বোকা জুনিয়র্স বনাম রিভারপ্লেট: আর্জেন্টাইন ক্লাব ফুটবলের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর গল্প।

6 15
Avatar for JosiKhan
3 years ago

স্প্যানিশ ফুটবলের ভক্ত হিসেবে আপনি রাতজেগে খেলা দেখতে থাকেন। খেলার সময়সূচিতে চোখ বুলিয়ে প্রতীক্ষায় থাকেন কখন এল ক্লাসিকো শুরু হবে। বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের মতো কিংবদন্তি দুটো ক্লাবের দ্বৈরথের স্বাক্ষী হওয়ার জন্য আপনি সবকিছু ফেলে ছুটে যান টিভিপর্দার সামনে। দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আপনার ফুটবলীয় পিপাসা মেটায়, চোখে শান্তি এনে দেয়, একজন ফুটবল ভক্ত হিসেবে প্রত্যাশা পূরণ করে।
প্রিয় দলের হারে আপনি কষ্ট পান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনার পছন্দের দলের ব্যর্থতা নিয়ে বানানো ব্যঙ্গচিত্র দেখে আপনার কষ্টের ষোলকলা পূর্ণ হয়। বিপরীতভাবে আপনার দল যখন জেতে, তখন আপনি একবুক তৃপ্তি নিয়ে ঘুমোতে যান। পরদিন আপনার প্রিয় দলের দলের সমালোচকদের একহাত দেখে নেন আপনি।
ইতালির ফুটবল নিয়ে সচেতন থাকলে ইন্টার মিলান–এসি মিলানের খেলা দেখার জন্য বিভোর হয়ে থাকার কথা আপনার। ইউরোপের 'পাওয়ার হাউজ' খ্যাত জার্মানির ক্ষেত্রে সেটি হয়ে যায় বায়ার্ন মিউনিখ–বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের ম্যাচ। চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের খেলা আপনার ভালো লাগে। সেক্ষেত্রে শীর্ষ ছয় দলের (চেলসি, আর্সেনাল, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার সিটি, টটেনহাম হটস্পার ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) মধ্যে যেকোনো দুটো দল পরস্পর মুখোমুখি হলে আপনার চোখ চকচক করে ওঠে। ম্যানচেস্টার ডার্বি থেকে শুরু করে চেলসি-আর্সেনাল কিংবা বর্তমানে ধূসর হয়ে যাওয়া মার্সিসাইড ডার্বি (লিভারপুল-এভারটন) দেখার জন্য আপনি আগে থেকেই খেলোয়াড়দের ইনজুরি, কোচের সম্ভাব্য ট্যাকটিক্স ইত্যাদি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে থাকেন, মনে মনে একটি ফলাফল ধরে ম্যাচের অপেক্ষায় থাকেন চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপভোগ করার জন্য।
বর্তমান ক্লাব ফুটবল বলতে গেলে পুরোপুরি ইউরোপকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ইউরোপের নামকরা ও ঐতিহ্যবাহী দলগুলোকেই সবাই সমর্থন করে, ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ম্যাচগুলোর জন্য সবাই অপেক্ষায় থাকে। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে। ইউরোপের দলগুলো যেভাবে শক্তিশালী ফুটবল খেলে থাকে তাতে যে কেউই আকৃষ্ট হবে।
লাতিন আমেরিকা কিংবা আফ্রিকার যেকোনো উদীয়মান ফুটবলারের লক্ষ্য থাকে ইউরোপে খেলার। ইউরোপের চাকচিক্য, ফুটবল উন্মাদনা, বিশাল পরিমাণ অর্থের ঝনঝনানি খেলোয়াড়দের প্রতিনিয়ত চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে থাকে। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পৃথিবীর সবচেয়ে নামকরা ফুটবলাররা খেলে থাকেন, এটাও আমাদের ইউরোপকেন্দ্রিকতার আরেকটি কারণ। কিন্তু বাস্তবে তো ফুটবল শুধু ইউরোপের খেলা নয়, পৃথিবীর মোটামুটি সব মহাদেশেই খেলা হয়ে থাকে।
লাতিন আমেরিকাতেও ফুটবল বেশ জনপ্রিয় একটি খেলা, এবং সেখানকার ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চোখে পড়ার মতো। লাতিন আমেরিকারই অন্যতম দেশ আর্জেন্টিনার দুটি ফুটবল ক্লাব একশো বছরেরও বেশি সময় নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে সমানে সমানে। দুটো দলের ম্যাচকে 'সুপারক্লাসিকো' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে সবসময়। বলা হচ্ছিল আর্জেন্টিনার দুই কিংবদন্তি ফুটবল ক্লাব রিভার প্লেট ও বোকা জুনিয়র্সের কথা।
