বিভাগ: ছোটগল্প
(১)
আমার বেলায় কোন কিছু সহজে হয় না। সবকিছুর মধ্যেই একটা ঝামেলা থাকে। আর তাই বিয়েটা যখন কোনরকম ঝামেলা ছাড়া হয়ে গেল, তখন আমি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলাম। আমার বাবা খুবই কৃপণ একজন মানুষ । তার যে টাকা পয়সা নেই, তা নয় কিন্তু, যথেষ্ট রয়েছে, কিন্তু খরচ করার ব্যাপারে তার ভীষণ অনীহা। আর তাই বিয়েতে ছেলেপক্ষ যখন কিছুই দাবি করল না,তখন তিনি কোনো রকম খোঁজ খবর না নিয়ে সেখানেই আমার বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলেন। বিয়ে ব্যাপারটা সারা জীবনের, আর একটু খোঁজখবর করার দরকার ছিল।
(২)
কেন ,সেটা আপনাদের বলি। আমাদের গ্রামের বাড়ি বুড়িচং।বহু বছর আগে আমার বাবা গ্রামের বাড়ি পেছনে ফেলে রেখে কুমিল্লা শহরে এসে বসতি স্থাপন করেন। জায়গাটার নাম বিষ্ণুপুর, লেংটা ফকিরের মাজারের খুব কাছে। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব অর্ধশত মাইলের সামান্য কিছু বেশি। একসময় একটুকু পথ পাড়ি দিতে সারাবেলা লেগে যেতে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। রাজধানীর এত কাছে হলেও কেমন একটা বেশ গ্রাম গ্রাম ব্যাপার রয়েছে। আর তাই আমার যখন হঠাৎ করে আমেরিকা প্রবাসী এক ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, তখন আমি বেশ আশ্চর্য হলাম। ছেলে ডালাসে থাকে । ছোটবেলায় টেলিভিশনে দেখা সেই স্বপ্নের শহরে আমার একদিন যাওয়া হবে তা কখনও কল্পনাই করিনি।আর তাই বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পরও ব্যাপারটা আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। বিশেষ করে প্রবাসী ছেলেদের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে যেসব যাচাই-বাছাইয়ের গল্প শুনেছি তার সাথে কিছুই মিলল না। ছেলের বাবা আমার চাচার সাথে কোন এক সময় এক অফিসে চাকরি করতেন। এই সামান্য যোগাযোগে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম, ছেলে আমাকে দেখতে এসে অনেক প্রশ্ন করবে, কিন্তু আমি ছেলেটার মধ্যে কেমন যেন একটা অনীহা দেখতে পেলাম। ভালো করে একবার আমার দিকে তাকালো পর্যন্ত না। এটা অবশ্য এক দিক দিয়ে আমার জন্য সুবিধার হলো। আমি ছেলেটাকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম।
(৩)
ছোটবেলা থেকেই আমার ফর্সা ছেলে খুব পছন্দ। ইংরেজিতে, opposite attracts বলে যে কথাটা প্রচলিত, কথাটা খুব সম্ভবত সত্যি। কারণ আমি শ্যামলা। বয়সন্ধিকালের পর মেয়েরা যখন হবু বর নিয়ে জল্পনা কল্পনা করতে শুরু করে, সেইসব রহস্যময় সময়গুলোতে আমি সব সময় কল্পনায় দেখতে পেতাম বেশ ফর্সা একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে। ব্যাপারটা যখন সত্যি সত্যি ঘটে গেল তখন আমি মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম।
(৪)
কুমিল্লা শহর নিয়ে বেশ মজার একটা কথা প্রচলিত রয়েছে,"Comilla is a city full of banks and tanks." শহরটা ভরে রয়েছে শুধু পুকুর আর পুকুরে। প্রায় প্রতিটি বড় বাড়ির পিছনে আপনি একটি পুকুর দেখতে পাবেন। তারপরও যদি আপনার পানির শখ না মিটে, তবে শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট নদী গোমতী। এই নদীর পাড় ধরে সামান্য কিছু দূর হাঁটলেই আপনি পৌঁছে যাবেন বিষ্ণুপুর। শহরের আর সব এলাকার মতো আমাদের বাসার পাশেও রয়েছে একটি বিশাল বর্গাকার দীঘি। যার শান বাঁধানো ঘাটে কেটেছে আমার অসংখ্য মন খারাপের সন্ধ্যা। আর তাই হঠাৎ করে যখন আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, তখন এই দীঘির পাড়টির জন্য আমার মন কেমন করত লাগলো। তখনও আমি আমার শ্বশুরবাড়ি দেখি নাই। আমি জানতাম না, আমাদের বাসার মতই আমার শ্বশুর বাড়ির পাশেও রয়েছে বিশাল এক দীঘি। