খাটের নিচে তাকিয়ে কোনো লাশ দেখতে পেলাম না।লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসলো। পাশ থেকে হো হো করে হেসে অফিসার জিজ্ঞেস করলেন,
--কি রাতুল হাসান, দেখান তো আপনার লাশ।
--স্যার, বিশ্বাস করুন আমি নিজের চোখে সেই লাশটি দেখেছি।নিজের হাতে করে টেনে নিয়ে খাটের নিচে রেখেছি।
--তাই বুঝি।গল্পটি ভালো ছিল।লাশ এর হাত পা সচল হয়ে গিয়েছে তাই হেটে চলে গিয়েছে এটা বলতে চান?
--আমার লজ্জা আর রাগ দুটোই লাগছিল।আমি তাদের বুঝালাম আমার কাছে চাবি ছিল।লাশটা বন্ধ কামড়াতে ছিল।তাহলে যাবে কোথায়। আমি খেয়াল করলাম অফিসার একটু আগের নরমভাবে কথা বলছিলেন, কিন্তু এখন কঠিন সুরে কথা বলছেন।আমি যেন দশ খুনের আসামি।
-- শুনুন রাতুল হাসান, আপনি বড়লোক মানুষ গত রাতে পেটে একটু বেশি মাল পরেছে। তাই আবোল তাবোল বকছেন। রামুকে লক্ষ্য করে বললো,"এই তুই ওনাকে লেবুর রস দে।মাতলামি বন্ধ হয়ে যাবে।"লাস্ট ওয়ার্নিং এভাবে যদি আর পুলিশ কর্মকর্তাদের হেনস্তা করে তাহলে একেবারে জেলে পুরে দিবো।
রাতুল হাসান এর সেই লাশটির উপর রাগ উঠছিল। এগুলো মনের ভুল হতেই পারে না। রামু রান্নাঘরে চলে গেল।পুলিশ অফিসার চলে যাওয়ার সময় তার চোখে ক্ষোভ দেখতে পেলাম।
পনেরো.
আজ দুপুরের খাবার খায় নি। রামু এসে অনেক বললো।আমি শেষে তাকে ধমক দেই। তাকে চলে যেতে বলি।সে চোখ মুখ শক্ত করে চলে যায়। আমি তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ফোন এসেছিল রফিকের।খবর নিলো কেমন আছি।আমি খুব সুন্দর করে একের পর এক মিথ্যা বলেই গেলাম। আমি ভালো নেই।আসলেই নেই। রফিককে বললে বেচারা চিন্তা করবে।এমনিতেই সে আমার সাথে আসতে চেয়েছিল।রফিক অসুস্থ ছিলোও বটে।
একটা সিগারেট ধরাই।ভাবতে লাগলাম এগুলো কি আসলেই মনের ভুল নাকি সত্যি? মেয়েটার চেহারা স্পষ্ট আমার চোখে ভাসছে। মনের ভুল এত বাস্তবধর্মী হয়ে থাকে। সিগারেটে নিকোটিন এর অভাব পড়েছে। আমি পর পর তিনটি সিগারেট ধরাই।নিকোটিন এর অভাব রয়েই গেল।বিকেলের মিষ্টি হাওয়া বইতে লাগলো।
ষোল.
রামুর সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। বেচারা বিকেলে চলে গিয়েছে। আমার জন্ন্যে কম করেনি রামু।নিজের প্রতি ঘৃনা লাগলো। রাত ৮ঃ৪৭ বাজে।পিন পতন নিরবতা। হাতে বই আর চায়ের কাপ।আমিই চা বানিয়েছি। অনেক খুজেও চিনির ছিটেফোঁটা পেলাম না। তাই চিনি ছাড়া চা খাচ্ছি।লিকার বলে যেটাকে। এটার আবার আলাদা মজা আছে।একটা গোঙানির মতো আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমার কিছুতেই নেশা হচ্ছে না।একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছি আর খাচ্ছি।গোঙানির শব্দ একটু পরে কথায় রুপান্তরিত হয়ে যায়।
--আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে খুব।ওরা আমার স্বামীকে মেরে আমার সম্মানহানী করে।কি দোষ ছিল আমার। চেহারাটা একটু ভালো ছিলক তাই।
-- কাপা কন্ঠে,কে?