আর্জেন্টিনা রিভার প্লেট ও বোকা জুনিয়র্স ঠিক কতটা জনপ্রিয়, তা একটি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে খানিকটা আঁচ করা যাবে। আর্জেন্টিনার মোট জনসংখ্যার সত্তর শতাংশ মানুষ এই দুই ক্লাবের যেকোনো একটির ভক্ত! ডিয়েগো ম্যারাডোনা, আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, হার্নান ক্রেসপো, রাদামেল ফ্যালকাও কিংবা কার্লোস তেভেজের মতো ফুটবলারের একসময় এই দুই ক্লাবের ঐতিহ্য টেনে নিয়ে গিয়েছেন, ক্লাবের সম্মান ঠিক রাখতে মাঠে নিজেদের সর্বোচ্চটা নিংড়ে দিয়েছেন। এই দুই দল শুধু মাঠেই প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, মাঠের বাইরেও দুই দলের ভক্তদের মধ্যে বিভাজন রেখা দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট। দুই দলের ম্যাচকে কেন্দ্র করে আর্জেন্টিনার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আলাদাভাবে সতর্ক থাকতে হয়। ম্যাচের দিন স্টেডিয়ামের সামনে বাড়তি নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েনের ঘটনা দুই দলের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিকেই রূপক হিসেবে তুলে ধরে।
আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি দুটো ক্লাবেরই বয়স ১০০ বছরের বেশি। রিভারপ্লেট প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০১ সালে। অন্যদিকে বোকা জুনিয়র্স প্রতিষ্ঠা পায় তার তার চার বছর পরে, ১৯০৫ সালে। দুটো ক্লাবেরই জন্ম একই শহরে, আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে পাশে লা বোকা শহরতলীতে। বোকা জুনিয়র্সের প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন ইতালি থেকে আর্জেন্টিনায় কাজ করতে আসা ইতালিয়ান অভিবাসী, যারা জাহাজ কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন লা বোকা নামক জায়গায়। দুটো ক্লাব পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও ১৯২৫ সালের দিকে রিভার প্লেট লা বোকা থেকে সরে গিয়ে নুনেজ নামে একটি তুলনামূলক সমৃদ্ধ শহরে ঘাঁটি গাড়ে। সেখানে ক্লাবের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় 'এল মনুমেন্টাল' নামের বিখ্যাত স্টেডিয়াম।
রিভার প্লেট ১৯৩০ সালের পর থেকে ক্লাবের যাবতীয় বিষয়ে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে থাকে। ১৯৩২ সালের দিকেই তারা বার্নাবে ফেরেইরা নামের একজন স্ট্রাইকারকে ৫০ হাজার ডলারের বিনিময়ে সাইন করায়। আজকের দিনের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের বিপরীতে এটি খুব ক্ষুদ্র মনে হতে পারে, কিন্তু সে সময়ের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট মাথায় নিলে এটি একটি বিশাল সাইনিং। শুধু এটাই না, আরও কিছু বড় সাইনিং করিয়ে ক্লাবটি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। এর ফলাফলও হাতেনাতে পেয়ে যায় তারা। ১৯৩২ সালে কোপা ডে কম্পিটেনসিয়া ও প্রিমেরা ডিভিশন– দুটো বড় ট্রফি জিতে নেয় রিভার প্লেট। আর স্ট্রাইকার বার্নাবি ফেরেইরা পুরো ১৯৩২-৩৩ মৌসুমে ৪৩ গোল করে লাতিন আমেরিকার সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
আর্জেন্টিনায় কঠোর পরিশ্রম করে অল্প আয় করা শ্রমিকশ্রেণী ও পয়সাওয়ালা অভিজাত শ্রেণীর যে দ্বন্দ্ব, তা বিস্তৃত হয় এই দুই ক্লাবের মধ্যেও। বোকা জুনিয়র্সের প্রতিষ্ঠাতারা যেহেতু ইতালির জেনোয়া থেকে শ্রমিক হিসেবে এসেছিলেন, তাই এই ক্লাবের নাম হয়ে গিয়েছিল 'লা জেনেইজেস'। অর্থাৎ জেনোয়াবাসীর ক্লাব। লা বোকা শহরের শ্রমিকশ্রেণীর টাকায় ক্লাব চলতো বলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিভারপ্লেটের মতো দামি সাইনিং হয়তো তারা করাতে পারেনি, কিন্তু মাঠে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে খেলোয়াড়েরা লড়াই করে গিয়েছে।
আর্জেন্টিনার খেটে খাওয়া মানুষেরা সবসময় বোকা জুনিয়র্সকে নিজেদের ক্লাব হিসেবে মূল্যায়ন করেছে, এখনও করে। অপরদিকে রিভার প্লেটের বিশাল অংকের বিনিময়ে খেলোয়াড় সাইনিং করানোর পেছনে তাদের অভিজাত দাতাদের ভূমিকা ছিল। এ কারণে একসময় রিভার প্লেট ক্লাবটি 'লস মিলোনারিওস' বা মিলিয়নিয়ারদের ক্লাব হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। স্বাভাবিকভাবেই আর্জেন্টিনার অভিজাত শ্রেণী রিভার প্লেট ক্লাবের পেছনে সমর্থন জানাতো। অপরদিকে বোকা জুনিয়র্সের হোমগ্রাউন্ড 'লা বোম্বোনেরা' স্টেডিয়ামটি যে নদীর তীরে অবস্থিত ছিল, সেটি থেকে বাজে দুর্গন্ধ আসতো। এজন্য রিভার প্লেট সমর্থকরা বোকার সমর্থকদের নাম দেয় 'বোস্টেরোস', যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় 'ময়লা সংগ্রহকারী'।

