রোজারিওর ছোট্ট লিওর লিওনেল মেসি হয়ে হয়ে উঠার গল্প
ছোট্ট লিওনেল মেসির বেড়ে উঠাটা আর পাঁচটা লাতিন কিশোরের মতোই সাধারণ ছিল, মাত্র ছয় বছর বয়সেই ছোট্ট লিও প্রিয় ক্লাব নিউওয়েলস ওল্ড বয়জের খেলোয়াড়দের তালিকায় নাম লেখিয়ে ফেলেছিলেন! কিন্তু লিওর দলের অন্য বাচ্চাদের মতো লিও বাবা কিংবা মায়ের হাত ধরে মাঠে আসতো না, লিও আসতো তার দাদীর হাত ধরে। সিলিয়া অলিভেরা ; যিনি মেসিকে সাথে করে প্রতিদিন মাঠে নিয়ে আসতেন, লিওর বাবা হোর্হে মেসির কাছে প্রথম বুটজোড়া কিনে দেবার আবদারটাও পেশ করেছিলেন মায়া চোঁখের এই বৃদ্ধাই। কিন্তু তার প্রিয় লিওর বিশ্বজয় চোঁখে দেখা হয়ে উঠেনি তার, তবে মেসি তাকে ভুলেননি। প্রতিটা গোলের পর দুহাত উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে করা আইকনিক সেলিব্রেশনে কোটি কোটি ভক্তকে জানিয়ে দেন, রোজারিও ছোট্ট লিওর আজকের লিওনেল মেসি হয়ে উঠার পিছনে দাদী অলিভেরার অবদান ঠিক কতটুকু!
শুরুর দিকে লিও যখন নিউওয়েলসের এক প্রকার আনবিটেবল ইউথ টিমের হয়ে মুগ্ধটা ছড়নো শুরু করেছিলেন তখনো মেসির উচ্চতা না বাড়ার সমস্যাটা ধরা পড়েনি তবে দলের সবচেয়ে ছোট-খাটো দেখতে ছেলেটার নাম ততদিনে শহরের লোকজন শুনতে শুরু করেছে। সে সময়ের নিউওয়েলসের কোচ আদ্রিয়ান কোরিয়া এক সাক্ষাৎকারে স্মৃতিচারণ করে বলেন, " তখন ওকে দেখলে আপনার মনে হতো এই ছেলে আর যাই হোক ফুটবল খেলতে পারেনা, বেটে -ভঙ্গুর আর একটু বেশিই ছোট। কিন্তু ওর পায়ে বল আসার এক মূহুর্তেই আপনি বুঝে যাবেন এই ছেলে অন্যদের চেয়ে আলাদা, অনন্যসাধারণ। একবার ওকে দেখলেই সে যে বড় ফুটবলার হতে যাচ্ছে এটা নিশ্চিন্তে বলে দেয়া যেতো।"
১১ বছর বয়সেও যখন লিওর উচ্চতা মাত্র চার ফিট দুই ইঞ্চি, মেসির পরিবার তাকে ডাত্তারের কাছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ডাত্তার পরিক্ষা করে জানালেন গ্রোথ হরমোনের অপ্রতুলতাজনীত সমস্যা। সমাধান হিসাবে ডাত্তার প্রতিদিন একটা করে গ্রোথ হরমোন ইঞ্জেকশন সাজেস্ট করলেন, একটানা তিনমাস। কিন্তু বাবা হোর্সে মেসির পক্ষে সে সময়ে প্রতি মাসে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ করে লিওর চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মেসি সেই অভিজ্ঞতার কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মেসি বলেন - " সেসময়ে আমাকে প্রতিদিন পায়ে সুঁই ফুটিয়ে ইঞ্জেকশন নিতে হতো। রাতের পর রাত, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, টানা তিন মাসের মতো। সবাই বলতো আমি মাঠে যাই আর স্কুলে আমি নাকি সবার চেয়ে ছোট, সবার চেয়ে খাটো। তবে আমার চিকিৎসা যখন শেষ হয় আমি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠতে থাকি "।
নিউওয়েলস প্রথমে লিওর চিকিৎসার ভার নেয়ার কথা দিলেও আর্জেন্টিনার ইকোনমিক ক্রাইসিসের কারণে কথা রাখতে পারেনি। রিভার প্লেটের হাতেও লিওকে সাইন করানোর সুযোগ ছিল কিন্তু তারাও এতো টাকা খরচ করতে রাজি ছিলানা।