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দীঘিটি এত বড় যে স্থানীয় লোকেরা গর্ব করে এর অদ্ভুত সুন্দর একটা নাম দিয়েছে, ধর্মসাগর।
(৫)
"উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে,"কথাটি বাস্তবে আদতেই কাউকে কোনদিন বলা হয়েছিল কিনা আমি জানিনা, কিন্তু যে ভীষণ দ্রুততায় আমার বিয়ে হয়ে গেল, তার সাথে এই বাক্যটির আমি মিল খুঁজে পেলাম। আমার স্বামীর হাতে সময় খুব কম। খুব শীঘ্রই সে আমেরিকা ফেরত যাবে । সুতরাং আমি আশা করেছিলাম, দেশে অবস্থানের বাকি দিনগুলো সে আমার সাথে কাটাবে।কিন্তু তাদের বাসায় উঠে আসার পর আমি লক্ষ্য করলাম একদিন অন্তর অন্তর সে ঢাকা চলে যায়। নতুন বিবাহিত একজন স্বামী ,যে কিনা ছুটি কাটাচ্ছে, সে ঢাকা যাবার সময় তার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং একদিন বৈকালিক চা খাবার সময়, আমার শ্বশুর বাড়ির দোতালার বারান্দায় বসে ধর্মসাগরের দিকে তাকিয়ে, চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে তাকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করলাম। সে তার উত্তর যা বলল, তা শুনে আমার বিষম খাবার জোগাড়।
(৬)
"আমি কিডনি ডায়ালাইসিস করাতে যাই। ডায়াবেটিস থেকে আমার দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। তোমাদের শরীরের সব দূষিত পদার্থ যেমন কিডনি ছাকনির মত ছেঁকে পেশাবের সাথে বের করে দেয়, আমার বেলায় সেটা ঘটে না। তুমি যদি চাও, তবে আমাকে একটা কিডনি দিতে পারো। সে ক্ষেত্রে আমার জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। কি চাও?"
(৭)
আপনারা কি সেই আপ্তবাক্যটি শুনেছেন,"সাধ আছে, সাধ্য নাই!" আমার বেলায় ও সেই ঘটনাটি ঘটেছে। আমি চাইলে ও আমার স্বামীকে কিডনি দিয়ে সাহায্য করতে পারব না। কারণ বহু বছর আগে আমি আমার বাবাকে আমার একটি কিডনি দান করেছি। তিনিও আমার স্বামীর মত ডায়াবেটিক। আমার স্বামীকে সেই কথাটা বলাতে, সে আমাকে যা উত্তর দিল, আমি তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
(৭)
"তোমার শরীরের একটা অংশ নাই, তোমার মনে হয় নাই এই ব্যাপারটা তোমার বিয়ের আগে আমাকে জানানো উচিত ছিল?"আমি এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমরা মানুষেরা আসলে খুবই অদ্ভুত এক প্রাণী। মনে করুন আপনি সিনেমা দেখছেন। সেখানে আপনি দেখলেন, একজন তার মায়ের সাথে খুব চেঁচিয়ে কথা বলছে। আপনার সাথে সাথে মনে হবে, কি বেআদব। অথচ বাস্তব জীবনে হয়তো আপনি নিজেও কখনো কখনো মায়ের সাথে চেঁচিয়ে কথা বলেন। আমরা আমাদের নিজেদের দোষ কখনো দেখতে চাই না। আমার স্বামী, যে কিনা ডায়াবেটিক, যার দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, এত বড় একটা ব্যাপার সে বিয়ের আগে আমাকে জানায়নি, সেখানে সে কোন দোষ দেখতে পাচ্ছে না, অথচ আমি কেন আমার কিডনি দানের কথা তাকে বিয়ের আগে বলিনি, সেটা নিয়ে জবাবদিহিতা আশা করছে।
(৮)
