না দেখেন।
তারপর আস্তে আস্তে মেঘলার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বণা দিয়ে বললো,,, মেঘলা তুই আর কাঁদিসনে। একটু ঘুমাতে চেষ্টা কর। এভাবে কাঁদলে তুই মারা যাবি।
.
মেঘলা মায়ের বুকের মাঝে মুখ লুকায়। কাঁদতে কাঁদতে বললো,,,,মা,,,আমি ঘুমাতে পারছিনা।
-"কাঁদিসনে মা। তোর কষ্ট আমি বুঝি,,,কিন্তু কী করবো?? আমার ছেলেটা যে এত বড় ডিসিশন নিবে আমি কল্পনা ও করতে পারিনি।
মেঘলা আস্তে আস্তে কান্না থামাতে চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পরে কান্না থামিয়ে চোখ মুছে বললো,,,মা আমাকে একটু ছাদে নিয়ে যাবে?? খুব ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে।
নীলের মায়ের বুকটা কেমন যেনো ভয়ে কেঁপে ওঠে।
-"এতো রাতে ছাদে যাবি??? এখনো তো রাত পোহায়নি মেঘলা?? সকাল হলে তারপরে যাস।
-"ভয় পেয়োনা মা। আমি নীলের মতো করবো না।
মেঘলা নীলের মায়ের কাঁধে ভর করে আস্তে আস্তে ছাদে যায়। তারপর মাকে বলে চলে যেতে। নীলের মা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে নিচেই নেমে আসেন।
মেঘলার বুকটা হাহাকার করে ওঠে। তারপর চেয়ারের উপরে হেলান দিয়ে ভাবে,,,দিনের পর দিন নিঃসঙ্গতার প্রহর গুনতে হবে তাকে।
মেঘলা উদাসীন ভাবে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। গন্তব্যহীন দৃষ্টি আকাশের অসংখ্য তারাদের মাঝে হারিয়ে যায়। চোখদুটো আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিন নীলের সেই করুণ,,মলিন মুখটা। নীল কতবার কাকুতি মিনতি করে বলেছিলো,,মেঘলা বিশ্বাস করো,,,সত্যি আমার কোন দোষ নেই। আমাকে তুমি ভুল বুঝোনা।
মেঘলার চোখ দুটো ভারী হয়ে আসে। আমি সত্যি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। ক্ষমা করে দাও আমাকে।
মেঘলার বুকটা হঠ্যাৎ ডুঁকরে কেঁদে ওঠে।
ফজরের সুমধুর আযানের ধ্বনি কানে আসতেই ছাঁদ থেকে নিচে নেমে এসে ওয়াশরুমে ঢুকে ওজু করলো মেঘলা। তারপরে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে শুধু একটাই চাওয়া নীলকে যেনো ফিরে পায়। জায়নামাজে বসেই ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলো মেঘলা।
নীলের মা রুমে এসে কখন জানি দাঁড়িয়ে আছে।
হঠ্যাৎ মেঘলার চোখ পড়তেই চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো,,,একি মা আপনি এখানে?? এখন ও ঘুমাননি??
নীলের মায়ের চোখ ভর্তি টলমল করছে জলে। আমার চোখের সব ঘুম তো নীল কেড়ে নিয়েছে। এখন নীলকে হারিয়েছি কিন্তু তোকে তো হারাতে চাইবোনা। তোর সামান্য একটু মন খারাপ দেখলে,,,,তোর চিন্তায় অস্থির হয়ে যাই। আর দিন রাত তোর এই অবস্থা দেখলে আমি কী করে ঘুমাই তুই বল??