মেসির বয়স যখন বারো -তেরো তখনি হোর্হে মেসির ছেলেকে ইউরোপে পাঠানোর অনাপত্তি পেয়ে লোকাল স্কাউট ফ্যবিয়ান সালদেরো এবং মার্টিন মন্টেরো রোজারিওর বিষ্ময়বালক লিওর কথা প্রায়ই বড় বড় ইউরোপীয় এজেন্টদের জানাতেন। প্রথমে এই দুজনের থেকেই লিও সম্পর্কে শুনে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন স্পেন বেইজড আর্জেন্টাইন এজেন্ট হোরাসিও গেজ্ঞিওলি, পরে নিজের চোঁখে লিওলে দেখে এবং বার্সেলোনার ট্রান্সফার বিষয়ের এডভাইজর জোসেফ মারিয়া মিনগ্যুয়েজার সাথে কথা বলে বার্সায় ট্রায়ালের ব্যাবস্থা করেন তিনিই।বোর্ডের অনেকে মেসিকে দেখার আগে স্রেফ বর্ননা শুনে অনেকে ইভেন দেখার পরেও মেসিকে একাডেমিতে সাইন করানোর পক্ষে ছিলনা। কারণ ,একি বয়সের অন্য ট্যালেন্টদের থেকে মেসিকে সাইন করানোর খরচ একটু বেশিই ছিলো, তাছাড়াও শারীরিক বৃদ্ধির ব্যাপারে সন্দেহতো ছিলোই।
বার্সেলোনার ট্রায়ালে যোগ দিয়ে মেসি জেরার্ড পিকে, ফেব্রিগাসদের সাথে ট্রেনিং শুরু করেছিল। মেসির চুপচাপ স্বাভাবের জন্য ওরা মেসিকে নাম দিয়ে ছিলো "এল মুডো" - দ্য মিউট ওয়ান৷
২০১৮ সালে টিওয়াইসি স্পোর্টসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মেসির সবচেয়ে কাছের বন্ধু সেস্ক ফেব্রিগাস বলেন - " মেসি যখন প্রথম বার্সায় এসেছিল সে খুব লাজুক ছিল, আকারে বাকিদের তুলনায় অনেক ছোট, হালকা পাতলা। আমরা বল নিয়ে ওর সাথে খেলা শুরু করতাম যাতে ও আস্তে আস্তে সবার সাথে ফ্রি হতে পারে। " মেসির সাথে প্রথমদিকে ট্রেনিং করার অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করে ফ্যাব্রিগাস বলেন- "লিওর সাথে ট্রেনিং করা খুব কঠিন ছিল। একটা ওয়ান v ওয়ান ট্রেনিং সেশনে লিও আমার পার্টনার ছিল। সেটাআপটা এমন ছিল যে একজন বল নিয়ে এগিয়ে আসবে আরেকজন ওকে ডিফেন্ড করার চেস্টা করবে, ডিফেন্ডারকে পেরিয়ে যেতে পারলে সে গোলপোস্টে শর্ট নিবে। আমি যখন মেসির বিরুদ্ধে ডিফেন্স করছিলাম আমি জানতাম সে বাঁ দিকে কাট করবে & সে সেটাই করতো কিন্তু স্টিল আমাকে মাটিতে শুইয়ে দিতো। এরপরদিনই আমি পার্টনার চ্যাঞ্জ করে ফেলি, আমি বাবাবার হাসির পাত্র হতে চাচ্ছিলাম না। "
বিভিন্ন ব্যাস্ততায় প্রেসিডেন্ট হুয়ান লাপোর্তে এবং অন্যান্য বোর্ড মেম্বাররা মেসির উপর থেকে ফোকাস হারিয়ে ফেললেও জোসেফ মিনগ্যুয়েসা খুব করে চাচ্ছিলেন যেন স্পোর্টিং ডিরেক্টর কার্লেস রেক্সাস সিডনি থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত মেসির ট্রায়াল চলতে থাকে। অবশেষে রেক্সাস ফিরে আসেন, এসেই তিনি ম্যাচ দেখতে ছুটেন। যদিও মাঠে এসে পৌছাতে একটু দেরি করে ফেলেছিলেন তবে যা দেখেছিলেন তাতেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গিয়েছিল তার। বলতে গেলে তিনি একপ্রকার ক্লাবকে জোর করেই বললেন লিওকে সাইন করানোর জন্য, এদিকে শিডিওলের থেকে বেশি টাইম লা মাসিয়া থাকার পরেও বার্সেলোনা কোন ডিসিশন নিচ্ছিলনা দেখে অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন জর্জ মেসি।
