দুই চাকার মোটরযানের প্রতি আমাদের সবারই দুর্বলতা কাজ করে। এসব যানের দ্রুতগতি, নজরকাড়া ডিজাইন, যেকোনো রাস্তায় চালানোর সুবিধা এবং চার চাকার গাড়ির থেকে কম দামের কারণে গরিব-ধনী সবার কাছেই চলাচলের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আমরা সচরাচর যেসব ডিজাইনের মোটর সাইকেল দেখি তার থেকে ভিন্ন কোনো ডিজাইনের মোটর সাইকেল সামনে আসলে সহজেই তা নজর কাড়ে। ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া এমনই এক মোটর সাইকেল কোম্পানি রয়্যাল এনফিল্ড। যারা এমন কিছু মোটর সাইকেল তৈরি করে যা সব বয়সের মানুষের কাছেই আকর্ষণের বস্তু।
রয়্যাল এনফিল্ডের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ইংল্যান্ডে জন্ম হলেও এই কোম্পানি শীর্ষে ওঠে ইংল্যান্ডের অন্যতম শোষণের কেন্দ্র ভারতে।
১৮৫১ সালে ইংল্যান্ডের রেড্ডিচ শহরে জর্জ টাউনসেন্ড নামের একজন ব্যবসায়ী সেলাই মেশিনের সূচ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন এবং ধাতুর কাজের জন্য বেশ কয়েকটি মেশিন স্থাপন করেন। ১৮৮২ সালে টাউনসেন্ডের ছেলে এই কারখানার যন্ত্রপাতির সাহায্যে সাইকেলের স্যাডেল এবং ফর্ক তৈরি শুরু করেন। এই ব্যবসায় তিনি লাভের মুখ দেখতে পান। তার কাছে বাইসাইকেল তৈরি করার মতো যন্ত্রপাতি ছিল। তাই ১৮৮৬ সালে তিনি ‘টাউনসেন্ড এন্ড একোসাইস’ নামে বাইসাইকেল তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন। দুর্ভাগ্যবশত সেই সময়ে বাইসাইকেলের বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল এবং মার্কেটিং পরিকল্পনা ভাল না থাকায় ১৮৯১ সালে কোম্পানিটি ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
টাউনসেন্ডের পরামর্শদাতা ব্যাংকারদের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যালবার্ট এডি নামে বারমিংহামের একজন সেলস ম্যানেজার এবং রবার্ট ওয়াকার স্মিথ নামে একজন ইঞ্জিনিয়ারের হাতে কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। অ্যালবার্ট এডি ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষী মানুষ। ১৮৯২ সালে তিনি এর নাম বদলে নতুন নাম দেন এডি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। এই কারখানায় অনেক সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি তৈরির মেশিন স্থাপন করা হয়। ১৮৯৬ সালে এডি মিডলসেক্সের এনফিল্ড শহরে অবস্থিত রয়্যাল স্মল আর্মস ফ্যাক্টরির জন্য যন্ত্রপাতি তৈরির কন্ট্রাক্ট পান এবং এখান থেকেই রয়্যাল এনফিল্ড নামের জন্ম হয়। এই বছরই তারা নিউ এনফিল্ড সাইকেল কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি কিনে নেয় এবং এখান থেকে ১৮৯৭ সালে সাইকেলের সব ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি শুরু করে।
ধীরে ধীরে যখন মোটরচালিত সাইকেল ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল তখন এনফিল্ড কোম্পানিও মোটর সাইকেল তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। দুই বছর চেষ্টার পর এনফিল্ড ১৯০১ সালে তাদের প্রথম ২৩৯ সিসি মোটর বাইক বাজারে আনে।
১৯০২ সালে তারা একটি মোটরগাড়ি বানায় এবং ১৯০৬ সালে অটোকার কোম্পানি স্থাপন করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল চার চাকার যানবাহনের মার্কেট দখল করা। তবে মাত্র ১৯ মাস পরেই লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে যায় তাদের মোটরগাড়ি তৈরির কারখানা।
