কৃষ্ণকলি

1 29
Avatar for Kawser595
4 years ago

কৃষ্ণকলি

"সত্যি বলছেন ভাবি?আসলেই এটা মাখলে ফর্সা হয়?"-উত্তেজনায় আমার মায়ের মুখ চকচক করছে।

"অবশ্যই ভাবি।দেখবেন এক মাসের মধ্যে গায়ের রঙ কাঁচা হলুদের মত হয়ে গেছে।"-রাজিয়া খালা হাত নেড়ে নেড়ে বললেন।

তিনি কথাটা ইচ্ছে করেই জোরে জোরে বলছেন যাতে এঘরে বসেও আমি সেটা শুনতে পাই।

মা একগাল হাসি নিয়ে আমার রুমে দৌড়ে এলেন।

"হ্যাঁ রে আলো,এই ক্রিমটা নাকি আসলেই কাজ করে!"

শিশুরা বহুদিন ধরে বায়না করার পর নতুন খেলনা পেলে তাদের মুখটা যেমন হয়, মাকে দেখতে

ঠিক সেরকম লাগছে।আমার খুব মায়া লাগছে মায়ের জন্য।ছোটবেলা থেকেই দেখছি আমাকে

সুন্দর বানানোর কি আপ্রাণ প্রচেষ্টা মায়ের মধ্যে!কখনও উপটান,কখনও ক্রিম,কখনও চন্দনের গুঁড়ো,কিছু না কিছু আমার মুখে লাগিয়ে মিথ্যে আশা নিয়ে অপেক্ষা করা-যদি আমার প্রতি আল্লাহর অবিচারটাকে মিথ্যে প্রমাণ করা যায়!

কোন বারই কিছু হয়না,কিন্তু মা তবুও আমার মুখটা আয়নার সামনে নিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে কায়দা কানুন করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেন,

"বাহ,এইতো বেশ লাগছে দেখতে!কেমন পাল্টে গেছে না মুখটা!"

আমিও তখন খুব দুর্বলভাবে একটু হেসে বলি,"ঠিকই তো মা!"

মা মেয়ের এই মিথ্যে সান্ত্বনার লুকোচুরি দুজনেই আমরা বেশ বুঝি।বোঝেন আরও একজন,

অন্তরীক্ষের ঐ ব্যাক্তিটি,যিনি জন্ম থেকেই আমার কপালে সীলমোহর করে দুঃখ লিখে দিয়েছেন,

আর উপরে বসে বেশ আয়েশ করে মজা দেখছেন।

আমার বাবা বেশ ধনী মানুষ।বহু জায়গায় বহু পাত্রী দেখে অবশেষে হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে,আমার মাকে বিয়ে করেন।কারণ একটাই-আমার মা অসামান্য রূপসী।

বাবা চেয়েছিলেন তার বংশধরেরা দেখতে সুন্দর হোক।প্রথম সন্তানের মুখ দেখে নাকি বাবার মুখ শ্রাবণের আকাশের মত হয়ে গিয়েছিল।মেয়ের গায়ের রঙ,মুখ,নাক সবই তো তার মত!

হতচ্ছাড়ি দেখছি মায়ের কিছুই পায়নি!মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল প্রথম সন্তান মেয়ে হলে নাম রাখবেন আলো।

কিন্তু বাবা মুখ বেকিয়ে বললেন,

"যার চেহারায় আলোর ছিটেফোঁটা নেই,তার নাম হবে আলো!কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন আর কাকে বলে!"

সে যাইহোক,চেহারায় আলো না থাকলেও আমার নাম আলোই রাখা হল।

আমার পরে আরও দুটি বোন আর দুটি ভাই।নাহ,এরা বাবাকে নিরাশ করেনি।প্রত্যেকেই দেখতে বেশ......

ছোটবেলা থেকেই আমি জেনেছি,আমার বাকি বোনেরা ফর্সা,তাই তারা সুন্দর।আমি দেখতে কাল,

আমার তাই নিজের মধ্যে কুঁকড়ে মুকড়ে থাকাই শ্রেয়।ঈদের সময় মামারা যখন উপহার নিয়ে আসত আমাদের জন্য,দেখতাম প্রতিবারই কিভাবে কিভাবে যেন সবচে সুন্দর উপহারটা আমার দুই সুন্দরী বোনই পেত।তারপর ভাবতাম,

কি খারাপ আমি!নিজের ছোট বোনদেরই হিংসা করছি!বাসায় মেহমান আসলে আমার বোনদের দেখে প্রশংসায় ভেসে যেত।পাশে দাঁড়ানো আমাকে দেখে নিতান্ত ভদ্রতায় হয়ত বলত,

"আপনাদের এই মেয়েটিও তো দেখতে বেশ!কাল হলেও চেহারায় মায়া আছে।"

কেন জানিনা,খুশি হওয়ার বদলে আমার বুক কান্নায় ভারী হয়ে আসত।কালো হতে পারি,তাই বলে অন্ধ তো আর নই!তার চোখে যে সুস্পষ্ট করুণা,সেটা তো খোলা চোখেও বেশ দেখতে পাই আমি.....

