সদ্য বিসিএস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্যাডার পাওয়া ছেলেটি গতকাল আত্মহত্যা করেছে।
মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে একটি "সুইসাইড নোট" পাওয়া যায়। সুইসাইডনোটে স্পষ্ট লেখা ছিল "সে কথা দিয়েছিল আমার হবে" এক বাক্যের এই বাক্যটি পুরো গোয়েন্দা সংস্থাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।
এক বাক্যের এই বাক্যটিকে নিয়ে পুরো মিডিয়া জগতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থা দিনরাত আমরণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থার কাজই হচ্ছে খুব নিভৃতে জনগণের চক্ষুর অন্তরালে ঘটে যাওয়া সকল কাজ জনগণের সামনে তুলে ধরা।
খুব সহজ মৃত্যু নহে, তবে খানিকটা সহজে আসে বেদনা থেকে।
সমাজের চোখে একজন সফল ব্যক্তির বেদনার উৎস কোথায়। কোথা হতে হতাশার উৎপত্তি। আজও উত্তর মেলেনি।
মৃত্যুর প্রায় 45 দিন অতিবাহিত হওয়ার পরে, 46 দিনের প্রথম প্রহরে কিছু নথিপত্র গোয়েন্দা সংস্থার হাতে এসে পৌঁছায়। সেই সূত্রপাত ধরে শুরু হয় নতুন তল্লাশি, একই স্থানে বারবার তল্লাশি চলতে থাকে।
সত্য খুব সহজে ধরা দেয় না, উন্মোচিত হওয়া অনেক দূরের কথা। সত্য খুব আস্তে করে শেষ মুহূর্তে দরজায় কড়া নাড়ে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্যাডার পাওয়া ছেলেটির আত্মহত্যার ব্যাপারটি মোটেও উল্টো ছিল না। সব সত্যের উন্মোচন একই সূত্রে গাঁথা।
বিসিএস আডমিনিস্ট্রেশন ক্যাডার পাওয়া ছেলেটির রুম থেকে 112 পৃষ্ঠার একটি "ডাইরি বই" পাওয়া যায়। প্রথম পৃষ্ঠা ফাঁকা রেখে পরের পৃষ্ঠাতে লিখেছিলেন -----
~আমি তোমাকে ভালোবাসি
জেবা। আমার ভালোবাসা টুকু
কোন আপেক্ষিক শক্তি নয়,
শুদ্ধতম নিখাদ প্রেম।
একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পড়ে যাচ্ছে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা। 23 তম পৃষ্ঠাতে তিনি থেমে গেলেন, তার গলার স্বর ছোট হয়ে যেতে শুরু হল সবাই কিছুটা থমকে গেল।
সেখানটায় লেখা ছিল:-
~জেবাঃ তুমি যদি ভালো একটি
সরকারি চাকরি পাও তাহলেই
আমি তোমার হবো। তা না হলে
আমার পিতামাতা কখনো
তোমার হাতে আমাকে তুলে দিবে
না।আমি কথা দিচ্ছি তুমি
সরকারি চাকরি পেলে আমি
তোমারই বউ হয়ে যাব, তাতে যত
সময়ের প্রয়োজন আমি অপেক্ষা
করবো।
"প্রমিস"
•
ছেলেটি খুব সৎ সাহস নিয়ে বলেছিল জেবা আমি একদিন ঠিকই সরকারি চাকরি পাব আর তোমাকে আমার বউ করে নিয়ে যাব। শুধু সময়ের প্রয়োজন। আর সেই সময়টা তুমি আমাকে দিবে বলে প্রমিস করেছ, সে জন্য তোমার প্রতি চির কৃতজ্ঞ।
৩৫ এবং ৩৬ তম বিসিএসে ব্যর্থ হয়ে ও মোটেও ভেঙে পড়েনি। লক্ষ্য ছিল একটি সরকারি চাকরি। নিজের প্রতি নিজের প্রচন্ড আস্থা ছিল,ছিল প্রখর বিশ্বাস।
আমাদের সমাজে অনেকেই রয়েছেন যারা শুধুমাত্র নিজের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এবং সেই যুদ্ধে জয়ী হয়ে সবাইকে দেখিয়ে দেন, কোনোরূপ দুর্বলতার স্থান তাদের ভেতরে নেই। জীবন বাজি ধরতে ধরতে জয়ী শব্দটার সাথেই বারবার পরিচয় ঘটে। ব্যর্থতা বলতে কোন শব্দের সাথে তাদের সম্পর্ক নেই।
তবুও কেন যেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন, ঠিক এমনটাই হচ্ছে তার সাথে।
ঠিক এ সময়ে মেয়েটির পরিবার মেয়েটির জন্য বিয়ে ঠিক করে ফেলে। সেদিন মেয়েটি ছেলেটিকে বলেছিল-
তোমার ভাগ্য ভালো যে আমার মত
একটা মেয়ে এতদিন তোমার পাশে
ছিল। আমি পাশে না থাকলে অনেক
আগেই হারিয়ে যেতে।আমি পাশে
থাকতেই যখন কিছুই করতে পারনি,
তাহলে তুমি জীবনেও কিছু করতে
পারবে না। শোন- বাবা আমার বিয়ে
ঠিক করে ফেলেছে-ছেলে একজন
পরিসংখ্যানবিদ , অর্থাৎ সরকারি
চাকরি করে। আমি তাকেই বিয়ে
করছি, তুমি ভালো থেকো!