এরপর তারা তাদের সমস্ত সম্পদ লাগিয়ে দেয় মোটর সাইকেলের ইঞ্জিন এবং ডিজাইন উন্নয়নে। ১৯১০ সালে তারা ২৯৭ সিসি ভি টুইন ইঞ্জিন তৈরি করে যা ১৯১১ সালে ৩৪৪ সিসি করা হয়। ১৯১২ সালে ৭৭০ সিসি ভি টুইন JAP এঞ্জিনের মডেল ১৮০ বের হয় যার সাথে একটি সাইড কারও ছিল। ১৯১৩ সালে তারা ৪২৫ সিসির মডেল ১৪০ বের করে। এগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯১৪ সালে এনফিল্ড কোম্পানি তাদের টেকসই এবং দীর্ঘ রাস্তার ধকল সামলাতে সক্ষম মোটর সাইকেলগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য ব্রিটেনের সেনাবাহিনীকে সরবরাহ শুরু করে। এছাড়া ওই সময়ে তারা ইম্পেরিয়াল রুশ সরকারের জন্য মোটর সাইকেল তৈরির চুক্তি সাক্ষর করে। এই বাইকগুলোতে এনফিল্ড ২২৫ সিসি টু স্ট্রোক সিঙ্গেল এবং ৪২৫ সিসি ভি-টুইন ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য এতে একটা করে সাইড কার এবং মেশিনগান যোগ করা হয়।
১৯২১ থেকে ১৯৩০ এর মধ্যে তারা আরও দুটি নতুন ইঞ্জিনের উন্নয়ন করে। তবে এই দশ বছরে তারা আর যে কাজটি করে তার থেকেই আধুনিক বাইকের ডিজাইনের জন্ম হয়। আজকের দিনে বাইকে যেসব ফুয়েল ট্যাঙ্ক দেখা যায় তার প্রচলন শুরু হয় এই দশকে রয়্যাল এনফিল্ড কারখানায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সরকার আবার রয়্যাল এনফিল্ডের সাথে নতুন চুক্তি সাক্ষর করে। এবার এই কোম্পানি মিলিটারি গ্রেড মোটর সাইকেল উৎপাদন শুরু করে। এসময় তারা ২৫০ সিসি, ৩৫০ সিসি এবং ৫৭০ সিসি ইঞ্জিনের মোটর সাইকেল তৈরি করে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল রয়্যাল এনফিল্ড WD/RE। এটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল প্লেন থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে নিচে ফেলার জন্য। যুদ্ধের সময় বোমারু বিমানের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওয়েস্টউডে একটি ভূগর্ভস্থ কারখানা নির্মাণ করা হয়।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৯৪৬-৫৪ সালে রয়্যাল এনফিল্ড কিছু যুগান্তকারী বাইক ডিজাইন করে। এসময় তাদের বিখ্যাত মডেল ‘বুলেট” এর জন্ম হয়। বুলেট ৩৫০ সিসি এবং ৫০০ সিসি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে খুব অল্প সময়েই।
এরপর আসে রয়্যাল এনফিল্ড সুপার মিটিয়র এবং সুপার মিটিয়র কন্সটেলেশন যা ছিল ৭০০ সিসি ক্ষমতাসম্পন্ন।
রয়্যাল এনফিল্ডের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ছিল সেময়ের ব্রিটেনের বাইক লাইসেন্স আইন। এই আইন অনুযায়ী ১৬ বছর বা তার উর্ধ্বের যে কেউ ২৫০ সিসি বা তার নিচের বাইক চালাতে পারত শুধুমাত্র একটা লার্নার লাইসেন্স করে। এর জন্য কোনো পরীক্ষাও দেওয়া লাগত না। রয়্যাল এনফিল্ড এই কারণে কয়েকটি মডেলের ২৫০ সিসি বাইক তৈরি করে। এই বাইকগুলো ছিল ছোট এবং দামেও সুলভ। এছাড়া সেই সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক উদ্বৃত্ত মোটর সাইকেল বিক্রি হত। কমবয়সী ব্রিটিশরা এসব বাইক কিনতে শুরু করে। সেই থেকে শুরু হয় ‘ক্যাফে রেসার’ যুগের। আমেরিকানরা যেমন তাদের মোটরকার মডিফাই করে দ্রুতগতির এবং স্টাইলিশ বানিয়েছিল, তেমন ব্রিটিশরাও তাদের মোটর সাইকেল মডিফাই করা শুরু করে।
