অপারেশন সার্চলাইট

1 34
Avatar for Jewel
Written by
4 years ago

অপারেশন সার্চলাইট

Operation Searchlight

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরন্ত্র বাঙালির উপর ইতিহাসের নির্মম গণহত্যা পরিচালনা করে। এই গণহত্যার সাংকেতিক নাম দেয়া হয় অপারেশন সার্চ লাইট। মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টো আলােচনার আড়ালে বাঙালিদের স্বাধিকারের ইচ্ছা ধুলোয় মিশিয়ে দেবার জন্য প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক নিয়ােগ করেছিলেন। লে. জে. টিক্কাখান ছিলেন নিষ্ঠুরতার প্রতীক । তিনি একযোগে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের গণজাগরণকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এটি ২৫ মার্চের কালােরাত্রি নামে পরিচিত। এটি ছিল নিরস্ত্র বাঙালি জনগােষ্ঠীর উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত অত্যন্ত ঘৃণিত, জঘন্য ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড, একটি পরিকল্পিত গণহত্যা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে এ অপারেশন বা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও এর প্রস্তুতি চলতে থাকে মার্চ মাসের প্রথম থেকে। অপারেশনের প্রস্তুতি স্বরূপ মার্চের আগেই রংপুর সীমান্ত থেকে ট্যাংকগুলােকে ঢাকায় আনা হয়। ১ মার্চ হতে সেনাপরিবারের সদস্যদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানাে শুরু হয়। বেসামরিক পােষাকে সামরিক বাহিনীর লোকজন তখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আসতে শুরু করে। ৩ মার্চ থেকে যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জাম নিয়ে জাহাজ এম.ভি সােয়াত চট্টগ্রাম বন্দরে অপেক্ষা করতে থাকে। ৭ মার্চ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে পাঠানো হয়।

১৭ মার্চ জেনারেল টিক্কা খান, লে. জেনারেল খাদিম হােসেন ও রাও ফরমান আলী অপারেশন সার্চলাইট চূড়ান্ত করেন। ১৯ মার্চ থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরন্ত্রীকরণ শুরু করে। একই দিন জয়দেবপুরে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। ২০ মার্চ সরকার জনগণকে অস্ত্র জমাদানের নির্দেশ দেয়। ২৪ মার্চ এম. ভি. সােয়াত থেকে অস্ত্র ও রসদ খালাস শুরু হয়। এসব ছিল অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার প্রস্তুতি। অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার দুটো হেড কোয়াটার ছিল।

ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় এ অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব ছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও ৩৭ ব্রিগেডসহ ব্রিগেডিয়ার আরবাবের উপর। ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চল ছাড়া প্রদেশের বাকি অংশের দায়িত্ব ছিল মেজর জেনারেল খাদিম হােসেনের উপর। লে. জে. টিক্কা খান তার অফিসারদের নিয়ে সেকেন্ড ক্যাপিটালের (শেরে বাংলা নগর) সামরিক হেড কোয়ার্টার থেকে রাত জেগে অপারেশনের খোঁজ নিয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান। তার পশ্চিম পাকিস্তানে পৌছার সময়কে অপারেশন সার্চ লাইটের সময় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। জেনারেল স্টাফ হেডকোয়ার্টার এর জন্য একটি নির্ধারিত সময় ও কোড (পাস ওয়ার্ড) নির্ধারণ করে যাতে সমগ্র সেনা গ্যারিসন থেকে একযােগে তা বাস্তবায়ন করা যায়। সে দুর্ভাগ্যের সময়টি নির্ধারণ করা হয় ২,৬০,১০০ ঘণ্টা বা ২৬ মার্চ রাত ১টা (২৫ মার্চ দিবাগত রাত)। এ সময়টি নির্ধারণ করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিরাপদে করাচি পৌছার সাথে সামঞ্জস্য রেখে। জেনারেল খাদিম ভাবলেশহীন ছিলেন। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা আরােহণের ২য় বার্ষিকীতে প্রেসিডেন্টের আদেশ বাস্তবায়েনের অপেক্ষায় ছিলেন। ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ সেনা সদস্যদের টহল নির্ধারণ করা হয়। ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলী ও আবরারের নেতৃত্বে অপারেশন পরিচালনার জন্য নিম্নোক্ত পরিকল্পনাগুলাে গ্রহণ করা হয় :

