আরাবি - জেমস জয়েস

13 47
Avatar for Jahidur123
3 years ago

ক্রিশ্চিয়ান ব্রাদার্স স্কুলের বালকেরা বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার পর দলে দলে বের ঝা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নর্থ রিচমন্ড রোডটি একেবারে ঝিম মেরে পড়ে থাকে। দুপাশে দোতলা বাড়ি গুলো মিলেমিশে আছে শরীরের সাথে শরীর লাগিয়ে ঘেঁষার্ঘেষি করে। অভিজাত শ্রেণীর মানুষেরা নিরুপদ্রবে বাস করে এখানে। রাস্তার একেবারে শেষ প্রাণ্ডে দাঁড়িয়ে আছে ফাঁকা নিরিবিলি একটা বাদামী রঙা দোতলা বাড়ী।

অনেক আগে আমাদের বাসায় একজন যাজক ভাড়া থাকতেন, পেছনের ড্রইংরুমে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন, সে থেকেই রুমটা আর তার পাশের অন্যান্য কক্ষ গুলো দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ, রুমণ্ডলোর ভ্যাপসা আর গুমোট অবস্থা, পেছনের রান্না ঘরে জমা ছিল রাজ্যের টুকিটাকি জিনিস ও আবর্জনা, সেখানে আমি মলাটে মোড়া কিছু বই পেয়ে যাই। বইয়ের কাগজ গুলো  স্যাঁতসেঁতে আর পাতা গুলো কোঁকড়ানো। স্যার ওয়াল্টার স্কটের The Abbot, The Devout Communnicant এবং The Memoirs of Vidocq বইগুলো। আমি শেষোক্ত গ্রন্থটি পছন্দ করলাম কারণ এর পাতাগুলো হলদে হয়ে গিয়েছিল। বাড়ীর পেছনে ছিল একটা জংলা বাগিচা মাঝখানে ছিল একটি আপেলগাছ আর ইস্তততঃ ছড়ানো ছিটানো কিছু আগাছার ঝোপ, এই ঝোপগুলোর একটির তল থেকে আমি কুড়িয়ে পাই আমাদের মৃত ভাড়াটিয়া যাজকের সাইকেলে হাওয়া দেয়ার পাম্পটি। যাজক মহোদয় ছিলেন খুবই দানশীল মানুষ, তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তার সকল সহায় সম্পদ অর্থ তিনি দান করে গিয়েছিলেন নানা প্রতিষ্ঠানে আর তাঁর গৃহের সব আসবাব প্রত্র তিনি তাঁর বোনকে দিয়ে গিয়েছিলেন।

Zero width embed

যখন শীতের দিনগুলো ছোট হয়ে, আসতো তখন গোধূলীর আবছা অন্ধকার নেমে আসার পূর্বেই আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিতাম। যখন আমরা সবাই বাড়ীর সামনের রাস্তাটায় মিলিত হতাম তখন চারপাশে নেমে আসতো কবরের মতো নীরবতা, মাথার উপরের আকাশে তখন বেগুনী আভা ধরেছে। আর রাস্তার বাতিগুলো মিট মিট কনে জ্বলতো। ঠান্ডা হাওয়া শরীরে এসে ঝাপটা দিতো। আমাদের শরীরগুলো আবছা হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা খেলতেই থাকতাম। আমাদের চিৎকার চ্যাঁচামেচি প্রতিধ্বনি তুলতো নির্জন রাস্তায়। আমাদের খেলার পরিস্থিতি অনুযায়ীই আমাদেরকে শেষে নিয়ে আসতো বাড়ীর পেছনের অন্ধকারাচ্ছন্ন কর্দমাক্ত পথটাতে। বাড়ী হতে ভেসে আসা গালি গালাজের ভয়ে আমরা দৌড়ে চলে যেতাম পেছনে অন্ধকারে ডুবে থাকা বাগানে। যেখানে ছাইয়ের গাদার তীব্র গন্ধ ভেসে আসতো, সেই ছাই গাদার গন্ধমাখা অন্ধকারে ঘোড়ার গাড়ীর কোচম্যান তার অশ্বগুলোর দলাই মলাই করতো, আর অশ্বগুলোর লাগামের আওয়াজে সৃষ্টি হতো এক সঙ্গীতময়তা। যখন আমরা রাস্তা হতে গৃহে ফিরে আসতাম তখন রান্না ঘরের জানালাপথে হওয়া আলো অঙ্গনটা আলোকিত করেছে।