ছোটবেলা থেকেই বেশ ভাল ছাত্রী ছিলাম আমি।ফাইভ আর এইটে বৃত্তি পেয়েছিলাম।ম্যাট্রিক আর ইন্টারেও পেয়েছিলাম গোল্ডেন এ প্লাস।তারপর ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম।

অনেক নতুন বন্ধু হল।সবাই মিলে কার্জন হলে আড্ডা,মহিলা সমিতিতে নাটক দেখতে যাওয়া, অথবা রাত ১১টায় হই হুল্লোড় করে টিএসসি তে গিয়ে মালটোভা দেয়া চা খাওয়া-এসবের মাঝে আমার প্রাণহীন জীবন যেন নতুনভাবে শুরু হল।আর সেই নতুন জীবনে নতুনভাবে আলো নিয়ে এল অর্ণব।অসাধারণ আবৃত্তি করতে পারে ছেলেটা।

ও যখন গলার শিরা ফুলিয়ে ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তি করে,তখন আমার এতদিনের গৃহপালিত রক্তও জেগে ওঠে,কি যেন এক শক্তি ভর করে নিজের ভেতর।অর্ণব আমাকে ডাকত কৃষ্ণকলি বলে।প্রতিদিন একটা করে চিঠি লিখত আমাকে।

দু-এক লাইনের চিঠি......তবে সব চিঠিই নীল খামে ভরা থাকত।আর উপরে রূপালি

কালিতে লেখা থাকতো-"কৃষ্ণকলি,তোমাকে......।"

মাঝে মাঝে কি ভীষণ ঝগড়াটাই না করত আমার সাথে!কেন আমি রফিকের সাথে অত হেসে হেসে কথা বললাম,কি এমন হাসির কথাটা ও বলেছে?কেন পহেলা বৈশাখে লাল শাড়ি না পরে সবুজ শাড়ি পরলাম,চুল গুলো কেন বেঁধে রাখলাম,আর কেনইবা অমন বিচ্ছিরি একটা সিনেমা দেখার জন্য ওকে ফেলে অন্য বন্ধুদের সাথে চলে গেলাম!!

একবার তো কি যেন কারণে আমারওপর রাগ করে মাথার সব চুল কেটে ফেলে ন্যাড়া হয়ে গেল।কি চোখের পলকেই না চলে গেল সেই পাঁচটা বছর!

কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সুখ আমার কপালে সইবে কেন?ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার কিছুদিন আগে অর্ণব আমাকে জানিয়ে দিল,তার পরিবার কিছুতেই আমাকে মেনে নেবেনা.....সে বাবা-মার একমাত্র ছেলে।

তাই তাদের খুব শখ নিজেরাই দেখেশুনে মিষ্টি একটা সুন্দর মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার।অর্ণবের মা আগেও দেখেছেন আমাকে,তার নাকি সাফ কথা,"ঘরের একমাত্র বউ দেখতে ফর্সা হতে হবে।"

আমার রঙিন চশমা লাগানো পৃথিবীটা আবার কেমন যেন ধূসর হয়ে গেল।পরীক্ষা না দিয়েই বাসায় ফিরে গেলাম।এবার বাবা মা উঠে পড়ে লাগলেন আমার বিয়ের জন্য।তাদের খুশির জন্য চোখের পানি আড়াল করে ট্রে ভর্তি চা নিয়ে পাত্রপক্ষের সামনেও গেলাম।মেয়ে হয়ে জন্মেছি,

আর যা কিছু পারিআর নাই পারি...চোখের পানি আড়াল করার বিদ্যাটা তো শিখতেই হবে।কুরবানির গরুর হাটেও বোধ করি মানুষ এতভাবে গরু দেখে যাচাই বাছাই করেনা।সে যে কি অপমান,কি লজ্জা,কি অসহায়ত্ব-তা আমি কি করে বোঝাই!কিন্তু পাত্রপক্ষ আমাকে পছন্দ না করে পছন্দ করে আমার ছোট বোনকে।