সেই বিকেলের পর পর খুব দ্রুত আমার সাথে আমার স্বামীর সম্পর্কের অবনতি ঘটলো। যে দ্রুততায় সে আমেরিকা ফেরত গেল, তাতে আমার মনে হল, আমাকে সে বিয়ে করেছিল একটি কিডনি পাবার আশায়। এটাই ছিল আমাদের বিয়ের অলিখিত যৌতুক। ব্যাপারটা বুঝে উঠবার পরে, আমার স্বামীর সম্বন্ধে আমি কয়েকটা ব্যাপার অনুধাবন করি। প্রথমত সে খুব একটা সাবধানী মানুষ নয়। আপনার যখন বহুমূত্র রোগ থাকবে, তখন ডাক্তাররা প্রতি তিন মাস পর এক ধরনের পরীক্ষা করতে দেন, যেখানে পেশাবে কোন ধরনের আমিষ পেলে তারা বুঝতে পারেন কিডনি নষ্ট হতে শুরু করেছে। কিডনি ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। এক বিকেলে আপনি কিছু মিষ্টি খেলেন, আর সে কারণে কিন্তু আপনার কিডনী নষ্ট হবে না। আপনার সুগার দীর্ঘদিন খুব বেশি থাকবার পরে আপনার একটি কিডনি নষ্ট হতে শুরু করবে। তখন আপনার ডাক্তার আপনাকে ব্যাপারটা সাবধান করে দেবেন। একসময় ব্যাপারটা বেশ কঠিন ছিল। তখন রোগীকে মাটির উপর পেশাব করিয়ে চিকিৎসকরা লক্ষ্য করতো পিপড়ার পাল সেই পেশাবের দিকে যাচ্ছে কিনা। যদি অসংখ্য পিঁপড়া সে দিকে রওনা দিত, তখন ধারণা করা হতো রোগীটির বহুমূত্র রোগ রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্র এখন অনেক এগিয়ে গেছে। প্রতি তিন মাস পর a1c নামের একটি বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে ডাক্তারেরা জানতে পারেন রোগীর সুগার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে কি নাই। সুতরাং আমার স্বামী ব্যাপারটি জেনেছিলেন। প্রথম যখন একটি কিডনি তে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তখনো তিনি পেশাব করতে পারতেন। কারণ কিডনি নষ্ট হবার জন্য একটা কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে দ্বিতীয় কিডনি যখন মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ করছে তখন আপনাকে ডায়ালাইসিস করাতে হবে। সুতরাং নিজের উপর সামান্যতম নিয়ন্ত্রণ থাকলে তিনি নষ্ট হবার এই প্রক্রিয়াটা সামলে দিতে পারতেন। আমি পেশায় ডাক্তার নই, তবুও পুরো ব্যাপারটা আমি জেনেছি আমার বাবার থেকে । বাবাকে কিডনি দেয়ার সময় আমি জেনেছি সেখানে ক্রস ম্যাচিং এর একটা ব্যাপার আছে। মেয়ে তার বাবাকে কিডনি দিতে পারবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার স্বামী, ধরেই নিয়েছিলেন , আমি চাইলেই একটা কিডনি তাকে দিতে পারব।একটা মানুষ নির্বোধ না হলে এরকম ভাবার কোন কারন নাই। ব্যাপারটা যখন তার পরিকল্পনা মাফিক ঘটল না, সেটাই ছিল আমাদের বিয়ের ডিল ব্রেকার। আমি অবশ্য তখনও ব্যাপারটা বুঝতে পারি নাই।
(৯)
আমি নিজেও নির্বোধ কিছু কম নই। নাহলে আমাদের সম্পর্কের যে শেষ হয়েছে, ব্যাপারটি আমি বুঝতে পারতাম। হয়তো অবচেতন মনে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু এক ধরনের ডিনায়াল কাজ করছিল আমার ভিতরে। তবে আমার স্বামী ফেরত যাবার পরে, আমি ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলাম, আমার শ্বশুরবাড়িতে আমি অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে গেছি। ব্যাপারটা আমি প্রথম লক্ষ্য করলাম, আমার স্বামী চলে যাবার পর দিন সকালে। নাস্তার টেবিলে যখন আমাকে ডিম পোচ দেয়া হলো না কিংবা নাস্তার শেষে চা। আমি পুরো ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিলামনা। যেভাবেই হোক আমাকে এই বাড়িতে টিকে থাকতে হবে। যদি পত্রপাঠ বিদায় হয়ে যাই , তবে আমার বাবা ধরেই নেবেন এতে আমার কোন দোষ ছিল।