আশে পাশে যদি আমার চাচাকে দেখতে পেতাম তাহলে আমরা দ্রুত অন্ধকার জায়গায় লুকিয়ে পড়তাম। যে পর্যন্ত না তাকে আড়াল করে বাড়ীতে ঢুকে পড়তে পারতাম কিংবা  যদি ম্যানগানের বোনটি বাইরে দরজার সামনে বের হয়ে তার ভাইকে চা পান করার জন্যে ডাকত, আমরা তাকে দেখার জন্যে উঁকিঝুঁকি দিতাম। রাস্তায় আমাদের ছায়া গুলোও উঠানামা করতো। আমরা তার অবস্থান এবং বাড়ীর ভেতরে চলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম। আমরা আমাদের ছায়া পেছনে ফেলে পরাজিতের মতো ম্যানগানের সাথে পা ফেলে অগ্রসর হতাম। সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতো, দরজার ফাক হতে বের হয়ে আসা আলোতে তার শরীরটা দৃশ্যমান হতো। যে পর্যন্ত তার ভাইটি তার বশ্যতা না মানতো ততোক্ষন পর্যন্ত সে তাকে উত্যক্ত করতেই থাকতো। আমি রেলিং এর সামনে দাঁড়িয়ে ওকে প্রত্যক্ষ করতাম। তার শরীরে নড়াচড়াতে তার বসন আন্দোলিত হতো আর কোমল চুলের বেণীটা এপাশে ওপাশে দুলতো।

Zero width embed

প্রতিদিন সকালে আমি সামনের বৈঠকখানার মেঝেতে শুয়ে ওদের দরজার দিকে  নজর রাখতাম, জানালার দিকটা একটু ফাঁকা থাকত সেই ফাকে আমি উঁকি ঝুকি মেরে তাকে দেখতে ব্যর্থ হতাম। ও যখন ওদের বাড়ীর দরজার সামনের সিঁড়িতে বের হতো তখন আমার হৃদয়টা উথাল পাথাল করতে থাকতো। আমি দ্রুত দৌড়ে হল ঘরে গিয়ে একটি বই হাতে করে পড়ার ভান করে তাকে দেখতাম। আমি সর্বদা তার বাদামী রঙা শরীরটা চোখে চোখে রাখতাম আর যখন আমরা দুজন কাছাকাছি আসতাম তখন আমি দ্রুত মনোযোগ অন্যদিকে নিমগ্ন করতাম, দ্রুত পাশ কাটিয়ে যেতাম তাকে। প্রতিটি সকালেই এমনটি ঘটতে থাকতো। প্রয়োজনীয় কোন কথা ছাড়া বিশেষ কোন কথাই হতোনা তার সাথে অথচ তার নামটা আমার রক্তের মাঝে ডাক দিয়ে সারা হতো। স্থান কালের নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তার ছবি সর্বদা একটা রোমান্টিকতাসহ আমাকে ঘিরে থাকতো। শনিবার সন্ধ্যাবেলা আমার চাচী বাজারে যেতেন, আমি তাঁর সাথে ব্যাগ ট্যাগ বহন করতাম। আলোকোজ্জ্বল রাস্তা ধরে আমরা হেঁটে যেতাম। মাতাল লোক, দাম নিয়ে দর কষাকষি করা মহিলা আর গালিগালাজরত শ্রমিকদের ঠেলেঠুলে আমরা অগ্রসর হতাম। বাক্সর ভর্তি ‘পিগ’স চিক’ সামনে রেখে দোকানের বালকগুলো চিৎকার করে ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করতো। নাকি সুরে (নাকে বাঁশী থেকে) পথ গায়করা গাইতো, চলে এসো সদলে “ও ডনোভান রোসা' কিংবা আমাদের জনপদের কোন বিষাদ গাঁথা।

এইসব শব্দাবলী বিন্দুমাত্রও আমাকে স্পর্শ করতোনা। আমি ভাবতাম আমার এ পানপাত্র আমি নিরাপদে ছুড়ে দিতে পারবো শত্রু বুহ্য লক্ষ্য করে। বিপদকালীন প্রার্থনা কিংবা ভক্তিপূর্ণ কোন কর্মে হঠাৎ করেই কেন জানি ম্যানগানের বোনের নামটা মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতো আমি তা আদৌ বলতে পারবোনা। আমার দু’চোখ সর্বদা অশ্রুপূর্ণ থাকতো (কেন তা থাকতো আমি তা বলতে পারবোনা) আর একই সময়ে কিসের আবেগধারা যেন আমার হৃদয় হতে উপছে বের হতো বক্ষভেদ করে। আমি ভবিষ্যতের কথা অল্পই ভাবতাম। আমি জানতাম না আমি কখনো তাকে আমার চিরন্তন কথাটি বলতে পারবো কিনা, যদিও বলতে পারি তাহলে আমি আমার অন্তরের এলোমেলো অবস্থার কথা বলতে পারবো কিনা সন্দেহ। আমার পুরো শরীরটা ছিল বাদ্যযন্ত্রের মতো তার শব্দাবলী আর চলনবলন আমার বীণা তারে যেন অঙ্গুলি চালনা করে যেতো।