ছেলেটি সেদিন নির্বোধের মত তাকিয়ে ছিল। বিশ্বাসই হচ্ছে না যে জেবা এই কথা গুলো বলছে। মনে হচ্ছে কেউ তার বুকে কতগুলো ছুরিকাঘাত করে গেল। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে,জেবা চলে যাচ্ছে। আজকের চলে যাওয়ায় কোন উৎসাহের বানী ছিল না।ছিল নির্মম বেদনা দায়ক যন্ত্রণা।
ছেলেটি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে প্রচুর কান্না করিতেছিল সেদিন।একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছে মেয়েটিকে কিন্তু সেদিন জেবা ভুল করে ও তার ফোন রিসিভ করে নি।
অপর দিকে মেয়েটির বিয়ে এক দিকে নিজে বেকার যুবক।এ দুই কষ্ট তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
চারদিকে আপন মানুষ বলতে এখন আর কেউ নেই। ঘুম হীন রাত্রিগুলোই তার সঙ্গী হতে থাকে। সিগারেট খাওয়া শুরু থেকে আস্তে আস্তে নেশায় প্রবেশ ঘটে।সুখ শান্তি সব বিসর্জন দিয়ে ও ৩৭ তম বিসিএসএ বসতে পারেনি ছেলেটি।
এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ করে থেমে যায়। কেন যেন সেদিন রাতে নেশা না করেই সমস্ত রাত জেগে ছিল আর ভাবতে ছিল- জীবনের অর্থ কি?সুখ কী?
কেন সে নিজেকে অজানা গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। কোন পথে নিজেকে হাটিয়েছেন, যে পথে এতদিন হেঁটেছেন সে পথ আসলেই কি তার জন্য কল্যাণকর। এমনটা ভাবতে ভাবতে ছেলেটি ঘুমিয়ে পড়ে সে রাত্রে।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ভাবনার জগতে লম্বা এক ডুব দেয়, নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধে আবদ্ধ হয়। শুরু করে নতুন জীবনের পথচলা।
~সে ভাবতেছিল, যে মানুষটির জন্য জীবনের এতটা সময় ব্যয় করেছে। সেই মানুষটি কি সঠিক মানুষ ছিল, নাকি ভুল মানুষের সাথে ভুল এক সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল।
সে তখন বুঝতে পেরেছিল কোনো কোন সম্পর্কের ইতি, নতুন জীবনের উত্থান ঘটিয়ে থাকে।
যে যাবার সে এমনিতেই চলে যাবে কারণ অকারণে হারিয়ে যাবে। নক্ষত্ররাও হারিয়ে যায়, তবে কি আকাশ নক্ষত্র বিহীন থাকে ?
নতুন জীবনের পথ চলায় নিজেকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে চলতে থাকে। নিজের প্রতি তীব্র বিশ্বাসই পারে দিনশেষে সফলতা এনে দিতে। নিজের প্রতি তীব্র বিশ্বাস রেখে অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই তার উত্থান ঘটে। 38 তম বিসিএস এর প্রিলি, রিটেন এবং ভাইভাতে উত্তীর্ণ হয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যে জীবনের এ পরিবর্তন হয়তো খুব সহজে আসেনি। জীবনের সফলতার শীর্ষে পৌঁছে গিয়ে ও চারপাশে আস্থাভাজন কাউকে পাশে পায়নি।
ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হওয়ার পরে প্রথম ফোনকলটি "জেবাকেই" করেছিল। দীর্ঘ ৫ বছর পরে তাহার ফোন পেয়ে খুব অনায়াসেই জেবা রিসিভ করে ফেলেছিল। ছেলেটি খুব গর্ব করেই বলেছিল আজ আমার চাকরিটা হয়ে গেছে। আমি আজ বিসিএস ক্যাডার সুপারিশপ্রাপ্ত। এটুকু বলেই মোবাইলফোনটি রেখে দেয়।
বিসিএস সুপারিশপ্রাপ্ত এ যুবক নতুন চিন্তায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। ভাবতে থাকে যার জন্য চাকরিটা করবো ভেবেছিলাম, সেই মানুষটিই আজ পাশে নেই।
পৃথিবীর সকল দুঃখ-যন্ত্রণার গ্লানি মুছে যাক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
আমি আমার কমিটমেন্ট ঠিক রেখেছি, কিন্তু সে তার কমিটমেন্ট ঠিক রাখে নি। আমি বলেছিলাম চাকরি পাব ঠিকই আমি চাকরিটা পেয়ে গেছি আজ। কোন দ্বিতীয়,তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর নয়, সরকারি প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে। আমি আমার কমিটমেন্ট রক্ষা করেছি।
কিন্তু সে বলেছিল আমার হবে,অথচ সে আজ অন্য কারো হয়ে গেছে। সে বলেছিল যতটা সময়ের প্রয়োজন সে অপেক্ষায় থাকবে কিন্তু যখন হতাশা আমার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক সেসময় সেও পালিয়ে গিয়েছিল অন্যের হাত ধরে নতুন জীবনের সন্ধানে।
জীবনের সুখ-শান্তি সফলতা আর ব্যর্থতার মন্ত্র কখনো একই সূত্রে গাঁথা থাকে না। অর্জনের মধ্য দিয়ে সফলতা আর অন্তরের শান্তি হতে আসে সুখ। অতিরিক্ত চাহিদা হতে আসে ব্যর্থতা, অশান্তি ও হতাশা।
ছেলেটির চাহিদা ছিল প্রথম চাকরির বেতন দিয়ে প্রিয় মানুষটাকে মেঘের দেশে নিয়ে হারিয়ে যাবে। চাকরিটা পেয়ে গেলো অথচ সেই প্রিয় মানুষটি আর পাশে নেই, নেই প্রিয় মানুষটির সাথে শত সুতোয় গাঁথা স্বপ্ন।
১১২ পৃষ্ঠার 'ডাইরি বইয়ে' এমনটাই লেখা ছিল।