এরপরের গল্পটা সবাই জানেন, সহস্রবার শুনেছেন সবাই, তাই ছোট্ট করে বলি। বোর্ডের থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে রেক্সাস, মেসির রিপ্রেজেন্টর গেজ্ঞিওলি এবং মিনগ্যুয়েজাকে লাঞ্চের নিমন্ত্রন করেন, সেখানেই বিখ্যাত সেই ন্যাপকিনে ইনেশিয়াল কন্ট্রাক্টে লিওনেল মেসিকে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার প্লেয়ার হিসাবে সাইন করিয়ে নেন।
অনেকে ভাবতে পারেন যাক মেসি লা মাসিয়ায় ভর্তি হয়ে গেছে, ওর ফ্যামিলিও বার্সেলোনায় চলে এসেছে, ক্লাব ওর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে, ভ্যাস! এখন স্মুথ জার্নি। বাস্তবে অমনটা হয়নি। মেসি লা মাসিয়ায় ভর্তি হবার ছয় -সাত মাসের মাথাই আবার আর্জেন্টিনায় ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়ার দোড়ঘোড়ায় ছিলো। একদিকে ইউরোপের বাইরের আন্ডারএইজ প্লেয়ার সাইন করানোর নতুন নিয়ম অন্যদিকে নিওয়েলসের সাথে আন-ক্লিয়ার চুক্তির কারনে লা মাসিয়ায় কোন কম্পেটেটিভ ম্যাচ খেলতে পারছিলনা লিও। প্রথম দিকে নিজের সমবয়সী অন্যদের মতো সব টিমমেটের সাথে বন্ধু হয়েও উঠতে পারেনি সে। তাছাড়াও অফ দ্য ফিল্ড এমন অনিশ্চয়তার মধ্যেই গোড়ালির ইঞ্জুরির কারনে অনুশীলনও বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে বার্সেলোনায় নতুন পরিস্থিতির সাথে মেসির বাবা -মা, ভাই বোন কেউই মানিয়ে নিতে পারেনি। এমতাবস্থায় মেসির পরিবার এক প্রকার বাধ্য হয়েই আর্জেন্টিনায় ফিরে যায়, তবে মেসিকে ছাড়া। এমন একটা সেক্রিফাইস মেসি করতে না চাইলেও ফুটবল ইশ্বর তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা জুগিয়েছিলেন।
পুরো পরিবার ছেড়ে একা বেড়ে উঠা মেসির জন্য খুবই কষ্টকর ছিল উপরন্তু যেহেতু মেসির বন্ধু সংখ্যা খুবই কম ছিল এক প্রকার আইসোলেটেড হয়ে পড়ে সে। অচীরেই অবশ্য অবস্থায় উন্নতি হতে থাকে, লা মাসিয়ার জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছিল যখন তখনই ২০০২ সালের শুরুর দিকে সব আইনগত সমস্যাও মিটে যায়। সে বছরই ফেব্রুয়ারিতে লা মাসিয়ার অনুর্ধ দলের হয়ে মাঠে নামার অনুমতি পান মেসি। মাস খানেক পরেই মেসির দল ইতালিতে একটা ইউথ টুর্নামেন্ট খেলতে যায়। মেসির সাথে দলে আরো ছিলো মেসির বেস্টফ্রেন্ড সেস্ক ফ্যাব্রিগাস এবং জেরার্ড পিকে। এই দুজন তখন ওই দলের সিনিয়র মেম্বার। ওই বয়সী আর দশটা ছেলেপুলের মত লা মাসিয়ার ক্যাডেটরাও সারাদিন দুষ্টমিতে মেতে থাকতো। একটা কমন দুষ্টোমি ছিলো নতুন কেউ এলে তার সাথে প্যাংক করা। মেসিও বাদ যায়নি।