আপনি শুধুশুধু চিন্তা করছেন মা। আমার কিচ্ছু হয়নি। আমি খুব ভালো আছি।
নীলের মায়ের কন্ঠে এবার অন্যরকম সুর। ভালোই যদি থাকিস তাহলে খাওয়া দাওয়া করিস না কেন?? কেন সবার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদিস?? ভেবেছিস আমি কিছু বুঝিনা?? একটা কথা মনে রাখিস সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে পারবিনা।
আমার শুধু একটাই আফসোস,,,,,তুই কেনো এমন করলি মা?? কেনো জোর করে নীলের সাথে তুলির বিয়ে দিতে চাইলি?? নীল তো তোকে বারবার বুঝানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তুই যদি একটিবার নীলের কথাটা শুনতি?? তাহলে হয়তো আজকে আমার ছেলেটা বেঁচে থাকতো।
মেঘলা মায়ের সামনে চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করে,,কিন্তু পারেনা। অশ্রুসিক্ত চোখে বললো,,,,মা আমি তো তুলির মিথ্যে কথাগুলোকে সত্যি মনে করেছিলাম বলতে বলতেই নীলের মায়ের পা জড়িয়ে ধরে বললো,,,,
মা আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। আমার ভুলের কারনেই আজকে আপনি আপনার ছেলেকে হারিয়েছেন।
-"মেঘলা একদম চুপ। নীলের মৃত্যুর কথা বলিসনা। নীলের যতক্ষণ পর্যন্ত লাশ না পাওয়া যায় ততোক্ষণ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করবোনা নীল মারা গেছে।
আবার যদি কোন উল্টা পাল্টা কথা বলিস তাহলে তুই আমাকে আর মা বলে ডাকবিনা।
নীলের মাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো মেঘাল।
.
কিছুক্ষণ পর মেঘলা বললো,,,
মা আমার মনটা ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেছে। ভাঙা মন নিয়ে বেঁচে থাকা কী যায় মা??? বলতে বলতে মেঘলা দুই হাতের তালুতে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে।
নীলের মা মেঘলার মুখটাকে নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিলো। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত্বণা দিতে থাকেন।
.
পরেরদিন সন্ধ্যার পর থেকে মেঘলার গায়ে প্রচন্ড জ্বর উঠলো। জ্বরে সমস্ত শরীর যেনো পুড়ে যাচ্ছে। নীলের মা অনবরত মেঘলার মাথায় পানি ঢালতে থাকেন। সেই থেকে বারবার গা হাত মুছে দেন। কিন্তু কিছুতেই জ্বর কমছেনা। শরীরের তাপমাত্রা যেনো ক্রমেই বাড়তে থাকে। জ্বরের ঘোরে মেঘলা শুধু আবল তাবোল বকতে থাকে।
বারবার নীলের কথা বলে,,,,মা নীল কোথায়??? নীল আসবেনা?? ও এখন ও আসছে না কেনো??
ওকে একটা খবর দাওনা প্লিজ! এসব বলতে বলতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে মেঘলা।
নীলের মা কিছুই বলতে পারছেনা। দুচোখে তার শুধুই অশ্রু। নীলের পুরো পরিবারেই শোকের ছায়া।
মেয়েটার সামনেই আসতে পারছেনা তিনি। ভিতরটা তার হু হু করে কেঁদে উঠছে।
অনেক রাতে মেঘলার শরীর থেকে জ্বর ছেড়ে যায়। সাথে সাথে ঘামে সমস্ত শরীর ভিজে যায় তার।
নীলের মা বুঝতে পেরে ভেজা তোয়ালে দিয়ে জামার নিচে,,,হাত-পা ভালো করে মুছে দেন। বেশ কয়েকবার হাত-পা ধরে নাড়াচাড়া কারায় ঘুম ভেঙে যায় মেঘলার।
চোখ মেলে তাকাতেই মেঘলা বলে ওঠে,,,,মা,,নীল আসেনি?? ওকে একটু আসতে বলেননা।
হঠ্যাৎ কল্পনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসে মেঘলার চোখ দুটো আবার জলে ভরে যায়।
মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,,,,মা নীল আর আসবেনা??? ও আর কোনদিন আমার কাছে আসবেনা। বড্ড অভিমান করেছে।
বলতে বলতে মেঘলা আবার ও কান্নায় ভেঙে পড়ে।
নীলের মায়ের ও চোখ পানিতে ছলছল করে।
মেয়েটা সত্যি নীলের জন্য' পাগল হয়ে যাবে।
এখন ওকে নিয়ে কী করবে সে??