(১০)
মানুষের ভালোবাসা যেমন টের পাওয়া যায়, তেমনি টের পাওয়া যায় মানুষের অবহেলা। আমার শ্বশুর বাড়ির প্রতিটি মানুষ আমার প্রতি চরম অবহেলা দেখাতে শুরু করলো। একমাত্র ব্যতিক্রম আমার ভাসুরের ছোট মেয়েটি। তার বয়স ছয় বছর। বড়দের জটিলতার কিছুই সে বুঝতে পারেনি। সে সারাক্ষণ আমার সাথে আঠার মতো লেগে থাকতো। এমনও হয়েছে সারা সন্ধ্যা আমার কাছে গল্প শুনতে শুনতে পেশাব না করে সে আমার পাশে ঘুমিয়ে পড়তো। একদিন গভীর রাত্রে আমার ভাসুর আসলেন, মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে পেশাব করাবেন। মেয়েকে ঘুম থেকে তোলার সময় খুব আলতো করে তিনি আমার শরীর ছুঁয়ে দিলেন। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, যেন অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা মেয়েরা একটি বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে এই পৃথিবীতে আসি। এ জাতীয় ঘটনা ঘটলে আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি ব্যাপারটি ইচ্ছাকৃত নাকি হঠাৎ হয়ে গেছে। এই বিশেষ ক্ষমতা প্রকৃতি আমাদের মাঝে দিয়ে দেয়, যেন মানুষ রুপী পশু গুলোকে আমরা চিহ্নিত করে নিজেদের কি নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যেতে পারি।
(১১)
এতদিন আমি দাঁত কামড়ে আমার শ্বশুরবাড়িতে পড়েছিলাম, কিন্তু এই ঘটনায় আমার সেই কঠিন কামড় আলগা করতে হলো। একবার যখন উনার চোখ আমার দিকে গিয়েছে, তখন ব্যাপারটার দিন দিন অবনতি ঘটবে। আমি আর সেই দুঃসময়ের অপেক্ষা না করে পরদিন সকালে আমার বাবার বাড়ি ফেরত আসলাম। আমার বাবা ধরেই নিলেন আমার এই ব্যর্থ বিবাহের পুরোটা দায়ভার আমার। শ্বশুরবাড়িতে আমার জীবন যেমন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল, বাবার বাড়িতে ও সেই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো না।বাইরের মানুষের দুর্ব্যবহার সহ্য করা যায়, কিন্তু নিজের মানুষের থেকে পাওয়া কষ্ট, সে যে কি ভীষণ ভয়ানক, তা আমি আপনাদের ভাষায় বুঝিয়ে বলতে পারবোনা। মাঝে মাঝে আমার পরিবারের ব্যবহার খুব অসহ্য মনে হলে আমি আমার সেই মন খারাপের জায়গা, বাড়ির পাশের সেই বর্গাকার দীঘির শান বাধানো ঘাটে এসে বসতাম।
(১২)
এক সন্ধ্যার কথা। বাসায় লোকদের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সেখানে এসে বসে রয়েছি। মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। এমনই এক গোধূলি লগ্নে পাড়ার এক মুরুব্বী নামাজে যাবার পথে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন আমি কবে স্বামীর কাছে আমেরিকা যাব। ইদানিং এই একটা ব্যাপার হয়েছে, আমার পরিচিত প্রতিটি মানুষ আমার আমেরিকা যাবার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছেন। আসলে সবাই একটু ঝামেলা আঁচ করতে পেরেছে, এই প্রশ্নের মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হতে চায়। সেদিন , সেই পুকুরপাড়ে রক্তিম আলোয় ভরা গোধূলিলগ্নে আমি জীবন নিয়ে একটি নতুন সিদ্ধান্তে আসি। আমি ঠিক করি আমার চিরচেনা এ পরিচিত পরিবেশ পিছনে ফেলে আমি দূরে কোথাও চলে যাব।
(১৩)
