বেলা ফোরাবার আগে।

1 22

কিরজেইডা রড্রিগেজ। পৃথিবীর বিখ্যাত একজন ফ্যাশন ডিজাইনার, ফ্যাশন ব্লগার এবং সেলিব্রিটি লেখকের নাম। অর্থ-কড়ি, বিত্ত-বৈভব কিংবা যশ-খ্যাতি- একজীবনে ‘অপ্রাপ্তি’ বলে সম্ভবত কোনাে কিছুই নেই তার ঝুলিতে। দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলা রড্রিগেজ খুব সম্প্রতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর আগে বলে যান কিছু শেষ অনুভূতি। সেই অনুভূতিতে উঠে আসে কিছু টলটলে সত্য। এমন অকপট স্বীকারােক্তি রঙিন কর্পোরেট দুনিয়া আমাদের কখনােই জানাবে না। রড্রিগেজ লিখেছেন-

পৃথিবীর দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি পড়ে আছে আমার গ্যারেজে। কিন্তু কী আশ্চর্য, সেই গাড়িতে আমি আর চড়তে পারছি না! নিত্যনতুন দামি সব ডিজাইনের কাপড়ে আমার ড্রয়ার ভরতি। কিন্তু আজ সেগুলাে আর আমার গায়ে তােলা সম্ভব নয়। আমার সংগ্রহে থাকে পৃথিবীর দামি ব্র্যান্ডের জুতাে। সবচেয়ে দামি ব্যাগটাই থাকে আমার দখলে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, আজ সেগুলাে নিতান্তই অকেজো আমার ঘরে! টাকায় ভরতি আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, অথচ সেই টাকা আজ আর কোনাে কাজেই লাগছে না। আমার অত্যাধুনিক বাড়িটা দামি দামি সব আসবাবপত্রে ভরপুর, কিন্তু সেই আসবাবে শুয়ে আমি যে একটু আরাম করব, সেই সুযােগ আর । কই? হাসপাতালের ছােট্ট বিছানায় আজ আমি কাতর। অথচ এমনও সময় ছিলাে, পৃথিবীর যেকোনাে প্রান্তে যেতে মন চাইলে আমি আমার ব্যক্তিগত প্লেনে চেপে।


85 




দিব্যি চলে যেতে পারতাম! আমার জীবনে কোনাে কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু। আমার হৃদয়জুড়ে অভাবের হাহাকার। আমার সবকিছুই আছে, কিন্তু সব থেকেও আজ আমি কেমন যেন নিঃসৃ!

অর্থকড়ি উপার্জনের জন্য যে মানুষটা নিজের গােটা জীবনটাই ব্যয় করল, জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে সেই টাকা, সেই অর্থ তার কোনাে কাজেই আর লাগছিল না। সবচেয়ে দামি পােশাক গায়ে দিয়ে যে মানুষ চষে বেড়াত পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, সময়ের পরিক্রমায় হাসপাতালের দেওয়া রঙিন একটা চাদর ব্যতীত আর কোনাে কিছুই সে গায়ে তুলতে পারছে না! দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি কিংবা ওড়ার জন্য আধুনিক মানের জেট না হলে যার চলতই না, সে কিনা বন্দি হয়ে পড়ে হুইল চেয়ারের শিকলে! জীবন কতটা প্রবঞনাময়, কতটাই ঠুনকো, তাই না? জীবন আসলে একটা মরীচিকার নাম যেখানে মৃত্যুই হলাে ধ্রুব সত্য। দুনিয়ার জীবন বিশাল একটা নাট্যমঞ্চের ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, এই দুনিয়ার উপমা হলাে এমন এক মুসাফিরের মতাে, যে তার ভ্রমণে বের হয়েছে। পথিমধ্যে ক্লান্ত লাগছিল বলে সে একটা গাছের ছায়ায় একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার পথচলা আরম্ভ করেছে। [1]

পথিকের দীর্ঘ সফরটা কিন্তু দুনিয়ার জীবন নয়। সেই সময়টা আরও বহু মাত্রায় প্রলম্বিত। কেবল গাছের ছায়ার নিচে সে যে সময়টুকু ব্যয় করেছে, ওইটুকুই হলাে দুনিয়ার জীবন! মানে, একটা সুদীর্ঘ সময়ের যাত্রায় কেবল খুব অল্প কিছু সময়ের বিশ্রামের নামই হলাে দুনিয়া।

