কলকাতা রেলস্টেশনে প্ল্যাটফর্মের ছোট একটা চায়ের দোকানের বেঞ্জে বসে গল্প করছি আমি আর অভি। সামনের নড়বড়ে পায়ার চৌকিতে বসে পা দুলাচ্ছেন মহেন্দ্র বাবু। একপাশে তার সহকারী নারায়ণ চ্যাটার্জি লাগেজগুলো ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। এপাশের একটা লাগেজকে বসার সীট বানিয়ে ওর উপর বসেছেন সুকান্ত দাদা। পাঁচজনের এই ছোট কাফেলার প্রতি নিক্ষেপিত নজরেই লোকজন বুঝে নিবেন মহেন্দ্র শিং সবার মাঝে বিত্তবান। কিপ্টেমিও আছে কিছু, তাই তার সম্পদের পরিমাণ আন্দাজ করা মুশকিল। এই যে ধরুন এই যাত্রার কথা। বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা করে নিজ দেশে তো উনি ভি আই পি কেবিনে আরামসে আসতে পারতেন। কিন্তু আসেন নি। আমাদের মত মধ্যবিত্ত লোকের সাথে সেকেন্ডকাস বগিতেই সীট নিলেন। তার কারণ, বেশি খরচা যাবে বলে।
"বাংলাদেশে মশলার ব্যবসা ভালই লাভজনক। অনেক আয় আসে, ভারতে অতটা পাই নি গতবছর।" বললেন মহেন্দ্র মশাই।
"ঠিক বলেছেন, ফলের ব্যবসাও ভাল চলে। চাঁদপুরের ইলিশ তো দেখেন নি, গার্মেন্টসের চেয়েও বেশী দর কদর ওটার।" উত্তর দিলেন সুকান্তদা।
সামনের বার এলে ওসব মনে রাখব, এবার গার্মেন্টস রপ্তানিতে কিছু কামিয়ে নেই আর কি।
এর আগে দিল্লীতেও ভাল রূপি কামিয়েছিলেন বোধহয়? ব্যবসায়িক ভঙ্গিতে তাকান সহকারী নারায়ণ।
আচ্ছা উনি যে টাকা করেন নি এমন কোনো ব্যবসা আছে দাদা? বিরক্ত হয়ে বলল অভি। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। তার উপর ধনকুবেরের অমন ব্যবসায়িক খোশগল্প। সারাটা সময়ই এই তিনজন কোথায় কি করে কামিয়েছে তার বর্ণনায় বাক্যব্যয় করছে।
"প্রথম জীবনে সালেহ আহমদের সাথে নোয়াখালী ছিলাম। ওর জুতোর ব্যবসা দেখভাল করতাম। ভালই লাভ আসছিল বলে বাড়তি কমিশন দাবী করলে অস্বীকৃতি জানাল আহমদ। দেশের বাড়িতে মন টিকত না তেমন। পরে পাল বাড়ির এক মশাইয়ের সাথে কলকাতায় আসি। উনার বড় ফার্মটার দেখভাল করে ভালই কামাই। বুঝলাম খামারী ব্যসা কঠিন না। নোয়াখালীতে ফিরে গিয়ে ফার্ম খুলে নিজেই রোজগার করেছি কিছু। তখন আমার জন্য রায় বংশীয় ভাল কনে খুঁজে পাচ্ছিলেন না আব্বা। পরে বিয়ে হলো খাগড়াছড়ির রায় বাড়িতে। শশুরের ঘরজামাই হয়ে থাকলাম উনার আনারস-কলা খেতের দেখাশোনায়। চুক্তি ছিল অর্ধেক আমার, দ্বিগুণ ফলেছে ফল। পরে একবার দুর্গাপূজায় ভারতের বর্ডার খুলল সাত দিনের জন্য। মওকা পেয়ে চলে আসি, এদিকে মন্ডপের খাবার আর ফুলের চরম ব্যবসা ছিল। পরে গুজরাটে গিয়ে রমাকান্ত দাদার সাথে উনার ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। সব ব্যবসায়ই নিজের যোগ্যতা দিয়ে কামিয়েছি। পরে রমজান ভাই ঢাকায় রেস্টুরেন্ট দিল। ওখান থেকে কিছু যোগাড় করলাম। আর এখন নিজেই অমন কয়েকটা রেস্তোরাঁ আর ফার্ম খুলে বসেছি।" থামলেন মহেন্দ্রবাবু। উনার প্রতি আঙুল তোলার অপরাধে একশো এক গর্বের কাহিনী শুনিয়ে দিলেন সবাইকে। বুঝলাম, ধনী হতে শ্রমের পাশাপাশি শুধু জালিয়াতিই না কিপ্টেমিও দরকার।
আমি আর কিছু বলিনি, এমনিতেই যা শুনেছি যথেষ্ট।
খানিকবাদে দৌড়ে এলেন বিকাশবাবু। দেরী হবার নানা কারণ দশালেন। ওদিকে মহেন্দ্র মশাইয়ের সাথে সুকান্তদাও তাল মিলিয়ে একগাদা বকাঝকা করে উঠেলেন।
বিকাশবাবু একজন কর্মচারী। মহেন্দ্রবাবুর এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয় স্টেশন মাস্টার, উনার কর্মচারী। আমাদের নিতে এসেছেন সরকারী বাসভবনের পথ চিনিয়ে নিতে। ওখানে আপাতত দুই রাত থাকছি আমরা। এরপর হোটেলে উঠার ব্যবস্থা হবে। এখানে চেনা জানা লোক বলতে মহেন্দ্রবাবু। আমাদের নোয়াখালীর প্রতিবেশী, সুকান্তদা উনার শশুরবাড়ির লোক। দু'জনেই ব্যবসার কাজে এসেছেন; প্রায়ই আসেন। ছোটভাই (মূলত সৎভাই কিংবা শালা) অভি আর আমি এসেছি অন্যকাজে।
আবাসিক এলাকাটায় চলে আসলাম পাঁচ মিনিটের মাথায়। রেলকর্মীদের জন্যই কলোনীটা। রঙচটা লালচে বিল্ডিংয়ের গায়ে অযত্নেই বেড়ে উঠেছে কিছু বটচারা। ফাটলধরা দালানগুলো যেন বৈশাখী ঝড়েই হেলে পড়বে রাস্তায়। পিচ উপড়ে গেছে এখানে ওখানে, বৃষ্টির পানি জমেছে তাতে।
মহেন্দ্রবাবুর আত্নীয় অমিত সিং। ভাল আপ্যায়ন করলেন আমাদের, শুনেছি পশ্চিমবঙ্গ নাকি অতিথিপরায়ণ নয়। তবে আর যে যাই বলুক, এই বাড়িতে এটা ভুল বলে প্রমাণিত।
রাতের খাবারের পর শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছি, আমি সত্যিই পারবো তো আমার বোনকে খুঁজতে? ধর্মে হিন্দুই রয়ে গেছে হয়ত মেয়েটা। এতবছর পর চিনতে পারবে ভাইকে?
"আচ্ছা ও দেখতে কেমন হবে চিন্তা করছো?" পাশে উপুড় হয়ে ফোনে গেমস খেলছে অভি। আমাকে নিশ্চুপ দেখে একবার প্রশ্ন করলো।
"ওর কথা যে ভাবছি তা কিভাবে জানলি তুই?"
"আমাকে নিজের ভাই বলে না ভাবলে একথা বলতেই পারো।" বিষন্ন দেখালো অভিকে।
"কে বলেছে আমি এমন ভাবি! তুই তো আমারই ভাই। একসাথে আমরা খেলে বড় হয়েছি।" আমি কাছে ঘেঁষে গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। নেত্রকোণে জমা অশ্রুটুকু ওকে দেখাতে পারবো না।
"আহা! মাইন্ডে নিচ্ছো কেন? অভিমান হতেই পারে। তাই বলে কাঁদবে ভাইয়া? ছেলেরা কাঁদলে কেমন দেখায় জানো?"
