'জীবনে যা কিছু ঘটে, তার পেছনে আল্লাহর একটা পরিকল্পনা থাকে। কোন মুমিন বান্দার জীবনে যখন কোন দূর্যোগ নেমে আসে, যখন কোন বিপদ এসে লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় তার জীবনের সাজানো উঠোন— তখন হতবিহ্বল না হয়ে সেই পরিকল্পনায় নিজেকে সঁপে দেওয়ার মাঝেই প্রভূত কল্যাণ নিহিত।
ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম যখন শিশু ইসমাইল আলাইহিস সালাম সহ হাজরা আলাইহাস সালামকে জনমানবহীন মক্কার রুক্ষ এক উপত্যকায় রেখে যান, সেই দৃশ্যের কথা ভাবলে মনে হয়— একজন নারীর জীবনে এর চাইতে বেদনাবিধূর মুহূর্ত আর থাকতেই পারে না।
এমন নির্জন সে প্রান্তর— দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোন মানবকূলের আভাস পর্যন্ত পাওয়া যায় না। খাবারের বন্দোবস্ত নেই, পানির বন্দোবস্ত নেই; এমনকি একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত ছিলো না সেখানে। হাজরা আলাইহাস সালামের জন্যে তার ওপর আরো কঠিন বিয়োগ-ব্যথা ছিলো ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের কাছ থেকে দূরে থাকার বিচ্ছেদ।
এই যে এতো আসন্ন বিরহ এবং বিপদ, সম্মুখে এতো রুক্ষ-কঠিন দিনের চোখ রাঙানি— সমস্তকিছু জেনেও সেদিন হাজরা আলাইহাস সালাম কান্নায়, দুঃখে, রাগে ফেটে পড়েন নি। ভীষণ হতাশায় আর্ত-চিৎকার করে তিনি জানতে চান নি, ‘কেনো আমার সাথেই এমন হচ্ছে? কি দোষ আমি করেছি?’ বরং তিনি ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনি যা করতে যাচ্ছেন, তা কি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালার নির্দেশ?’
ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম বললেন, ‘হ্যাঁ’।
হাজরা আলাইহিস সালাম তখন বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয় আমার রব আমাকে তার দয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না’।
কোলের শিশুকে নিয়ে হাজরা আলাইহাস সালাম সেই একাকী রুক্ষ নির্জন প্রান্তরে থাকতে রাজি হয়ে গেলেন শুধু এইটুকু আশ্বাস পেয়ে যে— এই কাজের নির্দেশ ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছ থেকেই পেয়েছেন। এমন ভাগ্যকে বরণ করে নিতে আর কোন আশ্বাসবাণী, আর কোন সান্ত্বনা-বাক্য হাজরা আলাইহাস সালামের দরকার পড়েনি। কারণ, তিনি জানতেন— আল্লাহর কোন এক পরিকল্পনার মধ্যে তিনি যুক্ত হতে চলেছেন, এবং সেই পরিকল্পনায় তার জন্যে এমনকিছু অপেক্ষা করে আছে যা কল্পনার চেয়েও সুন্দর, স্বপ্নের চাইতেও অবিশ্বাস্য!
যেহেতু এই পরিকল্পনাকারী স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা-ই, তাই এই পরিকল্পনায় অখুশি হওয়ার, অতৃপ্তি মনে পুষে রাখার, এই পরিকল্পনায় অসম্মতি জ্ঞাপনের কোন প্রশ্নই থাকতে পারে না।
হাজরা আলাইহাস সালামের বিশ্বাস অমূলক ছিলো না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালার এক মহা-পরিকল্পনার মধ্যে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন সেদিন। হাজরা আলাইহাস সালামের সেদিনকার সেই কষ্টের দিনগুলোর বিনিময়ে, সেই রুক্ষ-কঠিন একাকী নির্জন প্রান্তরের নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোর বদৌলতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা তাকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে এমনভাবে স্মরণীয় করে রাখলেন যে, কিয়ামত অবধি যতোজন মুসলিম হজ্ব আর উমরা সম্পন্ন করবে, তাদেরকে অতি-অবশ্যই হাজরা আলাইহাস সালামের স্মৃতিকে স্মরণ করতে হবে। তার স্মৃতি স্মরণ করে সাফা-মারওয়ায় দৌঁড়াতে হবে। আর ইসমাইল আলাইহিস সালামের স্মৃতিবিজড়িত যমযম কূপ তো ইতিহাস-ই হয়ে থাকলো!
এটাই হলো সেই প্রাপ্তি যা আল্লাহর পরিকল্পনায় ভরসা রাখলে পাওয়া যায়। তিনি হয়তো মাঝে মাঝে আমাদের কষ্টে রাখেন, হয়তো-বা মাঝে মাঝে আমাদেরকে তিনি কোন বিয়োগ-ব্যথা, কোন বিচ্ছেদ-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে নিয়ে যান। কোন আর্থিক-শারীরিক ক্ষতি হয়তো-বা আমাদের হয়ে থাকে। কিন্তু যখনই আমাদের ভরসার পারদ হাজরা আলাইহাস সালামের স্তরে উন্নীত হবে, যখনই মন থেকে এই বিশ্বাসের সুর প্রতিধ্বনিত হবে যে— ‘নিশ্চয় আমার রব আমাকে তার দয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না’, তখনই আমাদের জন্য খুলে যাবে আসমানের দরোজা। আমাদের ধৈর্যের, আমাদের ত্যাগের, আমাদের সকল দুঃখ আর কষ্টের বিনিময়ে তখন এমন প্রাপ্তির বন্দোবস্ত করা হবে যা স্বপ্নেরও অতীত!
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আমাদের জীবনকে নিয়ে যে ছক আঁকেন, তাতে পরিপূর্ণ বিশ্বাস এনে, তা থেকে কল্যাণ এবং দয়া কামনা করে নিজের চেষ্টাটুকু যদি করে যাওয়া যায়— যেভাবে হাজরা আলাইহাস সালাম করে গিয়েছিলেন মক্কার একাকী নির্জন প্রান্তরে শিশু ইসমাইল আলাইহিস সালামকে নিয়ে— তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, জীবনের কোন এক পর্যায়ে সেই চেষ্টার, সেই ত্যাগের, সেই ধৈর্যের ফল আমরা অবশ্যই পাবো। দুনিয়াতে অথবা অনন্ত আখিরাতে।'