মেঘলার শরীরটা দিনদিন আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া ও ঠিক মতো করছেনা। মুখে কোন রুচি ও নেই তার।
মাথাটা ঝিমঝিম করছে মেঘলার।
নীলের মা এসে মেঘলার কাছে বসলো। মেঘলা খাটের উপরে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে।
মাকে দেখে বিছানা ছেড়ে নেমে ওয়াশরুমে যেতে নিলে মাথায় চক্কর কেটে পরে যেতে নিলো। ঠিক তখুনি নীলের মা মেঘলাকে সামলে নিলো। কিন্তু ততোক্ষণে মেঘলা সেন্সলেস হয়ে গেছে।
তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স খবর দিলো।
কিছুক্ষণ পরে এম্বুলেন্স এসে মেঘলাকে হসপিটালে নিয়ে গেলো।
ডক্টর সব পরিক্ষা করে বললো পেশেন্টের শরীর রক্তশূন্যতা হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে পেশেন্টকে বাঁচানো সম্ভব হবেনা। পেশেন্টের জ্ঞান ফিরলে যেভাবে হোক খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
এখন আমরা আপাতত স্যালাইন দিচ্ছি শরীরে। তারপর সুস্থ হলে ২ ব্যাগ ব্লাড দেওয়া লাগতে পারে।
মেঘলার শরীরে স্যালাইন চলছে। স্যালাইনের ব্যাগ মেঘলার বেডের পাশে স্টান্ডের সাথে ঝুলানো।
নীলের মায়ের মায়ের চোখ পানিতে টলটল করছে।
একটুপরেই তনু আপু দৌড়ে আসে। মেঘলার এমন অবস্থা দেখে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,,,মা এসব কী হচ্ছে?? নীলকে হারিয়েছি এখন মোঘলাকে ও হারাতে বসেছি। মেঘলা খাচ্ছেনা কেনো??? ওর সমস্যা কী??
ওর জ্ঞান আসুক তারপরে ও কেনো এমন করছে সেটা জিজ্ঞাস করবো। ওর পা ভেঙে দিবো।
কিছুক্ষণ পরে মেঘলার জ্ঞান ফিরে আসলে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলো।
চোখদুটো বড়বড় করে তাকিয়ে রুমের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। তনু আপুকে দেখে হাসছে মেঘলা।
নীলের মা তো পুরো অবাক হয়ে যায় এতদিন পরে মেয়েটির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
তনু আপু মুখটা ঘুরিয়ে অন্য পাশ করে তাকায়।
-"আপু,,, তুমি এসেছো?? কতদিন পরে তুমি আমাকে দেখতে এলে?? আজ যদি আমি মরে যেতাম তাহলে.....
রাগি লুকে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বললো,,,থাপ্পর মেরে তোর দাঁতের কপাটি গুলোসহ খুলে দিবো। হারামী। মনে চাচ্ছে তোকে খুন করতে। তোকে মরার জন্য কী আমার ভাইয়ের জন্য এনেছিলাম। আজ আমার ভাই নেই তাই বলে কী তোকে আমরা ফেলে দিবো??
কখন ও না। মেঘলা তোর এমন অবস্থা আমি আর দেখতে পারছিনা। তোর বয়স তো অনেক কম। সামনে তোর উজ্জল ভবিষৎ পড়ে রয়েছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোকে আমি আবার কোন ভালো ছেলের হাতে তুলে দিবো। যে সব কিছু যেনে শুনে তোকে গ্রহণ করবে। আমি চাই তোকে আবার ও লাল শাড়ি পড়ে ঘুরে বেড়াতে।
-"কী বলছো আপু?? না এটা হয়না। আমি নীলের জায়গায় কাউকে জায়গা দিতে পারবোনা। দরকার হলে মরে যাবো। আমার শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরায় নীলের ভালোবাসার ছোঁয়া আছে। আর সেই পবিত্র শরীরে অন্য কারো ছোঁয়া আমি মেনে নিতে পারবোনা।
-"নীলের মা মেঘলার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,,,মা রে তনু ঠিকি বলেছে। আমি ও তনুর মতের সাথে একমত।
তোর জীবনে বেঁচে থাকার জন্য কাউকে না কাউকে দরকার আছে মা। তাই তোকে অনুরোধ করছি তুই তনুর কথাটা শুন মা।
-"মেঘলার চোখ পানিতে টলটল করছে। না মা এত বড় শাস্তি আমাকে আপনি দিয়েন না। তাহলে আমি ও হয়তো নীলের মতো বিদায় নিতে বাধ্য হবো। নীলকে ছাড়া আমি কারো কথা চিন্তা করতে পারছিনা।
আমি যদি আপনাদের বোঝা হয়ে থাকি তাহলে বলেন আমি চলে যাবো তবুও এই ধরণের কথা বলবেনা।
.