১৯৬৬ সালে উরুগুয়ের একটি ক্লাবের বিপক্ষে মহাদেশীয় ক্লাব টুর্নামেন্টে রিভার প্লেট ৪–২ গোলে পরাজিত হয়। সেই ম্যাচে রিভার প্লেট দুই গোলে এগিয়ে থেকেও পরাজিত হওয়ায় বোকা জুনিয়র্সের ভক্তরা তাদের নতুন নাম দেয় 'গালিনাস', যার অর্থ 'মুরগী'। এখানে মুরগী বলতে আসলে বোঝানো হয়েছে লড়াই করার মানসিকতা না থাকা ফুটবল দলকে। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ফুটবলার তেভেজ একবার রিভার প্লেটের বিপক্ষে গোল দেওয়ার পর 'চিকেন ড্যান্স'-এর মাধ্যমে তা উদযাপন করেন। পরে রেফারি তাকে লাল কার্ড দেখান, কারণ এটি দু'পক্ষের ভক্তদের মধ্যে পুরোনো দাঙ্গা উস্কে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।

দু'দলের খেলার দিকে একটু চোখ বোলানো যাক। রিভার প্লেট খেলার দিক থেকে বেশি কৌশলী। তাদের খেলা প্রতিপক্ষের উপর নির্ভর করে, প্রতিপক্ষের আদ্যোপান্ত পর্যবেক্ষণ করে তারা তাদের খেলার কৌশল নির্ধারণ করে। দর্শকদের কথাও তারা মাথায় রাখে। বেশিরভাগ আর্জেন্টাইনের মতে, রিভার প্লেটের খেলা বেশি দৃষ্টিনন্দন। শুধু জেতার জন্য উল্টোপাল্টা কৌশলের আশ্রয় না নিয়ে দর্শক সারি থেকে খেলাটি দেখতেও যেন ভালো লাগে সেদিকে তারা লক্ষ্য রাখে। অপরদিকে বোকা জুনিয়র্স ঐতিহাসিকভাবেই পরিশ্রমী, হাল না ছাড়ার মানসিকতা নিয়ে খেলে থাকে। তাদের একজন স্ট্রাইকার মার্টিন পালের্মো একবার বলেন, "খেলায় পার্থক্য গড়ে দেয়ার বিষয়টি হচ্ছে মানসিকতা। আপনি প্রতি ম্যাচে ভালো খেলতে পারবেন না। কিন্তু জেতার ও লড়াই করার মানসিকতাটা আপনার থাকতে হবে।"

7
$ 0.00
Avatar for JosiKhan
3 years ago

Comments

Nice,Mijan

$ 0.00
3 years ago

Nice,Mijan

$ 0.00
3 years ago

বাহ! অনেক কিছু জানতে পারলাম ফুটবল সম্পর্কে এই লেখাটি থেকে।আসলেই ফুটবল আস্তে আস্তে ইউরোপের দখলে চলে যাচ্ছে।

$ 0.00
3 years ago

Wow great article

$ 0.00
3 years ago

Wow such a nice article

$ 0.00
3 years ago