চোখ মুছে ওর দিকে তাকালাম। ফোনে এলার্ম দিয়ে পাশে রেখে শুয়ে পড়ল চাদরটা বুকে টেনে। আমাকেও ঘুমাতে বলে ওপাশ ফিরল।
বাইরের সোডিয়াম লাইটটা নষ্ট। গাছের উপরে কেউ কায়দা করে একটা চার্জার লাইট লাগিয়ে দিয়েছে। ওটার আলো বারান্দা দিয়ে প্রবেশ করেছে ঘরে।
লাইটের আলোতে এক শাড়ি পরিহিতা নারীমূর্তি দেখলেন সুকান্ত রায়। বয়স ত্রিশের কোঠায়, রাতে কোনো মেয়েকে দেখলে কৌতুহল জাগতেই উঠে দেখতে গেলেন। মেয়েটা যেন কাঁদছে।
"অ্যাই দাঁড়াও। কে তুমি? কি হয়েছে?" নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন সুকান্ত।
"আমার হাজার টাকার বান্ডিলটা পড়ে গেছে। একটু তুলে দিন না মশাই।" অনুনয় করলো মিষ্টি গলায়।
"কোথায় পড়েছে?" একলা মেয়েটার মুখে টাকার কথা শুনতেই মাথায় ফন্দি খেলে গেল। এগিয়ে গেলেন।
"ওইতো পাইপের মুখে। দিন না তুলে।" ইঙ্গিত করলো মেয়েটা দেয়াল ঘেঁষা মোটা পাইপের দিকে।
সুকান্ত পাইপটা দেখলো ভাল করে। নিচে আধা শুকনো ড্রেন। অক্ষত আছে হয়ত বান্ডিলটা। লম্বা বারান্দার এক মাথায় সিঁড়ি, বিল্ডিংটা যে কোন মাথামোটা এভাবেই বানিয়েছে কে জানে! সিঁড়ি ভেঙে নিচে গিয়ে নিচে নামলো সে। ড্রেনের দিকে তাকালো। সত্যিই মেয়েরা বোকা হয়; ড্রেনেই পড়েছে বান্ডিলটা, মাথায় খাটে নি ওর না হয় খাটাবার চেষ্টা করেনি। উবু হয়ে তুলে নিল বান্ডিলটা।
"ধন্যবাদ মশাই, এ উপকার আমি মনে রাখব। ভগবানের কৃপার নজর পড়ুক আপনার উপর। দিন ওটা আমায়।" পেছনেই নিঃশব্দে মেয়েটা এসে দাঁড়িয়েছে।
"আহা বেচারী, আমি এটা না তুলে দিলে কোথায় পেতে; শুনি গো?" তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বান্ডিলটা নিয়ে কোটের পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল সুকান্ত।
"সেকি, এটা তো আমার। দিন আমাকে।"
"মেয়ে মানুষ, বেশি বললে এই রাতে কপাল পুড়বে বুঝেছ? এবার যাও।" শাসালো সুকান্ত।
"কি করবেন শুনি? আমার টাকা দিয়ে দিন এখুনি। মেয়েটা ওর চুলগুলো কানের ধারে গুঁজে দিতে দিতে বলল। সুকান্তের নজর পৌঁছালো ওর হাতের সোনালী ধাতবের উপর। সাথে সাথেই দেখলো মেয়েটার কানেও বড় বড় স্বর্ণের দুল, গলায় ভারী নেকলেস। আলোতে চমকাচ্ছে ওগুলো।
হাত বাড়ালো সুকান্ত। গহনাগুলো ওর চাই। কিন্তু মেয়েটা সুযোগ দিল না। চকিতেই বুঝে নিল সব, ঘুরেও দৌড়ালো। পিছু ধাওয়া করলো সুকান্ত, মেয়েদের পায়ের জোর যতটা কম আন্দাজ করা হয় ঠিক ততটাও না। দৌড়ে যে নওজোয়ান পুরুষকে হারিয়ে দিতে পারে সে সাধারণ, এমনটা মানা যায় না। হাঁফ ধরে যায় সুকান্তের। তবুও পা চালায় উদ্যমে।
মেয়েটা রেললাইনের কাছে চলে এসেছে, পায়ের গতি কমালো কিছুটা। জোর বাড়ালো সুকান্ত, রেললাইনের উপরে উঠে এসেছে দু'জন। দীর্ঘ লাইন ধরে দৌড়াচ্ছে ওরা। মাঝে মাঝে তক্তা আর পাথুরে স্থানে দৌড়ের গতি কমিয়ে দিচ্ছে, মাঝে এখন মাত্র চার ফুটের তফাৎ। হঠাৎ অন্ধকারে কিছু একটায় পা পেঁচিয়ে পড়ে গেল সুকান্ত। অপমানবোধ হলো ওর। তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়েই খেয়াল হলো পায়ে লোহার শিকের মত কিছু আটকে গেছে। সোজা হয়ে ওটা খোলার চেষ্টা করল, খেয়াল করলো না পেছনে সজোরে শক্ত কোনো দন্ড ওর মাথা বরাবর ধেয়ে এলো। লক্ষ্যচ্যুত হলো না আঘাতটা। সুকান্তের অজ্ঞান দেহটা রেললাইনেই পড়ে থাকলো।
