১৯৪৭-এর ২২ অক্টোবর পাকিস্তান সেনা তাঁদের উপজাতি মিলিশিয়াকে জম্মু ও কাশ্মীরে পাঠিয়ে দেয়। শুরু হয় তাঁদের ‘অপারেশন গুলমার্গ’। পুরোটাই পাকিস্তানি সরকারের মদতে পাক-সেনাদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি জনজাতিদের মাধ্যমে কাশ্মীর দখলের লড়াই। মুজফ্ফরাবাদা, ডমেল ও উড়ি দখলের পর পাক সেনার নেতৃত্বাধীন ট্রাইবাল লস্করেরা ২৬ অক্টোবর পৌঁছায় বারামুলা। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের নেতৃত্বাধীন দুবৃত্তেরা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে বারামুলাকে। কিন্তু এই ইতিহাস অনেকেই জানেন না। বারামুলায় পাকিস্তান কী সর্বনাশা অত্যাচার চালিয়েছিল তার একটি বর্ণনা রবার্ট ট্রামবুল ১০ নভেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমসে তুলে ধরেছিলেন।
বারামুলার যাবতীয় সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় সেনারা সেখানে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত সেখানকার তরুণদেরও ভোগদখল করেছিল পাক-হানাদারেরা। গোটা শহরটাকেই প্রায় মানবশূন্য করে তুলেছিল তাঁরা। ছোট্ট শহরটির প্রায় তিন হাজার মানুষকে হত্যা করে পাক-সেনার হাতে গড়া উপজাতি জঙ্গিরা। হানাদারদের হাতে প্রাণ হারান শহরের মানুষদের পাশাপাশি ৪ ইউরোপীয় নাগরিকও। অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ আর্মি অফিসার কর্নেল ডিক ও তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকেও হত্যা করে কাশ্মীর দখলের লোভে উন্মাদ হামলাবাজরা।
আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি গির্জাও। ২৬ অক্টোবর জোসেফের ফ্রান্সিসকান কনভেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে তারা যথেচ্ছ লুঠপাট চালায়। হাসপাতাল ও চার্চকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। চারজন নান ছাড়াও কর্নেল ডিক ও তাঁর স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করে হানাদারেরা। ৩৫০ জন স্থানীয় হিন্দুকে একটি ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।
বারামুলা আক্রান্তে ২৪ ঘণ্টা পরেই ভারতীয় সেনা পৌঁছায় শহরে। কিন্তু তার আগেই শহরটির ১৪ হাজারের জনবসতি কমে দাঁড়ায় ১ হাজারে। পাকিস্তানি হানাদারেরা শহরটাকেই জনমানবশূন্য করে তোলে।
অ্যাসোসিয়েট প্রেসের ফটোগ্রাফার ম্যাক্সি ডসপাটের বর্ণনা অনুযায়ী, ২ নভেম্বর ২০টিরও বেশি গ্রাম তিনি জ্বলতে দেখেছেন। বারামুলা থেকে ২০ মাইল দূরে শ্রীনগরে বসেও সেই ভয়ঙ্কর আগুন দেখা গেছে। ইসলামাবাদের নির্দেশে হানাদারেরা ব্যাপক সন্ত্রাস ও ধ্বংসপ্রক্রিয়া চালাতে চালাতেই শ্রীনগরের উদ্দেশে অগ্রসর হতে থাকে। সেই ধ্বংসের ১০ দিন লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস কাগজের সিডনি স্মিথ বারামুলা হাসপাতালেই ছিলেন। তিনিও পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়ে নিজের প্রতিবেদনে ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরেন। পাহাড়ের ওপর থেকে গুলি করতে করতেই তাঁরা সমতলের দিকে এগিয়ে আসে। পথের দু-ধারের অগণতি মানুষ প্রাণ হারান। বাড়িঘর পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপে। বাধ্য হয়ে স্মিথরা সেদিন দেখেছেন হানাদারেরা হাসপাতালের পাঁচিল ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকে রোগীদের ওপর যথেচ্ছ গুলিবর্ষণ করে। ফিলোমিনা নামের বছর কুড়ির এক ভারতীয় নার্স সদ্যজাত একটি মুসলিম শিশুকে প্রাণে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু হানাদারেরা প্রথমেই তাঁকে হত্যা করে। সদ্যজাত মুসলিম শিশুটিকে তারপরই হত্যা করা হয়। ঘটনার খবর পেয়েই মাদার অ্যালডারট্রুড ওয়ার্ডে ছুটে যান। তাঁর ওপরও চড়াও হয় হানাদারেরা। সহকারী মাদার টেরেসালিনার চোখের সামনে ঘটতে থাকে নৃশংসতা। পরে অবশ্য তাঁর হার্টেও ঢুকে হানাদারদের গুলি! মাদার