মেসিকে প্যাংক করার প্লান করেছিলো মূলত পিকে & সেস্ক ফেব্রিগাস। সবাই যখন ডিনার করতে যাবে পিকে তখন একটু পিছিয়ে থেকে মেসির রুম থেকে সব জিনিস সরিয়ে অন্য রুমে রাখবে, যেন মেসির রুম চুরি হয়েছে। প্লান মত কাজ হলো, মেসির প্লে স্টেশন, সরঞ্জামের ব্যাগ সহ যা কিছু আছে সবই সরিয়ে ফেললো পিকে। এরপর ডিনার শেষে যখন সবাই হোটেলে ফিরছিলো তখন ফেব্রিগাস এবং আরো কয়েকজন মেসির রিয়াকশন ভিডিও করছিল। নিজের রুমের এই অবস্থা দেখে সে একদম হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, যেহেতু মেসি খুব চুপচাপ, লাজুক স্বভাবের ছিলো সে কি বলবে কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলনা, শুধু মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে ছিল! মেসির চেহারাটা বাস্তবেই দেখার মতো ছিলো। এরপরে হাসাহাসি শেষে সবাই ওকে সবটা খুলে বললো। এই ঘটনার পরেই মূলত মেসি গ্রুপের একজন হয়ে উঠে সবার সাথে ফ্রি হয়ে উঠে। ফোর ফোর টু'কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ভিক্টর ভালদেস এই ঘটনার কথা জানান।
সেই টুর্নামেন্টে ফাইনালে পার্মার সাথে মেসির পারফরম্যান্সের ভিডিও মেসিকে নিয়ে বানানো অনেক ভিডিও বা ডুকমেন্টরিতেও দেখা যায়। সেই ম্যাচে মেসি নেক্সট দুই দশকে কি করবে তার একটা ট্রেইলার দেখিয়েছিল ব্লুগানা জার্সিতে। মেসির বিখ্যাত শোলডার ড্রপ, এক্সেলারেশন, কাট ইন, টার্ন অফ পেস, বলের উপর পারফেক্ট কন্ট্রোল কি ছিলনা সেই পারফরম্যান্সে। বলাই বাহুল্য বার্সেলোনা সেই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন আর মেসি প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট। বার্সেলোনা জার্সিতে মেসির প্রথম কোন টুর্নামেন্টে সেরা প্লেয়ারের পুরস্কার।
পরের এক বছরে মেসি লা মাসিয়ার ক্যাডেট এ টিমের হয়ে ৩০ ম্যাসে ৩৬ গোল করে, তাছাড়াও তার ড্রিবলিং, প্লে মেকিং, ক্রিয়েটিভিটি, ডিসিশন মেকিং এর প্রশংসাও ছড়িয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে লা মাসিয়া, বার্সেলোনা ইভেন পুরো স্পেনেই মেসিকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়।
" হাউ ডু ইউ স্টপ মেসি? " মেসিকে ফেস করা প্রায় সব প্রতিপক্ষের কোচকেই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে, স্যার এলেক্স ফার্গুসন থেকে কার্লো আঞ্চেলোত্তি, আর্সেন ওয়াংগার থেকে মৌরিনহো, পেপ গার্দিওলা থেকে জার্গেন ক্লপ কেউই বাদ যায়নি। কিশোর বয়সের ক্যাডেট এ দলের প্রতিপক্ষ কোচদের জন্যও এই প্রশ্নটা ততোটাই কঠিন ছিলো। কোচরা লিও সুনাম করে, এরপর আমরা নিজেদের উপর ফোকাস করছি কিংবা আমরা দল হিসেবে খেলতে চাই টাইপ জবাব দিয়ে এড়িয়ে যান।