বিয়েতে আমি সামান্য কিছু নগদ অর্থ পেয়েছিলাম উপহার হিসাবে। বিয়েতে পাওয়া সেই সবগুলো খাম খুলে আমি সব টাকা একত্রিত করে পরদিন সকালে ঢাকায় চলে আসলাম। আমার এক বাল্য বান্ধবী ধানমন্ডি ২ নাম্বার রোডে একটি মেয়েদের হোস্টেলে থাকে। সৌভাগ্যবশত তার ঘরে পাশের খাটটি খালি পড়েছিল। আমি এসে উঠলাম ওর সাথে। শুরু হলো ঢাকায় আমার একাকী স্বাধীন জীবন। স্বাধীন বললাম এই জন্য, যে ঢাকা আসার কিছুদিন পরে আমি আমার শ্বশুর বাড়ির ঠিকানায় উকিল নোটিশ পাঠিয়ে দিলাম। বাসার সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমি কাজটি করি। তারা চেয়ে ছিলেন, আমি যেন আমার স্বামীর থেকে কাবিনের নির্ধারিত টাকা টি আদায় করি। কিন্তু আমার স্বামী দেশ থেকে যাবার পর আমার সাথে কোন যোগাযোগই করেনি। এক ধরনের লুকোচুরি খেলছিলেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন এই লুকোচুরি খেলায় ধৈর্য হারিয়ে একসময় আমি তালাক দিতে বাধ্য হব। ভাগ্যিস তিনি আমাকে তালাক দিতে বাধ্য করেছিলেন, কেন তা যথাসময়ে আপনাদের জানানো হবে।
(১৪)
বসে খেলে রাজার রাজভান্ডার ও নাকি একসময় শেষ হয়ে যায়। সেখানে আমি তো আর রাজকন্যা না। সুতরাং খুব শীঘ্রই আমাকে টিউশনি শুরু করে দিতে হলো বেঁচে থাকার তাগিদে।সারাদিন টিউশনি করি আর সারারাত চাকরির আবেদনপত্র জমা দেই। নতুন পরিবেশে এই ছিল আমার দৈনন্দিন রুটিন। হঠাৎ করেই একদিন ডাক চলে আসে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে। ইন্টারভিউ বোর্ডে আমাকে একটি অদ্ভুত প্রশ্ন করা হয়। আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন আমি অফিসার পদে আবেদন করিনি। প্রশ্নটির মধ্যে আমি এক ধরনের প্রশ্রয়ের গন্ধ খুঁজে পাই। প্রশ্নকর্তা মনে করছেন আমি এর চাইতে বড় পদে চাকরি করার যোগ্য। আমার সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে চাকরিটা আমার হয়ে যায়। তবে সমস্যা একটাই, আবেদনপত্রে যেহেতু আমার স্থায়ী ঠিকানা কুমিল্লা, সুতরাং তারা ময়নামতি শাখায় আমাকে নিয়োগ করে। কিন্তু ততদিনে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ কোর্সে ভর্তি হয়ে গেছি। আমার জন্য ঢাকায় পড়াশোনা করা খুবই কঠিন হয়ে গেল।প্রায় দিনই আমি সময় মত ক্লাসে পৌঁছাতে পারি না।
(১৫)
একদিন ক্লাসের শেষে আমার এক সহপাঠী হাসি হাসি মুখ করে এসে জিজ্ঞেস করল, 'আপনি এত ফাঁকি দেন কেন?"আমি এই প্রথম ছেলেটিকে লক্ষ্য করলাম। কিছু কিছু ছেলের হাসির মধ্যে এক ধরনের নির্ভরতা থাকে, মনে হয় এদের উপর নিশ্চিন্তে ভরসা করা যায়। এই ছেলেটির হাসিটিতেও তেমনি স্বর্গীয় একটি ব্যাপার রয়েছে। আমি হাসতে হাসতে বললাম, "পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে, কিছু মানুষ খালি সমালোচনা করতে পছন্দ করে! আর কিছু মানুষ প্রয়োজনে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেয়। আপনি কোন ধরনের?"
"আপনার কি মনে হয়?"
"আমার মনে হয় প্রয়োজনে আপনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পছন্দ করেন!"
"এখন তো মুশকিলে পড়ে গেলাম, ইচ্ছে না থাকলেও সাহায্য করতে হবে। গতকালকের নোট চাই?"
"দিলে তো খুব ভালো হয়!"
"দিতে পারি ,যদি কফি খাওয়ান।"
(১৬)
কফি খেতে খেতে সাব্বির জিজ্ঞেস করল," আপনি আসলেই অনেক ফাঁকি দেন, কারণটা কি?"
"আমাকে অন্য একটা শহরে চাকরি শেষ করে ঢাকা আসতে হয়, ক্লাস করবার জন্য। ম্যানেজারের মন ভালো থাকলে, কোন কোন দিন আগে ছাড়া পাই। যেদিন তাড়াতাড়ি বের হতে পারি না, সেদিন আর ঢাকা আসিনা।"
"এটা কিসের চাকরি?"
"ব্যাংকের!"