"ভাইয়া, তুমি আর আমাকে গল্পটা শোনাও নি।" শুয়েই বলল অভি। আমার মত তারও চোখে ঘুম নেই।
"কোন গল্প?" জানি ও আমার বোনের গল্পটা শুনতে চাইবে, তবুও না বোঝার ভানে জিজ্ঞেস করলাম।
"সুপ্তি আপুর গল্পটা। ওইযে বলেছো, ও একাত্তরের যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর কারো সাথে ভারতে চলে যায়।"
"সকালে উঠতে হবে জানা আছে তো না? গল্পসল্প মাথা থেকে ঝেড়ে ঘুমা' এখন।"
"ভাইয়া প্লিজ...।"
"আচ্ছা শোন" বলতে শুরু করলাম, একবার কোনো বাতিক ওর মাথায় চাপলে সেটা পুরা না হলে ছাড়ে না। এই সুপ্তির ভূতও ঘাড় থেকে যাবে না। জ্বালিয়ে মারবে পরে, বলে মুক্ত হওয়াই ভাল। "আমি তখন সাত বছরের ছেলে। নাম ছিল সত্যজিৎ, সুপ্তি তখন পাঁচ কি ছয় বছরের। যুদ্ধে বাবা মারা যাবার পর দিশেহারা হয়ে গেছি, মা তো আগেই গত হয়েছিলেন; পাকিস্তানিরা ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিল, ভিটেমাটি ছাড়া আমরা। এই সময় যে কারো আশ্রয় পাবো সেটারও সুযোগ নেই। ওই বছর খুব বন্যা হয়েছিল। তালগাছ দিয়ে ডোঙা নৌকা বানিয়ে তার উপর চড়ে আমরা নোয়াখালী থেকে কুমিল্লায় রওনা দেই। ওখানে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি আছে, হিন্দু হওয়ার সুবাদে ভারতেও আসতে পারি আশ্রয়ের জন্য। পথে দেখা হলো এক তরুন মুক্তিযোদ্ধার সাথে। আমাদের মায়া করলো অনেক, মুক্তিবাহিনীর একটা ফোর্সের সাথে আমাদের নিয়ে এলেন। উত্তরবঙ্গে ওদের এক ক্যাম্পে, উনার সাথে এক মাসের মত ছিলাম। যুদ্ধঝামেলা করেও আমাদের কষ্ট করে আগলে রাখেন, ঐ ঋণ আমিও জীবনেও শোধ করতে পারব না। একবার হানাদাররা ক্যাম্পে বোমা হামলা করে, তখন আমি আর সুপ্তি বাদে বাকিরা সবাই যুদ্ধে ছিল। ছোট পুরানো ভাঙা জমিদারবাড়িটাই ছিল ক্যাম্প। আমরা দু'জনেই ছোট। কি করবো বুঝতে না পেরে দৌড়ে ডাঙার ঝোপঝাড়ে লুকোতে গেলাম। ভারত সীমান্তে তখন মিত্রবাহিনীর লোকেরা ছিল। জানতাম না সীমান্তে এসে গেছি। ঝোপে লুকিয়ে আছি হঠাৎ বন্দুকের নলের খোঁচা খেয়ে ফিরে চাইলাম, দেখি এক ভারতীয়। কলকাতার টানে জিজ্ঞেস করলেন, " এখানে কি?" ভয়ার্ত গলায় নিজেদের কথা জানালাম। আমাদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিল। সুপ্তিকে সাথে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দিল। বিশ্বাস করবি না তুই, ঐ সময়টাতে বাঙালীরা কতটা সহমর্মিতা দেখিয়েছে একে অন্যের প্রতি। নতুবা পাকিস্তানের সাথে লড়ে জিতে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! যা হোক, আমি আর সুপ্তি কলকাতায় আসলাম। কিন্তু মনে হলো, যদি ঐ মুক্তিসেনা আবার আমাকে না দেখে তো খুঁজতে নামবে। বিপদে পড়েছি ভেবে পেরেশান হবে; আমাদের জন্য এত করল আর আমরা স্বার্থপরের মত চলে এলাম! ভাবতে ভাল লাগলো না। সুপ্তিকে এক ভদ্রলোকেত বাড়িতে রেখে বাংলাদেশে ফিরে এলাম। কয়েক কিলোর পথ, হেঁটেই এলাম। ছোট ছিলাম, কিন্তু কাজেকর্মে অনেক বড় থাকার চেষ্টা করেছি।" দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বলতে দেরী দেখে অভি বলল,
"পরে আর সুপ্তিদির কাছে ফিরতে পারো নি না?"