যাইহোক, সিজনের একদম শেষে জেনারেশন ৮৭ নামে পরিচিত ওই দলটা সিটি রাইভাল এস্পানিওলের সাথে জিতে কাতালান লীগ টাইটেল পুঃনরুদ্ধার করলেও সেই ম্যাচেই প্রথমার্ধে একটা বিশ্রী সংঘর্ষে চিকবোনে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে মেসির ম্যাচ একটু আগেই শেষ হয়ে যায়৷ মাত্র এক সপ্তাহের ব্যাবধানে একি প্রতিপক্ষের বিপক্ষে কাপের ম্যাচের আগে এস্পানিওল আশা করছিল মেসি হয়তো ইঞ্জুরির কারনে খেলতে পারবেনা। কিন্তু মেসি যেন একপ্রকার প্রতিশোধ নিতেই ফিরে এসেছে। তবে প্রোটেক্টিভ মাস্কের জন্য খুব একটা কম্ফোট ফিল করছিলোনা সে, প্রতিপক্ষের ডিফেন্স এবং মিডফিল্ড লাইনের মাঝে ড্রপ করলে ওকে আইডেন্টিফাই করাও ইজি হয়ে যাচ্ছিল এস্পানিওলে ডিফেন্ডারদের জন্য। তাই মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায়, মেডিকেল স্টাফদের নির্দেশনা অমান্য করেই মাস্কটা ছুড়ে ফেলে সে। ম্যাচে নামার আগের কোচ মেসিকে শুধুমাত্র ফাস্ট হাপ খেলার অনুমতি দিয়েছিল, কথামতো মেসি ফাস্ট হাপের শেষে নেমেও গিয়েছিল তবে তার আগেই দূর্দান্ত পারফরম্যান্সে দলের ৪-১ গোলের জয় নিশ্চিত করেন। ওই ম্যাচটা নাকি Partido de la Máscara নামে পরিচিত। দ্য ম্যাচ অফ দ্য মাস্ক।
পরের বছরই লা মাসিয়ার বিখ্যাত জেনারেশন ৮৭ স্কোয়াডে ভাঙন ধরে। জেরার্ড পিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে সাইন করান, আর্সেনালে পাড়ি জমান মেসির সবচেয়ে ক্লোজ বন্ধু ফেব্রিগাস। আর্সেনাল মেসিকেও সাইন করনোর চেস্টা করে জোরেসোরে তবে মেসি লা মাসিয়ায়ই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এদের দুজনই অবশ্য পরে আবার বার্সেনায় ফিরে আসেন।
এরপরে লম্বা সময় পার হয়েছে, মেসিও পরিনত হয়েছেন অনেক। ২০০৩ সালের নভেম্বর মাস। বার্সেলোনার সাথে জোসে মৌরিমহোর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন পোর্তো দলের একটা প্রিতিম্যাচ আয়োজন হয়। তখনকার বার্সেলোনা কোচ ফ্র্যাংক রাইকার্ড কয়েকটা ইয়ং প্লেয়ারকে সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। জোহান ক্রুইফের বিখ্যাত ১৪ নাম্বার জার্সি পড়ে বদলি হিসেবে মাঠে নেমেছিলো মেসি। পরেরদিন কাতালান পত্রিকা মুন্ডো দেপার্তিভোর হ্যাডলাইন ছিলো - He revolutionised the match "। এরপরের এক সিজনে একের পর এক এজ গ্রুপগুলাতে প্রমোশন পেয়ে ফাস্ট টিমে আসার খুব কাছাকাছি চলে আসেছিল লিও।
একবার যখন মেসি ফাস্ট টিমের হয়ে ট্রেনিং শুরু করে ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে বড় তারকা গ্রেট রোনাদিনহো খুব অল্প সময়ে মেসির ভেতরের প্রতিভা দেখে ফেলেন তিনি তাই খুব তাড়াতাড়ি মেসিকে নিজের ছত্রছায়ায় নিয়ে নেন। ২০১৪ সালে ফোর ফোর টু'তে দেয়া এক সাক্ষাতকারে দিনহো বলেন - " আমি সবসময় চেয়েছিলাম মেসির উপর একটা ভালো ইনফ্লুয়েন্স হতে। রোনালদো আমাকে যেভাবে সাহায্য করেছিল আমিও মেসিকে ওভাবে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। রোনালদো আমাকে সবসময় সাহস যোগাতেন, আমিও তাই করার চেস্টা করেছি কারণ ও ছিল খুবই লাজুক কিন্তু দূর্দান্ত প্লেয়ার। আমাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, দুজনে থাকতামও বার্সেলোনার একি এলাকায়। তখনি আমি জানতাম লিও আমার থেকে ভালো প্লেয়ার হতে যাচ্ছে "।