"আমাদের একটা ব্যাংক আছে! আপনি চাইলে আমি বাবাকে বলে আপনার জন্য ঢাকার কোন একটা শাখায় আপনার চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি।"
"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ! তাহলে তো খুবই ভালো হয়।"
"কন্সিডার ইট ডান। আপনার নামটাই তো জানা হলো না। "
"আকলিমা, আকলিমা খানম!"
"আমার নাম সাব্বির, সাব্বির হোসেন!"
(১৫)
"এটা কেমন হলো? আমাকে ক্লাস ফাকি দেবার অপবাদ দিয়ে এখন নিজেই ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছেন?"
"কালকের কথা বলছেন? আমাকে হঠাৎ করে একটু খুলনা যেতে হয়েছিল। আমাদের একটা পাটকল আছে সেখানে। আমার বাবা সেটা দেখাশোনা করেন। গতকাল সকালে যখন উনি সেখানে যান, তখন আসন্ন ঈদের বোনাসের দাবিতে শ্রমিকেরা আমার বাবাকে তার রুমে আটকে রেখেছিল। তাই তাকে ছাড়িয়ে আনতে যেতে হলো, ক্লাসে আসতে পারিনি।"
"কিভাবে ছাড়ালেন?"
"সব দাবি মেনে নিলাম!"
"আসলেই?"
'কি করবো? বাবাকে ওখানে সারা দিন আটকে রাখবো? তবে পাটকল টা আমাদের গলায় কাটার মত হয়ে গেছে।"
"আপনাকে একটা গল্প বলি, আমার নিজের জীবনের গল্প! আমার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল! বিয়ের পরে বুঝতে পারলাম, he married me for all the wrong reasons. তখন নিজের সব ক্ষতি মেনে নিয়ে তাকে মুক্ত করে দিলাম। নিজেও মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করলাম। মাঝে মাঝে আমাদের ক্ষতি মেনে নিতে হয়। পাটকল থেকে যদি লাভ না হয়, তবে সেটা বেঁচে দিন, জায়গা, ইকুপমেন্ট থেকে যে পয়সা পাবেন , তা দিয়ে নতুন কোনো ব্যবসা করবেন।"
"আমিও মনে মনে সেটাই ভাবছিলাম, great minds think alike. ভালো কথা, ঈদে কি করছেন? হোস্টেলে থাকবেন নাকি কুমিল্লায় ঈদ করবেন?"
"কুমিল্লায় !"
"আমি কিন্তু আপনাকে খুব মিস করবো!"
"মিস করলে বেড়াতে চলে আসবেন, মাত্র তো ৫৭ মাইল!"
(১৬)
আমি মজা করার জন্য কথাটা সাব্বিরকে বলেছিলাম। সে যে সত্যি সত্যি এসে হাজির হবে, সেটা আমার ধারনার বাইরে ছিল। চাঁদ দেখার জন্য আমরা সবাই যখন বাড়ির সামনে পড়ে থাকা এক চিলতে জমিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম সন্ধ্যার মুখে, তখন হঠাৎ করে আমার মেসেঞ্জারে টুং করে শব্দ।
"আপনি বলেছিলেন মিস করলে আপনাকে দেখতে চলে আসতে, ৫৭ মাইল খুব একটা দূরত্ব নাকি না, অন্য সময় হয়তো সত্যি, কিন্তু ঈদের আগের দিন ঢাকা থেকে ৫৭ মাইল অনেকটাই দূরত্ব!"
"মানে কি, আপনি কি কুমিল্লায়?"
"জী ম্যাডাম। আপনাদের বিষ্ণুপুরে। ল্যাংটা ফকিরের মাজারের পাশে আপনার সেই মন খারাপের দীঘির পাড়ে, সেই সিঁড়ির ওপরে শানবাঁধানো বেঞ্চিটাতে বসে আছি। ইচ্ছা হলে দেখা করে যেতে পারেন।"
(১৭)
ইংরেজীতে একটা কথা আছে,"there is always light at the end of the tunnel."সুড়ঙ্গের ভিতরের অন্ধকার কেটে যে তীব্র গতিতে ট্রেন আলোর দিকে ছুটে যায়, আমিও সেদিন সেই গোধূলি লগ্নে ঠিক তেমনি তীব্র গতিতে আমার জীবনের অন্ধকার শেষের আলোর দিকে ছুটে গিয়েছিলাম।*
*এই গল্পে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনা এবং চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে কোথাও কোনো মিল পাওয়া গেলে তা হবে নিতান্তই কাকতালীয়।