Zero width embed

একদিন সন্ধ্যে বেলায় আমি পেছনের বৈঠকখানা ঘরে চলে এলাম, যেখানে ভাড়াটিয়া যাজক মারা গিয়েছিলেন। এটা ছিল বৃষ্টিমুখর একটি সন্ধ্যা, গৃহে কোন রকম সাড়া শব্দ ছিলনা। আমি শুনছি অবিরল বৃষ্টির আছড়ে পড়ছে আধা সিক্ত ঘামাচ্ছাদিত মৃত্তিকায় সূচের মতো। একটু দূরের বাতিগুলো আর জানালার মৃদু আলো আবছা দেখাচ্ছিল। আমি ধন্য, এর অল্প কিছুই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার একান্ত ইচ্ছের কাছে এইসব দৃশ্যাবলী একেবারে ঢাকা পড়ে যেতো, আমি দ্রুত পিছলে বের হয়ে যেতাম এসব থেকে আমার দয়িতার উদ্দেশ্যে। আমি আমার দু’হাতের পাতা একত্র করে কচলাতে কচলাতে বিড়বিড় করে অনেকক্ষন ধরে উচ্চারণ করতাম, ও প্রেম! ও আমার ভালোবাসা!

অবশেষে সে আমার সাথে কথা বললো। যখন সে আমাকে উদ্দেশ্য করে তার প্রথম বাক্যটি উচ্চারণ করলো, আমি ভেবে পেলাম না এর কি উত্তর দেবো। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি আরাবিতে গিয়েছিলাম কিনা। আমি গিয়েছিলাম কিনা মনে নেই, আমি হা না গোছের একটা জবাব দিলাম। আরাবি ছিল একটা বর্ণিল বাজার। ও বললো, সেখানে সে খুশি মনে যেতে আগ্রহী।

তবে যাওনা কেন, জিজ্ঞেস করলাম আমি। ও তার কবজিতে জড়ানো রূপোর ব্রেসলেটটা ঘোরাতে ঘোরাতে কারণ হিসেবে সে বললোঃ গীর্জায় উপস্থিত থাকতে হবে আর এ সপ্তাহে গীর্জায় প্রার্থনা সভার জমায়েতে যোগ দিতে হবে। ওর ভাই আর দুটি বালক তাদের ক্যাপ নিয়ে টানা হেচড়া করছিল আর আমি একাকী দাঁড়িয়ে ছিলাম রেলিং ধরে। অপর পাশে আমাদের গৃহের দরজার ফোকর গলে বাতির আলো ঠিকরে পড়ে ওর কণ্ঠদেশ বেষ্টন করে বৃত্ত তৈরী করছিল, কেশ গুচ্ছ তার অলস ভাবে বিশ্রাম নিচ্ছিল আবার এলিয়ে পড়ছিল। হাত দুটো ওর আলতো করে বিশ্রামের ভঙ্গিতে রাখা ছিল রেলিংএ। একপাশে ঝুলে পড়া ঘাঘড়ার সাদা কিনারা ধরে রেখেছিল।

এটা তোমার জন্য ভালো হবে, বলল সে।

যদি আমি মেলাতে যাই, তাহলে তোমার জন্য অবশ্যই কিছু আনবো? আমি বললাম।

কি বোকামীই না আমি করেছি, প্রতিদিনের জাগরণে আর নিদ্রায়, সেদিন সন্ধ্যের পর থেকে সব কিছু ঝেঁটিয়ে দূর করলাম মন থেকে, সেদিন সন্ধ্যের পর হতে ভাবলাম আমার সব ক্লান্তিকর দিক গুলো একেবারে ধ্বংস করে দেবো। বিদ্যালয়ের কাজগুলো আমার কাছে জ্বালাতন বলে মনে হলো। দিনের বেলায় আমার শ্রেণী কক্ষে আর রাতের বেলায় আমার শয়ন কক্ষে শুধু তারই মুখ আমার ভেতরে আসা যাওয়া করতে লাগলো। পড়াশুনার ব্যাপারটাও ক্লান্তিকর মনে হতে থাকলো। আরাবি নামের অক্ষর কটি আমার নীরব অন্তঃকরণকে বিলাস বৈভবে আহ্বান জানালো আর প্রাচ্যদেশীয় সন্মোহনী যেন আমার মাঝে ভর করলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম শনিবার রাতে আমাকে বাজারে যেতে হবে কিনা। আমার চাচী অবাক হলেন আর আশা করলেন যে এটি গোপন ভ্রাতৃসংঘে যোগ দেয়ার কোন উদ্দেশ্য নয়। আমি আমার ক্লাশে পাঠের খুব কমসংখ্যক উত্তর প্রদান করলাম। আমি লক্ষ্য করলাম আমার শিক্ষকের মমত্ববোধ নয় কাঠিন্যতার ছায়া পড়েছে

23
$ 0.00
Avatar for Jahidur123
3 years ago

Comments

great

$ 0.00
3 years ago

Apnake subscribe korlam, bback korben plz...

$ 0.00
3 years ago

Wow

$ 0.00
3 years ago

Thanks all

$ 0.00
3 years ago

Good article

$ 0.00
3 years ago

Nice Article

$ 0.00
3 years ago

Nice

$ 0.00
3 years ago