আস্তে আস্তে মেসি বিভিন্ন প্রস্তুতি ম্যাচ, প্রি সিজন ম্যাচে অল্প বিস্তর প্লেয়িং টাইমও পেতে শুরু করে। অবশেষে ১৭ বছর ৩ মাস ২২ দিনের মাথায় পর্তূগিজ মিডফিল্ডার ডেকোর বদলি হিসাবে সিটি রাইভাক এস্পানিওলের বিপক্ষে বার্সেলোনার জার্সিতে প্রথম কোন অফিশিয়াল ম্যাচে মাঠে আসার সুযোগ দেন কোচ ফ্র্যাংক রাইকার্ড। মেসি হন তখনকার সময়ে বার্সেলোনা ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ ফুটলার। এতো অল্প বয়সে সুযোগ দেয়ার মেসি অবশ্য পরে অনেকবার রাইকার্ডকে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোচ হিসাবে উল্লেখও করেছেন।
কিছুদিন পর মে মাসে আলবাক্রেটের বিরুদ্ধে ৮৮ মিনিটে যখন বদলি হিসাবে নামেন মেসির মেন্টর রোনালদিনহো বাড়ানো বল থেকে বল থেকে কার্লি শটে জালে জড়ান লিওনেল মেসি, যদিও রিপ্লেতে স্পষ্ট মেসি অন সাইডে ছিল রেফারির অফসাইডের বাঁশিতে বাদ হয়ে যায় সেই গোল। লিওর লম্বা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে প্রতিপক্ষের গোলকিপার রাউল ভালবুয়েনা হয়তো আশা করছিলেন মেসির অফিশিয়াল প্রথম গোলটা সেদিন যেন না আসে কিন্তু লিও ডিটারমাইন্ড ছিল আবারো সেই রোনালিনহোর বাড়ানো বলের নিচে আলতো ছোয়ায় লব দিয়ে তড়িঘড়ি করে নিজের পজিশন ছেড়ে বেরিয়ে আসা গোলকিপারের মাথার উপর দিয়ে বল যখন ভেসে যাচ্ছিল তখন মনে হয় এক মূহুর্তের জন্য ন্যু ক্যাম্প যেন থমকে গেছে,পরক্ষনেই আবার গর্জে উঠে পুরো ন্যু ক্যাম্প। গোলের পরে দুহাত ছড়িয়ে লিও মেসির আইকনিক সেলিব্রেশনের পর নিজের পিঠে উঠিয়ে গ্রেট রোনালদিনহো বোধহয় ফুটবল বিশ্বকে বলতে চেয়েছিলেন - দ্য কিং হ্যাভ এরাইভড।
পরের সামারে হুয়ান গাম্পার ট্রফিতে য্যুভেন্টাসের সাথে অসাধারণ প্রদর্শনীর পর তখনকার য্যুভেন্টাস কোচ ফ্যাবিও ক্যাপেলো ম্যান শেষ না হতেই সরাসরি কোচ ফ্র্যাংক রাইকার্ডকে মেসিকে লোনে দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। তার কিছুদিন আগে বার্সেলোনা মেসির সাথে লংটার্ম চুক্তি করে ১৫০ মিলিয়নের রিলিজ ক্লজ দেয়। বিপত্তি বাধল কিছুদিন পরই যখন ইন্টার মিলান মেসির রিলিজ ক্লজ পরিষোধ করা প্রস্তাব দেয়। ১৫০ মিলিয়ন। সে সময়ের জিনেদিন জিদানের ওয়াল্ড রেকর্ড ট্রান্সফার ফি'র প্রায় দ্বিগুণ! ২০০৬ সালে ইন্টার তখনো ইউরোপের অন্যতম সেরা দল, আদ্রিয়ানো, লুইস ফিগো, ইব্রাহিমোবিচ, পেট্রিক ভিয়েরার মত তারকারা ছাড়াও ক্রাস্পো, জেনেত্তি, জুলিও ক্রুজ সহ বেশ কয়েকজন আর্জেন্টাইনও ছিলো সাথে বিশাল বেতনের সুযোগতো ছিলোই। কিন্তু অবশেষে মেসি বার্সেলোনা থেকে যাবারই সিদ্ধান্ত নেন। তখনকার প্রেসিডেন্ট হুয়ান লাপোর্তে মেসির বাবা & এজেন্ট জর্জ মেসিকে কনভিন্স করেন।
