সেই বিতর্কিত বই যা সিলেবাস থেকে বাতিলের দাবিতে দেশের স্কুল ছাত্ররা জড়ো হয় ১৯৭০ সালে।
আমাদের দেশের স্কুল ছাত্রদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ছিলো এটি।
বইয়ের নাম পাকিস্তানের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি।
১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্কুল টেক্সটবুক বোর্ড থেকে প্রকাশিত ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি ‘ নামক বইটি ১৯৭০ সালের জানুয়ারী মাসে পূর্ব পাকিস্তানের সকল স্কুলে নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বইটির লেখক ছিলেন মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম এবং প্রচ্ছদ আঁকেন মনসুর আহমেদ। বইটি ছিলো পাকিস্তান ও তার সংস্কৃতি নিয়ে গুনগান গাওয়া একটি বই যাতে বাঙালী সংস্কৃতির বিন্দুমাত্র কথা ছিলো না। বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার পরপরই এ নিয়ে ঢাকার স্কুলগুলোর শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় এবং যা ধীরে ধীরে আন্দোলনে পরিনত হয়। স্কুল ছাত্র-ছাত্রীরা প্রথমে স্কুলে স্কুলে ও পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন ওয়েষ্ট এন্ড স্কুল থেকে তৎকালীন স্কুল ক্যাপ্টেন হারুন উর রশীদ , সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে তাকসীম খান, নওয়াবপুর স্কুল থেকে আবু বকর সিদ্দিকী (মরহুম, মুক্তিযোদ্ধা ও বাসদ নেতা), গভঃ ল্যাবরেটরী হাই স্কুল থেকে মুশতাক আহমেদ, আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে বেগম লুৎফে হাসিন রোজি (মুক্তিযোদ্ধা ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী)। এ সময়ে হারুন উর রশীদ ও তাকসীম খানকে যুগ্ম আহবায়ক করে স্কুলছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নামের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকার প্রায় সকল স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীরা শহীদ মিনারে এসে প্রতিবাদ করতে থাকে। এই আন্দোলনে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল থেকে শেখ জামাল ও ধানমন্ডি গার্লস স্কুল থেকে শেখ রেহানা প্রায়ই এসে যোগ দিতেন। এই আন্দোলনের খবর ৩রা জুলাই ১৯৭০ সর্বপ্রথম পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়। সারাদেশে এই বইয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছড়িয়ে যায়।
স্কুল ছাত্রদের পিছে সিনিয়র হিসেবে এই আন্দোলনে সহায়তা তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ
সেই আন্দোলনে একটি বক্তৃতা সংগ্রামের নোটবুক থেকে সংগ্রহ করা হলো।
আন্দোলনের দাবি
পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ বই বাতিলের দাবীতে ছাত্র জমায়েত স্কুলছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ৫ আগস্ট, ১৯৭০
“পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি” বই বাতিল ও শিক্ষা সমস্যা সমাধানের দাবীতে ৬ই আগস্ট বৃহস্পতিবার বালা ১১টায় শহীদ মিনারে ছাত্র জমায়েত
সংগ্রামী ভাই-বোনেরা,
দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ শিক্ষাজীবনের সংকট দূর করে একটি সার্বজনীন সুলভ, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থার দাবীতে সংগ্রাম করছে। কিন্তু স্বাধীনতার ২৩ বৎসর পরও আমাদের ন্যায্য দাবী পদদলিত। আজ পর্যন্ত কোন সরকারই শিক্ষা ব্যবস্থা সমস্যার সমাধান করে নাই, উপরন্তু বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে। শিক্ষার বিস্তারের জন্য ছাত্রসমাজ ছাত্রদের উপর থেকে সিলেবাসের বোঝা কমিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক সিলেবাস প্রবর্তনের দাবী জানিয়েছে। কিন্তু কোন সরকারই আমাদের কথায় কান দেয় নাই, বরং সিলেবাসের বোঝা দিন দিন অবৈজ্ঞানিকভাবে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সম্প্রতি স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্রদের উপর “পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি” বইটি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিলেবাসের এই নতুন বোঝার দ্বারা সুকৌশলে শিক্ষার বিস্তারকে রোধ করার প্রচেষ্টা চালান হচ্ছে। অন্য দিকে এই বই-এ আন্তভূর্ক্ত বিভিন্ন সাপ্রদায়িক ও বিকৃত তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে ছাত্র সমাজকে সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। মুখে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও “পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি” চাপিয়ে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞান ছাত্রদের প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষার সময় ও সুযোগ সীমিত করে দিয়েছে। সরকারের এই তোগলোক নীতির ফলে সমস্ত দেশের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবনে এক চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের ফলে সরকার এই বই- এর দ্বিতীয় অংশ বাতিল করলেও আজও ছাত্রদের মাথায় বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে রেখেছে এই বই-এর প্রথম অংশটি।
এ ছাড়াও, ভর্তি সমস্যা, পর্যাপ্ত স্কুল কলেজের অভাব, জগন্নাথ কলেজসহ প্রদেশের বিভিন্ন কলেজকে প্রাদেশিকীকরণজনিত সমস্যা, হল-হোস্টেলের অভাব, ডাইনিং হল সমস্যা, অতিরিক্ত ফুডচার্জ প্রভৃতি বিবিধ সমস্যা ছাত্রদের শিক্ষাজীবনে সংকট করে চলেছে। শিক্ষাজীবনের এই সংকট দূর করার জন্য এবং গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্বার সংগ্রামের পথে এগিয়ে আসতে হবে। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ছাড়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আসুন, শিক্ষার সংকট মোচনের জন্য, গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এবং “পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি” বই বাতিল করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামের পথে অগ্রসর হই।
বন্ধুগণ,
তাই আসুন আগামী ৬ই আগস্ট বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত ও বিক্ষোভ মিছিলকে সাফল্যমন্ডিত করিয়া তুলি।
স্কুলছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কতৃক আহূত
ও
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন সমর্থিত
পরবর্তীতে এটি বাতিল করা হয়।
great