"না। এসেই পাকিস্তানিদের হাতে পড়লাম। পাকবাহিনী মনে হয় বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে মাথাঘামায় নি ততটা। না হলে এইদিন আর দেখতে হতো, মরে ভূত হয়ে থাকতাম আজ।"
"তারপর?"
"এরপর আরেক মুক্তিফৌজের আক্রমণে ওদের ক্যাম্প লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। আমাকে উদ্ধার করলো এক কমান্ডার।"
"মানুষটা আমাদের বাবা ছিল, তাইনা?" চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল অভির।
"হ্যাঁ, এরপর ছেলের মতো বড় করলেন, নিজের মেয়ের সাথে বিয়ে দিলেন। আহ! কতদিন হয়ে গেল।" চোখ মুছলাম। "সুপ্তি রয়েই গেল স্মৃতির গহীনে। খুব কষ্ট হয়েছিল ওর বিরহে, একমাত্র আপনজন ছিল ও, তবে মনে তখন আরেক আনন্দ। বিজয়ের আনন্দ, আমি স্বাধীন দেশের মানুষ, সব কিছু ভাবতেই বুকটা হু হু করে উঠে।"
"সুপ্তিদিকে খুঁজে পেলে চিনবে কি করে?"
"ওর হাতের তালুতে তর্জনী বরাবর একটা জায়গায় গভীর ক্ষত আছে, মধ্যমার নখের আগায় বড় একটা তিল।..." তাকিয়ে দেখি অভি কাঁথা গলা অবধি টেনে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আস্তে আস্তে চোখ খুললো সুকান্ত। রাতের অন্ধকার সয়ে এল চোখে, নড়তে পারছে না। আষ্টেপৃষ্ঠে রেল লাইনের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। দূর থেকে ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। ভোরের ট্রেন, প্রাণপণে মুক্ত হতে চাইল বাঁধন হতে; ওটাকে মৃত্যুর দানব বলে মনে হচ্ছে সুকান্তের। কাছিয়ে এল ট্রেনটা। কিছু করার নেই, শেষ চেষ্টা করল বাঁচার, লাভ হলো না। ওর মৃত্যু চিৎকার ট্রেনের বিকট আওয়াজ ছাপিয়ে পৌঁছলো না কারো কানে। তিন টুকরো হয়ে গেল সুকান্তের সুঠাম দেহ।
"সুকান্তদা কোথায়?" খাবার টেবিলস বসে জিজ্ঞেস করলো অভি।
"প্রাতঃভ্রমণে বেরোলো নাকি আবার কে জানে।" উদাস ভঙ্গিতে বললেন মহেন্দ্র বাবু।
"নতুন জায়গা, হাঁটতে বেরিয়েছে হয়ত।" বললেন মেজবান।
"শুনলাম আপনার জামাই গতমাসে শ্মশান বাড়ি পাড়ি জমিয়েছেন?" লুচি মুখে পুরলেন মহেন্দ্রবাবু।
"হুম" দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, "মানতে কষ্ট হয়। আমি স্টেশন মাস্টার, আর আমার জামাই কিনা এই স্টেশনেই মারা পড়লো ট্রেনের নিচে। তিন টুকরো হয়ে গেল দেহটা।"
"ইশ বলেন কি?" অবাক হয়ে বললাম।
"হ্যাঁ, আমার বিকাশের মুখে মেয়েটা খবর শুনেই অজ্ঞান হয়ে পড়লো।"
"বিকাশবাবু দেখেছিলেন আগে লাশটা?"
"প্রতিবার আগে ওরই নজরে আসে।"
"প্রতিবার?" বুঝলাম না, "মানে এখানে আগেও মানুষ ট্রেনে কাটা পড়েছে?"
"এই বছরে এগারোজনের লাশ এভাবেই সকালে পাওয়া গেছে।" কথাটা শেষ না হতেই বিকাশদা ছুটে এলেন। চোখেমুখে উদ্বেগ।
"বাবু, সর্বনাশ হয়েছে।"
"কি বলেন? আপনি আবার কারো লাশ দেখেছেন?" আঁতকে উঠে অভি।
"আজ্ঞে হ্যাঁ সাহেব।"
"কার?"
"সুকান্ত মশাইয়ের।"
টেবিল ছেড়ে উঠলাম সবাই। তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে চললাম, সকলের মনেই একঝাঁক অজানা আতংক বিরাজমান।
চলবে ইনশাআল্লাহ
1
23
Well writing