ইন্টারের এপ্রোচ মানা করে দেয়ার পর এলো আরেক বিপত্তি, স্পেনের নাগরিক না হবার কারনে & আন্ডার এইজ হবার কারনে মেসি আদৌ সিনিয়র প্লেয়ার হিসাবে লা লিগায় খেলতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠলো। সৌভাগ্যবশত মেসির নানী রোজ ছিল স্পেনিশ সেই সুবাধে মেসি স্পেনের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলো, পেয়েও গেলো। স্পেনের ফুটবল একাডেমি তারপর বেশ ভালোভাবেই মেসিকে স্পেনের জাতীয় দলের হয়ে খেলার জন্য প্রস্তাব দেয়, আর্জেন্টিনা থেকে যুব চ্যাম্পিয়নশীপের প্রস্তাব আসার অনেক আগেই। কিন্তু মেসি সিদ্ধান্ত নেয় আর্জেন্টিনার হয়েই খেলবেন। আগস্টে মেসির নাম প্রথমবারের মতো আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের তালিকায় আসে।বুদাপেস্টের সেই ম্যাচের স্মৃতি হয়তো মেসি ভুলে যেতেই চাইবেন। সে যাই হোক বার্সেলোনার মেসি যখন আর্জেন্টিনার জার্সিও জড়ালেন চারিদিকে মেসির নেক্সট মেরাডোনা হাবার নিকনেক ছডিয়ে গেছে! মেরাডোনা নিজেও ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বলেন - “I’ve seen the player who will inherit my place and his name is Messi "
সে বছর স্যামুয়েল ইতো আর রোনালদিনহোর সাথে ইয়ং মেসি রাইকার্ডের আন্ডারে দূর্দান্ত এটার্কিং ট্রিওর অংশ হয়ে যান। চ্যাম্পিয়ন লীগের সেমিতে অসাধারণ পারফরম্যান্সের পরেও ইঞ্জুরির কারনে ফাইনালে নামা হয়নি মেসির। রোজারিওর লিও অফিশিয়ালি লিওনেল মেসি হয়ে উঠেছিলেন বোধহয় তার প্রায় এক বছর পরে৷
সেই ফ্যাবিও ক্যাপেলোর রিয়াল মাদ্রিদের সাথে ইতোর বাড়িয়ে দেয়া বলে ক্যাসিয়াসকে ছোট্ট ডামিতে বোকা বানিয়ে প্রথম গোল করেন মেসি। সেকেন্ড গোলটা আসে রোনালদোর শর্ট ক্যাসিয়াস ফিরিয়ে দিলে, মেসির পাওয়ারফুল শর্ট দ্বিতীয়বার সমতায় ফেরায় বার্সাকে। ম্যাচে বার্সা যখন ৩-২ এ পিছিয়ে তখনি ডি বক্সের বাইরে চারজন সাদা জার্সির প্লেয়ারের মাঝে বল রিসিভ করে দুজনকে ড্রিবল করে বা পায়ের জোড়ালো শর্ট ক্যাসিয়াসকে পরাস্ত করে জালে জড়াতেই ইতিয়াস লেখা হয়ে যায়! মাত্র ১৯ বছর বয়সে আর্চ রাইভাল রিয়াল মাদ্রিদের সাথে হেট্রিকের পর ক্যাম্প ন্যু'র মেসি মেসি মেসি চ্যান্টে যে মেসি ম্যানিয়ার বিষ্ফোরন হয় মূহুর্তেই তা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে যায়। স্কোরশীটে ৩-৩, নিচে লেখা মেসি, মেসি মেসি পরের দিন কাতালান পত্রিকা স্পোর্টের কাভার পেজেও একি লেখা মেসি, মেসি, মেসি। সেই কাভার পেজ অনেকের কাছে সংগ্রহের বস্তু হয়ে যায়। কমেন্টেটরের চিৎকার করে বলা Messi Takes Everybody on..Messi has got it! This is the game that is gonna remembered as LEONEL MESSI GAME শব্দগুলো কোটি কোটি ভক্তের কাছে রোজারিওর লিও লিওনেল মেসি হয়ে
best player in the world