* প্রয়ােজনে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টকে রক্ষা করার জন্য ১৩ ফ্রন্টিয়ার বাহিনীকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রস্তুত রাখা হয়।

* ৪৩ লাইট এন্টি এয়ারক্র্যাফট রেজিমেন্টকে ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায় নিয়ােজিত করা হয়।

* ২২ বালুচ রেজিমেন্ট পিলখানায় ই.পি.আর হেড কোয়ার্টারের দায়িত্বে পালন করবে তারা ৫,০০০ ইপিআর বাঙালি সদস্যকে নিরস্ত্র করবে এবং ই.পি.আরের ওয়ারলেস দখল করবে।

* ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট হিন্দু অধ্যুষিত নবাবপুর এলাকার দায়িত্বে নিয়ােজিত থাকবে। সরকারি বাহিনী মনে করতাে এখানকার প্রত্যেকটি বাড়িই এক একটি দুর্গ

* ফিল্ড রেজিমেন্ট সেকেন্ড ক্যাপিটাল ও মিরপুর মােহাম্মদপুরের বিহারদের রক্ষায় নিয়ােজিত থাকবে। ১৯৭০ এর নির্বাচন, অসহযােগ আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও জগন্নাখ হল এ দুটিকে মনে করা হতো আওয়ামী বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে। এ দুটি হল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৮ পাঞ্জাব, ২২ বালুচ ও ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বাছাই করা সৈনিকদের সমন্বয়ে একটি বাহিনী তৈরি করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর ভবন থেকে বঙ্গবন্ধুকে জীবিত ধরার জন্য একটি বিশেষ কমান্ডাে বাহিনী নিয়ােগ করা হয় যার সৈন্য সংখ্যা ছিল এক প্লাটুন। এম-২৪ ট্যাঙ্ক সমন্বয়ে এস্কেলেটন স্কোয়াড্রন নিয়ােজিত ছিল। এদেরকে সামরিক শক্তির শােভাবর্ধক হিসেবে নিয়ােজিত করা হলেও প্রয়ােজনে তারা গােলা ছুঁড়তে পারবে। উপর্যুক্ত সৈন্যরা রাস্তায় প্রতিরােধের সম্মুখীন হলে তা ধ্বংস করে দেবে এবং তা তালিকাভুক্ত রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িতে হানা দিবে মূল পরিকল্পনা ছিল রাত ১.০০টা অপারেশন পরিচালিত হবে। কিন্তু পথে বিলম্ব হবে ভেবে সৈন্যরা রাত ১১.৩০টায় মার্চ শুরু করে। তারা সর্বপ্রথম ফার্মগেট এলাকায় প্রতিরােধের মুখে পড়ে। এ সময় এ এলাকায় কিছু মুক্তিকামী মানুষ মিছিল করছিল।

সৈন্যদের আগমনের খবর পেয়ে তা রাস্তার গাছ কেটে জনগণ ব্যারিকেড দেয়। পুরাতন গাড়ি এবং নষ্ট স্টিমরােলারও এ কাজে ব্যবহৃত হয়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জয় বাংলা শ্লোগান দিতে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে।

প্রতিরােধকারীদের অনেকে শাহাদাৎ বরণ করেন। বাকিরা সরে গেলে পাকিস্তানি আর্মি প্রবেশ করে। পাকিস্তানি কমান্ডাে বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করে তাকে রাত ১.১০ মিনিটে গ্রেফতার করে এবং প্রাথমিকভাবে ক্যান্টনমেন্টের আদমজী স্কুলে তাকে নিয়ে অবস্থান করে। গ্রেফতারের পূর্বে তিনি ওয়্যারলেস যােগে স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়ে যান।