--আমাকে তুই চিনবিক লা আমি লিপ্সা। আমি তোকে দেখেই বুঝেছিলামরে তুই আমাকে মুক্তি দিতে পারবিরে!
-- আপনি আমার সামনে আসুন। আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি?সেই প্রথম থেকেই আমায় এভাবে মানসিক ভাবে কষ্ট দিচ্ছেন কেনো? আপনার জন্ন্যে কম অপমান হতে হয় নি।
-- তুই ভুল করতে যাবি কেন?ভুলতো করেছে ওই পশুরা।আমার স্বামিকে সাত সাত বার ছোড়া চালিয়েছে।তাহলে তুই বল সে কি আর বেচে থাকবেক।
আমি গত রাতে যে মেয়েটির লাশ দেখেছিলাম,সে এখন আমার সামনে দাড়িয়ে আছে।মুচকি মুচকি হাসছে।এই অবস্থায় কত অপরুপ দেখাচ্ছে তাকে। সাথে প্রচুর ভয়ও পেলাম। জ্ঞান যায় যায় অবস্থা। আমি কুলকুল করে ঘামছি।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ছোটাছুটি।
--তুই ভয় পাসনে।তোকে আমি কিছু করবো না।তোর কিছু হলে আমার মুক্তি মিলবে কেমন করে বলতো দেখি।
--আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
সে কোনো উত্তর না দিয়ে বিকট চিৎকার করে কাদতে লাগলো এবং বললো,"তুই জানিস আমাদের বিয়ে হয়েছে পাচ মাস হয়েছে।আমরা তখন এই বাড়িটি জমিদার এর নাতিপুতি দের থেকে কিনে নেই।বেশ কিছুদিন পর চারজন লোক আসে বলে তারা খুব বিপদে আছে।তাদের কিছুদিন আশ্রয় চাই।আমরা তাদেরকে সাহায্য করলাম। সেটাই ছিলো সবচেয়ে বড় ভুল।দুইদিন পরে রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। হটাৎ মুখে একটা তরল পদার্থ এসে পরে।আমার স্বামীর তাজা গরম রক্ত।দেখলাম তাকে ছোড়ার আঘাত করা হচ্ছে।স্বামী গলাকাটা মুরগীর মতো ছটপট করছিলো।আগে শুনতাম লোভ,লালসা ও কামনা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। আজ সেটা নিজের চোখে দেখলাম। আমি যে আটকাবো সেটার জো নেই।একজন হাটু দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরেছে আর দুজন হাত পা।আমার স্বামী মৃত্যু কোলে শুয়ে পড়ে। শেষ সময়ে আমার দিকে কাতর দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলো।হয়তো বলছে তুই ভয় পাসনে লিপ্সা।পরের জন্মে তুই আর আমি সুখের সংসার করবো।রক্তে খাট চাদর ভিজে গেছে। দেখলাম মৃত স্বামীর চোখ দিয়ে এক ফোটা জ্বল চুইয়ে পরছে।জানোয়ার গুলো আমার সম্মানহানী করে আমায় বারান্দায় সামনে পুতে দিলো।আমার স্বামীকে জঙলে ফেলে দিয়ে আসলো।এর পর থেকেই আমার অতৃপ্ত আত্না এখানে ঘুরে বেড়ায়।মুক্তি!মুক্তি! মুক্তি! মুক্তি কোথায় আছে? মুক্তি কোথায় পাবো?