রয়্যাল এনফিল্ড বাইকের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় ভারতে। যে ভারতবর্ষকে ব্রিটেন দীর্ঘ দুশো বছর শাসন-শোষণ করেছে, সেই ভারতেই তাদের বাইকের সবচেয়ে বড় বাজার গড়ে ওঠে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর মাদ্রাজে রয়্যাল এনফিল্ডের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। ভারতে এসময় তার বিস্তীর্ণ সীমান্ত অঞ্চল পাহারা দেওয়ার জন্য দ্রুতগতি সম্পন্ন এবং সব পরিবেশে চলার মতো বাইক দরকার ছিল। আর এসব পরিস্থিতিতে যেসব বাইক উপযোগী ছিল তার মধ্যে রয়্যাল এনফিল্ড ছিল অন্যতম। তাই ১৯৪৯ সাল থেকে ভারতে রয়্যাল এনফিল্ড বাইক বিক্রি শুরু হয়। ভারত সরকার ৮০০ ইউনিট ৩৫০ সিসি বাইক কেনে রয়্যাল এনফিল্ড থেকে। ব্যবসায়ের সুবিধার্থে ১৯৫৫ সালে রেড্ডীচ কোম্পানি এবং মাদ্রাজ মোটর্স একত্রে এনফিল্ড ইন্ডিয়া গঠন করে। এই কোম্পানির লাইসেন্সে রয়্যাল এনফিল্ড বুলেট ৩৫০ সিসি তৈরি করা হয়। প্রথমদিকে শুধু বাইক এসেম্বলি করা হত এখানে। তবে ১৯৬২ এর পর থেকে সব যন্ত্রপাতি এখানেই প্রস্তুত করা হয়। এরপর আর রয়্যাল এনফিল্ড ইন্ডিয়াকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৯০ সালে তারা আইসার মটোরসের সাথে একত্রে বাইক উৎপাদন শুরু করে। ২০১৫ সালে রয়্যাল এনফিল্ড তাদের উত্তর আমেরিকান হেড কোয়ার্টার তৈরি করে আমেরিকার উইস্কন্সিনে। এই বছরই বন্যার কারণে চেন্নাইয়ে তাদের অফিস এবং দুটি কারখানা বন্ধ করতে হয়। যদিও ডিসেম্বরের মধ্যেই সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরে আসে।
রয়্যাল এনফিল্ড বাইকের সবচেয়ে বড় বাজার ভারত। ২০১৫ সালে তারা গ্লোবাল সেলে হার্লে ডেভিডসনকে হারিয়ে শীর্ষে ওঠে। হার্লে ডেভিডসন সারা বিশ্বে যত বাইক বিক্রি করেছে তার থেকে বেশি বাইক শুধু ভারতেই বিক্রি করেছে রয়্যাল এনফিল্ড। বর্তমান সময়ে তারা সারা বিশ্বে ৫০টিরও বেশি দেশে বাইক বিক্রি করছে। তাদের এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কিছু কারণ রয়েছে।
ভারতীয়রা এই বাইক সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। স্বাধীনতার পর থেকেই এই বাইক বিক্রি হয়ে আসছে বলে ভারতীয়রা তাদের নিজস্ব পণ্য মনে করে একে।
রয়্যাল এনফিল্ড ব্যবহারকারীদের রয়েছে বিশাল কমিউনিটি। এসব কমিউনিটি যেমন সোশ্যাল মিডিয়ায় কাজ করে তেমনি অঞ্চলভিত্তিক কাজ করে। বাইক সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় তারা একে অন্যকে সাহায্য করে।
রয়্যাল এনফিল্ডের রয়েছে অনন্য ডিজাইন। সেই ৫০ এর দশক থেকে তারা প্রায় একই ধরনের ডিজাইন ব্যবহার করে আসছে। এই ডিজাইনই রয়্যাল এনফিল্ডকে রাস্তায় চলা অন্য বাইক থেকে আলাদা করে।
রয়্যাল এনফিল্ডের রয়েছে উচ্চগতি এবং মাইলেজ। তারা ২৫০ সিসি থেকে ৭০০ সিসি ইঞ্জিন বানিয়েছে যার মধ্যে সিঙ্গেল স্ট্রোক এবং ভি-টুইন ইঞ্জিন রয়েছে। এই ইঞ্জিনগুলোর ফুয়েল এফিসিয়েন্সি ভাল। সব রাস্তায় চলাচলের জন্য এই বাইক উপযুক্ত। সমতল থেকে তুষারাবৃত পাহাড়ি রাস্তা, কর্দমাক্ত জমি থেকে শুষ্ক মরুভূমি, সব রাস্তায় পাওয়া যাবে এই বাইককে।
রয়্যাল এনফিল্ড বিভিন্ন দেশে তাদের বাইক লোক্যালি প্রস্তুত করে। তাই এর মূল্য সাধ্যের মধ্যেই থাকে। এর তাই রয়েছে বিশাল মার্কেট।
ভারতের চলচ্চিত্র এবং বিজ্ঞাপনে এই বাইক অতিমাত্রায় ব্যবহার করা হয়। অনেক মানুষই তাই স্টাইলের জন্য এই বাইক কিনে থাকে।
রয়্যাল এনফিল্ড এমনই এক বাইক কোম্পানি যার রয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। সব দেশে, সব পরিস্থিতিতে, সব পেশার মানুষের জন্য বাইক তৈরি করে এই কোম্পানি। যুগের সাথে তাল মেলানোর মতো ডিজাইন, কম দাম এবং টেকসই হওয়ার কারণে সব রাস্তায় দেখা যায় একে। যদিও বাংলাদেশে অফিসিয়ালি রয়্যাল এনফিল্ডের কোনো বাইক পাওয়া যায় না। তবে বর্ডার ক্রস এবং আজকাল ঢাকায় কোথাও কোথাও টিউন করা রয়্যাল এনফিল্ড বুলেট কিনতে পাওয়া যায়। আশা করা যায় আগামী বছরগুলোতেও রয়্যাল এনফিল্ড তাদের সুখ্যাতি ধরে রাখবে এবং হাজারো মানুষের দুই চাকার ভ্রমণ আনন্দদায়ক করবে।