মানুষের জীবনে মৃত্যুর মতন নির্মম সত্য আর কিছু নেই। অথচ সেই নির্মম সত্যকে, সেই অখণ্ডনীয় বাস্তবতাকে অস্বীকার করার জন্য আমাদের কত তােড়জোড়। আমরা মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাই। কিন্তু পালাতে গিয়ে আমরা মৃত্যুর আরও সন্নিকটে চলে আসি। মৃত্যু আসলে আমাদের তাড়া করে না। মৃত্যু তার নির্ধারিত থানে অপেক্ষারত। সময়ের পরিক্রমায় আমরাই বরং মৃত্যুর দিকে ছুটে যাই নিরন্তর।

ধুকপুক ধুকপুক শব্দে বেজে চলছে আমার হৃৎপিণ্ড। এই কথার অর্থ দুটো। প্রথমত, আমি এখনাে জীবিত আছি, আর দ্বিতীয়ত, আমি একদিন অবশ্যই মারা যাব। বিজ্ঞানের


86 




তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রে আমরা পড়েছি, গরম একটি কফির কাপকে টেবিলের। ওপর রাখা হলে সময়ের ব্যবধানে সেটি আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে থাকবে। তবে সেটি কখনােই আরও বেশি গরম হয়ে উঠবে না। তাপগতিবিদ্যার এই সূত্র মানুষের জীবনের সাথেও অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। মাতৃগর্ভে যেদিন আমাদের প্রাণকণা সঞ্চারিত হয়েছিল, ঠিক সেদিন থেকেই আমাদের জীবনের উন্নতার শুরু। এরপর ধীরে ধীরে সেই উন্নতা আমরা হারিয়ে চলেছি। প্রতিদিন হারাচ্ছি। প্রতিনিয়ত হারাচ্ছি। হঠাৎ এমন একটা সময় আমাদের সামনে উপস্থিত হবে, যখন আমরা সমস্ত উয়তা হারিয়ে স্তন্ধ, ঠান্ডা, শীতল হয়ে যাব। সেদিন ছিন্নভিন্ন হবে আমাদের জাগতিক সকল বন্ধন। এর নামই মৃত্যু!

সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু সালাবাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘তুমি দুনিয়ার জীবন নিয়ে মত্ত, অথচ, হতে পারে তােমার কাফনের কাপড় ইতােমধ্যে ধােপার কাছে চলে এসেছে!’[1]

ভয়ংকর সত্য কথা! এই যে আজ আমি দুনিয়ার স্রোতে গা ভাসিয়ে চলছি, আখিরাতের চিন্তা হৃদয়-মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি, আমি কি নিশ্চিত যে আগামীকালকের রাঙা প্রভাতে আমি দুচোখ মেলতে পারব? আজকেই যে আমার জীবনের শেষ দিন নয়, জীবনের শেষ সকালটা যে ইতােমধ্যে আমি পার করে ফেলিনি, তার কী নিশ্চয়তা? আজ যদি আমার মৃত্যু হয়, তাহলে আমার কাফনের কাপড় তাে ইতােমধ্যে বাজারে চলে এসেছে। অপেক্ষা কেবল একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের। যে মুহূর্তে দোকানদারের কাছে আমার মৃত্যুসংবাদ পৌঁছাবে আর তিনি সাড়ে তিন হাত কাপড় কেটে নিয়ে আমার শেষ বিদায়ের জন্য প্যাকেট করে দেবেন।

যদি আজ সত্যিই আমার মৃত্যু হয়, আমি কি তাহলে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানাের জন্য প্রস্তুত? মৃত্যুর আগে শেষ ওয়াক্তের সালাতে আমি কি হাজির ছিলাম? যেদিন আমার মৃত্যু হয়, সেদিন আমার ঘরের টেলিভিশন কতবার অন-অফ হয়েছে আর কুরআন কতবার খােলা-বাঁধা হয়েছে? মৃত্যুর আগের সময়টাতে কতবার আমার ঠোঁটে আল্লাহর যিকির গুঞ্জরিত হয়েছে আর কতবার অহেতুক আলাপে মৌজ-মাস্তি করে আমি সময় কাটিয়েছি?


4
$ 0.00

Comments

ভালো লিখেছেন। এই ধারা অব্যাহত রাখুন। কমিউনিটি র সাথে থাকুন।

$ 0.00
3 years ago