সব ঘটনা শুনে বুকটা দুমড়ে মুচড়ে গেল।মানুষ কামনার লোভে এত নিষ্ঠুর, নির্দয় হতে পারে।নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরতে লাগলো।আর ভাবতে পারছি না। মানুষ নামের পশুদের উপর ঘৃনা বেড়ে গেল।এখন আর ভয় লাগছে না।আমি লিপ্সাকে জিজ্ঞেস করলাম,"তারা কি এখোনো বেচে আছে।আমি তাদের পুলিশে দেবো"
লিপ্সা বিকৃত হাসি দিল।খুব হাসছে।হাসতে হাসতে বললো,"আমি কি ওই জানোয়ার এর বাচ্চাদের তোর জন্ন্যে বাচিয়ে রেখেছি।ওদের শেষ করে দিয়েছি।মানুষ মৃত্যুর পরে অনেক কিছুই করতে পারে যা জীবিত অবস্থায় সম্ভব নয়।"তুই কি আমায় মুক্তি মিলিয়ে দিতে পারবি,এই বাড়িতে থাকতে আর ভালো লাগছে না।আমাকে মুক্তি দিবি মুক্তি!এটা বলে লিপ্সা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
আমি তাকে দাড়াতে বললাম।কিন্তু সে শুনেনি।আমি আর দেরি না করে ঘুমিয়ে গেলাম।
সতেরো.
রামুকে সকাল সকাল দেখে খুশি হলাম।আমি বললাম,
--রামু একটা শাবল হবে?
--আগ্রহী চোখে রামু বললো কেন বাবু কি করবেন?
--আহা,যা বলেছি তা করো সময় বেশি নেই আজই চলে যাব।
রামুকে দেখলে মনে হয় এখনি একগাদা প্রশ্ন করবে।আমি রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম যতক্ষণ পর্যন্ত শাবল না আনলো।
আমি শাবল নিয়ে দোতলায় বারান্দায় গিয়ে খোড়া শুরু করলাম। কিছুই পেলাম না।আবারো খুড়তে লাগলাম।এক সময় শক্ত কিছু সাথে শাবলটা ধাক্কা খেলো।দেখলাম একটি কংকাল। কাপড়ে পেচিয়ে নিলাম।নিচে বড় করে আগুনের আয়োজন করলাম। শেষ বারের মতো কংকালটা দেখে আগুনে পুড়িয়ে দিলাম।দুপুরের দিকে রামুর হাতের রান্না খেয়ে রওনা দিলাম নিজ গন্তব্যে। চলে যাওয়ার সময় রামুর চোখ ভেজা দেখলাম। সে আমার জন্য কম করেনি।তার হাতে কিছু টাকা গুজে দিলাম। আজ অনেক দিন পর আত্মায় এক শান্তির বোধ হচ্ছে।রাস্তায় দুপাশে কাশফুল খেলা করছে।আমার জিপটাও মনের সুখে ছুটে চলেছে।আজ যেন সকলের উৎসব।সুর্য মিষ্টি আলো গায়ে এসে পরছে।বেশ ভালোই লাগছে। বেচে থাকার ইচ্ছা খানিকটা বেড়ে গেলো।পাখিরা গান গাইছে গুন গুন করে।আমিও গুন গুন করে গান ধরলাম, আমার হিয়ার মাঝে...............
আঠারো.
বাসায় পৌছোতেই রফিকের একগাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো।কেমন হলো একা একা ঘুরে এলেন যে,কি খেলেন,কোথায় ঘুরলেন ইত্যাদি। আমি বললাম, এত আহামরি কিছু হয়নি কিন্তু এটা আমার জীবন এর সেরা জার্নি। আমি বার বার যেতে চাই সেখানে। এক আত্মার মুক্তি। হয়তো লিপ্সার আত্মা আজোও ঘুরে বেড়ায় সেই বাড়ির আসে পাশে। নিয়তি বড়ই অদ্ভুত, বড়ই অদ্ভুত। রফিক আমার দিকে কৌতুহলের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।আমার মনে হলো কেউ পেছন দিয়ে বলে গেল,"অনেক ধন্যবাদ।আত্মার মুক্তি ঘটেছে, আত্মার মুক্তি ঘটেছে।" এক মৃদু হাওয়া পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
.
.
.
(সমাপ্ত)....
Nice article