অ্যালডারুব্রুটের ওপর আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে এসে কর্নেল ডিকসও পাকিস্তানি হানাদারদের বুলেটে নিহত হন। মাদার বাঁচেননি। আর তাঁকে বাঁচাতে এসে অনেকেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। আর কর্নেল ডিকসকে সাহায্য করতে এসে তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীও প্রাণ হারান। তাঁর মরদেহ কুয়ায় নিক্ষেপ করা হয়। পরে সেখান থেকে উদ্ধার হয় সেই লাশ। প্রায় একই সময়ে হাসপাতালের বাগানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গি বোরেটোকে ৯ জন নানের সামনে গুলি করে উপজাতি জঙ্গিরা। তারপর নানদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। ধর্মপ্রচারক মেজর রোনাল্ড ডেভিস ও তাঁর এক ইংরেজ সহকারীকেও গুলি করে মারা হয়। তাঁর অপর সহকারীকে দুবৃত্তরা পাহাড়ে নিয়ে হত্যা করে।
বারামুলার আবদুল ওহমান তার নিজের চোখে দেখা সন্ত্রাসের বিবরণ তুলে ধরেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, হানাদারেরা প্রথমেই হিন্দুদের বাড়িঘর আক্রমণ করে চলতে থাকে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড। এরপর শিখরাও আক্রান্ত হন একইভাবে। প্রথম দিকে মুসলিমদের তারা কিছু বলেনি। পাকিস্তানি বর্বরতার কারণে হিন্দু ও শিখরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তখন তাঁদের বাড়ি-ঘর লুঠপাট করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় সব নারীই অপহূত বা ধর্ষিতা হন। প্রথম দিকে মুসলিমদের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করে হানাদরারা। কিন্তু দু-একদিন পরেই মুসিমদের ওপরও শুরু হয় একই ধরনের নৃশংসতা। হিন্দু-মুসলিম-শিখ সব সম্প্রদায়ের মানুষই শিকার হন উপজাতিদের আক্রমণের। তাঁদের সামনে যাঁরাই এসেছেন, তাদেরকেই হত্যা করেছে। শিশু, বৃদ্ধ বা নারী কেউই রক্ষা পাননি। মুসলিম সম্প্রদায়েরও প্রতিট নারীই বলা যেতে পারে ধর্ষিতা হয়েছেন। সোনা-রুপা থেকে শুরু করে জামা-কাপড় পর্যন্ত লুঠ করে হানাদারেরা।
বারমুলার উজির-ই-ওয়াজাত চৌধুরি ফৈজুল্লার বিবণ অনুযায়ী, হানাদারেরা ৩০ থেকে ৪০ জনের দল করে হামলা চালাতো। একযোগে হাজার পাঁচেক হানাদার ধ্বংস প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত থাকতো। এদের মধ্যে প্রায় সবই উপজাতি। তবে কিছু পাঞ্জাবি মুসলিম ছাড়াও পীর, পাকিস্তানি সেনা ও শীর্ষস্থানীয় সেনাকর্তাদেরও দেখা গেছে। স্থানীয় মুসলিম কনফারেন্সের লোকজনকেও হানাদারদের সঙ্গে দেখা গিয়েছে। তারা স্থানীয় গাইড হিসেবে কাজ করেছে। বারামুলায় থেকে প্রচুর মূল্যবান সামগ্রী লুঠ করে হানাদারেরা! ২৮০টি লরি ব্যবহৃত হয় সেই লুঠের মাল বারামুলা থেকে উড়ির দিকে নিয়ে যেতে। ৭ নভেম্বর হানাদাররা বারামুলা ছাড়ার পর দেখা যায় কোনো বাড়িই লুঠপাটের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। আক্রমণকারীদের দাবি মেটাতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন বাসিন্দারা।
ভারতীয় সেনার বারামুলা পুনরুদ্ধার তাঁদের কাছে ছিল পরম প্রাপ্তীর। দ্য টাইমস অব লন্ডন ১১ নভেম্বর তাঁদের পত্রিকায় লিখেছে, বারামুলার মানুষ ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে আনন্দের সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছে ভারতীয় সেনাকে। পাকিস্তান অপপ্রচার চালালেও বারামুলার মানুষ জানেন, ভারতীয় সেনা কোনো ক্ষতি করেনি তাদের। বরং বহু মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করেছে ইন্ডিয়ান আর্মির বারামুলায় প্রবেশ। তাই তাঁরা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নিয়ে গর্বিত। আর বারামুলার সেদিনের ভয়ঙ্কর উপজাতি আগ্রাসন যে পাকিস্তানি নেতাদের নির্দেশে পাক-সেনার নেতৃত্বেই হয়েছে, এ বিষয়েও তাঁদের কোনো দ্বিমত নেই।
ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান সময়ের জন্য।