ডক্টর এসে সবাইকে কেবিন থেকে চলে যেতে বললেন। আপনারা কী শুরু করেছেন। পেশেন্টের অবস্থা ভালো না আর এসব কী করছেন???
-"স্যরি ডক্টর। আসলে মেয়ের কষ্ট আর দেখতে পারছিনা।
পরেরদিন মেঘলাকে নিয়ে বাসায় গেলো।
.
তনু আপু ট্রে তে করে বাটি ভর্তি কয়েক রকমের ফল নিয়ে আসলো।
বিছানায় মেঘলার পাশে বসে বাটিটা হাতে দিয়ে বললো,,,,নাও এবার সবগুলো খেয়ে নাও। রাগের বসে কাল তুই করে বলেছিলাম কিছু মনে করোনা।
-" আরে না আপু। আমার আরো ভালো লেগেছে শুনতে। কিন্তু আপু এখন আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা।
-"মেঘলা আমার মেজাজ গরম করবেনা। চুপচাপ খেয়ে নাও।
হঠ্যাৎ নীলের ভাই দৌড়ে এসে বললো,,, মা মা,,,তোমরা কোথায় সবাই। জলদী এদিকে এসো।
মেঘলাকে রেখে তনু দৌড়ে ড্রইং রুমে ডুকলো।
-"কী হয়েছে তুই এত হাপাচ্ছিস কেন???
-"আ,,,,,,পু। নী.........নী....... মুখ দিয়া কথা বের হচ্ছেনা।
-"নী..... নী করছিস কেন?? তুই এখানে আগে বস। রিলাক্স হয়ে তারপর বল কী হয়েছে???
আপু নীল বেঁচে আছে। আমি মাত্র হসপিটালে ভর্তি করে এসেছি।
নীল বেঁচে আছে শুনেই সবাই হকচকিয়ে উঠলো।
নীল বেঁচে আছে শুনে রুম থেকে দৌড়ে আসে মেঘলা।
-"নীলকে হসপিটালে রেখে আসলি কেন?? কী হয়েছে নীলের???
-'আমি গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরছিলাম হঠ্যাৎ কেউ আমার গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে রাস্তার পাশে ছিটকে পড়লো। গাড়ি থেকে নেমে বাহিরে বেরিয়ে এসে ভালো করে দেখি নীল পরে আছে। মাথায় আঘাত পাওয়ার ফলে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে। সাথে সাথে হসপিটালে নেওয়া হলে ডক্টর বললো এখুনি অপারেশন করানো লাগবে। শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে। কিন্তু অপারেশন করতে ২ পাউন্ড রক্তের প্রয়োজন। আমি ১ পাউন্ড দিবো আরেক পাউন্ড তনু আপুর দেওয়া লাগবে তাই তোমাদের নিতে বাসায় চলে আসলাম।
.
নীল বেঁচে আছে শুনে মেঘলা আবার ও সেন্সলেস হয়ে পড়ে। মেঘলাকে বিছানার উপরে শুইয়ে রেখে তনু আপুকে নিয়ে নীলের ভাই রওনা দিলো হসপিটালে।
নীলের মা মেঘলার পাশে বসে বসে কাঁদতে লাগলো।
চলবে.................
0
7