অপারেশন সার্চ লাইটের নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মহা ধ্বংসযজ্ঞ চালায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। এর প্রধান কারণ হলাে এসব জায়গা থেকেই প্রতিরােধ বেশি আসার সম্ভাবনা ছিল। ফার্মগেটের ঘটনার পরপরই ঘাতক বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টারে হামলা করে। এখানে তারা প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও ইপিআর ব্যাপক প্রতিরােধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয় এবং হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলােতে আক্রমণ শুরু হয় গভীর রাতে। প্রথমে তৎকালিন ইকবাল হলে আক্রমণ চালানাে হয়। ছাত্ররা তাদের সাধারণ অস্ত্র নিয়ে প্রতিরােধ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। সেদিন পাক সেনারা ইকবাল হলে রকেট দিয়ে হামলা চালায়। পাক সেনারা ছাত্রদের কক্ষে ঢুকে অনেককে গুলি করে হত্যা করে। জগন্নাথ হলেও অনুরূপ নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালানাে হয়। রােকেয়া হলে অনেক ছাত্রী নির্যাতনের শিকার হয়। একই পরিকল্পনার আওতায় পুরনাে ঢাকার তাঁতি বাজার। শাখারি পট্টি, তেজগাঁও, ইন্দিরা রােড, মিরপুর, মােহাম্মদপুর, ঢাকা বিমানবন্দর, গণকটুলি, ধানমণ্ডি, কলাবাগান, কাঁঠাল বাগান প্রভৃতি স্থানে আক্রমণ চালিয়ে অসংখ্য নিরীহ জনতাকে হত্যা করা হয়। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. গােবিন্দ চন্দ দেব, ড. ফজলুর রহমান, ড. জৌতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ড. মনিরুজ্জামান, আনুদ্বৈপরন ভট্টাচার্য, মুহাম্মদ আব্দুল মুকাদ্দির, শরাফত আলী, মােঃ সাদেক, সাদত আলী ও আনিসুর রহমান মােট ১০ জন শিক্ষক ও প্রায় ৩০০ জন ছাত্র-কর্মচারী এবং ঢাকা শহরে ৮ (আট) হাজারের মতাে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। আতঙ্ক ছড়ানাের জন্য ঢাকা শহরে ব্যাপক হারে আগুন ধরিয়ে দেয়।

২৫ মার্চ কালােরাতে তৎকালিন ইংরেজি দৈনিক দি পিপলস, বাংলা পত্রিকা ইত্তেফাক, সংবাদ ইত্যাদির অফিসে আগুন দেয়া হয়। এতে বহু পত্রিকাকর্মী আগুনে পুড়ে নিহত হয়। এ বর্বরােচিত গণহত্যার খবর যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্য দেশি বিদেশি সাংবাদিকদের বন্দী করে রাখা হয়। শুধু ততকালিন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে (বর্তমানে রূপসী বাংলা) প্রায় ২৫ জন বিদেশি সংবাদিককে বন্দী রাখা হয়েছিল।

পরদিন বিদেশি সাংবাদিকদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। এরপরও দু চারজন সাংবাদিক পালিয়ে গিয়ে গণহত্যার খবর প্রচার করে। ১৯৭০ এর নির্বাচন, অসহযােগ আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা কুষ্টিয়া ও পাবনায় পাকিস্তানি বাহিনী প্রবল প্রতিরােধের মুখে পড়ে এবং বড় ধরনের ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মেজর শােয়াইবের নেতৃত্বে ১৫০ জন পাকিস্তানি সেনার মধ্যে ৬৫ জন নিহত হলে তারা কুষ্টিয়া ত্যাগ করেন।

জয়দেবপুর ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দেয়। এভাবে দেখা যায় বিশ্বের ইতিহাসে ঘুমন্ত বাঙালির উপর চালানাে এই অপারেশন সার্চলাইট ছিল একটি নিষ্ঠুর ও পাশবিক হত্যাকাণ্ড। এক নাগাড়ে ৩৬ ঘণ্টা এ পাশবিক হত্যাকাণ্ড চালানাে হয়। পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যার কথা অস্বীকার করে এবং এ কল্পকাহিনী প্রচারের জন্য মিডিয়াকে দায়ী করে। তবে বিশ্ব মিডিয়া পাকিস্তানি বাহিনীর এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ভয়ঙ্কর চিত্র উপস্থাপন করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে সহায়তা করে। বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে আসে। এর হাত ধরেই বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশে সক্ষম হয়।

ছবিগুলো সংগৃহীত

2
$ 0.00
Sponsors of Jewel
empty
empty
empty
Avatar for Jewel
Written by
4 years ago

Comments

২৫শে মার্চ কে ভয়াল রাত হিসেবেও বলা হয়ে থাকে

$ 0.00
4 years ago