তারপর থেকে পাত্রপক্ষ আসলে আমার দুই বোনকে তাদের সামনেই যেতে দেয়া হয়না।

প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন পাত্রপক্ষ আসে,মা যথাসাধ্য চেষ্টা করেন পাউডার আর নানা প্রসাধন লাগিয়ে আমার গায়ের রঙ আর চেহারার খুঁতগুলো আড়াল করতে।চেহারা খানিকটা আড়াল হয় বটে,আড়াল হয়না শুধু আমার লজ্জা আর অপমান।

প্রায় দেড় ডজন প্রস্তাব এসে ফিরে যাওয়ার পর অবশেষে আমার বিয়ে ঠিক হয় আমাদের পাড়ার কমিশনারের ছোটভাইয়ের সাথে।

ক্লাস নাইন পর্যন্ত কোনোমতে পড়ে এখন বাপ ভাইয়ের পয়সায় রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে সিগারেট ফোঁকে আর গার্লস স্কুলের সামনে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে শিস বাজায়।কিন্তু মা বাবার এত বাছ বিচার করার সুযোগ আর নেই।আমার বিয়ে আর কতদিন আটকে থাকবে?ছোট বোনদুটোর বিয়েও তো দিতে হবে।

মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম।কিন্তু আমার অপমান তখনও খানিকটা বাকি ছিল।আমাকে আরও খানিকটা নাস্তানাবুদ না করলে বিধাতার সইবে কেন?বিয়ের আসরে ছেলে পক্ষ বেঁকে বসল।তাদের সাফ কথা,নগদ পাঁচ লাখ টাকা না দিলে তারা কিছুতেই বিয়ে পড়াবে না।

আমি দেখলাম আমার এত আত্মমর্যাদা সম্পন্ন শিক্ষিত বাবা কিভাবে একদল নোংরা, অশিক্ষিত লোকের কাছে সম্মানের ভয়ে মাথা নত করলেন।আমার তখন মনে হল,আমার বাবার সামর্থ্য আছে বলে তিনি হয়ত আজকে এই টাকাটা দিতে পারছেন।কিন্তু যদি দিতে না পারতেন,তাহলেতো পাত্রপক্ষ চলেই যেত।তার মানে আমি আছি কি নেই,এটা মুখ্য বিষয় না।আমাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য এই পাঁচ লক্ষ টাকা।আমি আর পারলাম না।সোজা বাইরে বেরিয়ে বললাম,

"পাঁচ লক্ষ টাকার জন্য আপনাদের নিজেকে বিক্রি করার দরকার নেই।টাকাটা অবশ্য আপনারাএখনও নিতে পারেন।তবে ভিক্ষা হিসেবে,যৌতুক হিসেবে না।কারণ আমি এই বিয়ে করব না।"

এই প্রথম আমার মনে হল আমার জীবনে আজকে সত্যিই আলো এসেছে।নিজেরসম্মান বিকিয়ে দিতে দিতে যেখানে নেমে গিয়েছিলাম আমি,সেখান থেকে এক ধাপে অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছি......নাইবা থাকলো আমার জীবনে ভালবাসা,নাইবা হল সংসার...

এখন আমি নিজের ভেতর যে শান্তি আর মর্যাদা টেরপাচ্ছি,এক জীবন কাটিয়ে দেয়ার জন্য সেটাই যথেষ্ট......

(উপরের গল্পটার অনেকখানিই আশেপাশের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া।আমি এই গল্পের মধ্য দিয়ে কাউকে কোন মেসেজ দিতে চাইনি।

কারো মানসিকতা পরিবর্তনের কোন চেষ্টাও করিনি।আমি শুধু চেয়েছি,যারাই এই গল্পটা পড়বেন তারা যেন একটু হলেও এই মেয়েটির কষ্ট

অনুভব করেন।গায়ের রঙ অথবা চেহারা-এই জিনিসগুলো মানুষ কষ্ট করে অর্জন করেনা,জন্মসূত্রেই এই জিনিসটা নিয়ে সে আসে।জন্মসূত্রে পাওয়া

জিনিসের জন্য কেউ যেমন নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে পারেনা,তেমনি জন্মসূত্রে পাওয়া জিনিসের জন্য তাকে অপমান করারও কোন অধিকার কারোনেই।

চেহারার সৌন্দর্য কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মলিন হয়।কিন্তু মনের সৌন্দর্য কিন্তু চিরকাল থাকে......শুধু পবিত্র মানুষেরাই সেই পবিত্র সৌন্দর্যের সন্ধান পান...

Sponsors of Kawser595
empty
empty
empty

3
$ 0.20
$ 0.20 from @TheRandomRewarder
Avatar for Kawser595
4 years ago

Comments

Gol Puri Khoob Bhalo Lucknow thanks for your writing ing story

$ 0.00
4 years ago