বইপড়া নিয়ে কিছু কথা:
বই পড়া আর শিক্ষা অর্জন করা কতটা পরিপূরক?? সব ধরণের বই কি সবসময় মনুষ্যত্ব অর্জন, আত্মশক্তি এবং জ্ঞান গরিমার বাহন??
আজকে সে সম্পর্কে দু'কথা লিখতে বসেছি। ক্ষুদ্র জ্ঞানে কোনোকিছু লেখা সত্যি বাড়াবাড়ি। তবে, বাড়াবাড়ি হলেও শূন্য হাঁড়ির মধ্যে কিছুটা অক্সিজেন কিন্তু থাকে।
বই,বই পড়া --- শব্দগুলো শুনলেই হৃদয়ে যেন জ্ঞান এসে ছুঁয়ে যায়। বই সেতো আত্মশুদ্ধির বাহক।জ্ঞান গরিমার হাতিয়ার।
বই সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উক্তি জেনে নিই:---
১. বই পোড়ানোর চেয়েও গুরুতর অপরাধ অনেক আছে। সেগুলোর মধ্যে একটি হল বই না পড়া।--জোসেফ ব্রডস্কি
২.বই পড়ার অভ্যাস নেই আর পড়তে জানেনা এমন লোকের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
The man who does not read has no advantage over the man who cannot read.
মার্ক টোয়েইন (Mark Twain)
৩.বই ছাড়া একটি কক্ষ আত্মা ছাড়া দেহের মত।
A room without books is like a body without a soul.
মার্কাস টুলিয়াস সিসারো (Marcus Tullius Cicero)
৪. গৃহের কোনো আসবাবপত্র বইয়ের মতো সুন্দর নয়। (সিডনি স্মিথ)
৫. বই কিনে কেউ কোনোদিন দেউলিয়া হয়না। (প্রমথ চৌধুরী)
৬. বই হচ্ছে মস্তিষ্কের সন্তান। (সুইফট)
৭. আইনের মৃত্যু আছে কিন্ত বইয়ের মৃত্যু নেই। (এনড্রিউ ল্যাঙ)
৮.আমরা যখন বই সংগ্রহ করি, তখন আমরা আনন্দকেই সংগ্রহ করি। (ভিনসেন্ট স্টারেট)
৯.ভালো খাদ্য বস্তু পেট ভরে কিন্ত ভাল বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে। (স্পিনোজা)
১০.বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেয়া সাঁকো। (রবীন্দ্রনাথ)
১১. যদি বইটা হয় পড়ার মতো তা কেনার মতো বই। (জন রাসকিন)
১২. বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনদিন ঝগড়া হয় না,কোনদিন মনোমালিন্য হয় না। (প্রতিভা বসু)
১৩. যে বই পড়েনা,তার মধ্যে মর্যাদাবোধ জন্মেনা। (পিয়ারসন স্মিথ)
১৪.বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে,তার জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।
(শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
১৫. একটি ভালো বই হলো বর্তমান ও চিরকালের জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বন্ধু। (টুপার)
১৬. অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল। (নেপোলিয়ান)
১৭.একটি বই পড়া মানে হলো একটি সবুজ বাগানকে পকেটে নিয়ে ঘোরা। (চীনা প্রবাদ)
১৮. বই হলো এমন এক মৌমাছি যা অন্যদের সুন্দর মন থেকে মধু সংগ্রহ করে পাঠকের জন্য নিয়ে আসে। (জেমস রাসেল)
আপনার চেতনা,বিবেক,মনন জাগ্রত করার সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম বই,বই পড়া। বইপড়া এক মহৎ গুণ। বই আপনার আত্মার খোরাক জোগাবে। বই আপনাকে সত্য মিথ্যার পার্থক্য বোঝাবে।বই আপনাকে ভালোটা অর্জন এবং খারাপটা বর্জন করতে শেখাবে।
অনেকে বলে যুগে যুগে যত জ্ঞানী, গুণী নিজ মেধার গুনে কীর্তিমান হয়েছেন তাদের মধ্যে বইয়ের জ্ঞান ছিল বিস্তর।
বই মানুষকে সময়নিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ,সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
হাদিসে আছে --"মূর্খের উপাসনা অপেক্ষা জ্ঞানীর নিদ্রা শ্রেয়।”
শেখ সাদী বলেছিলেন --"মূর্খ বন্ধুর চেয়ে জ্ঞানী শত্রু উত্তম।”
---পুরোপুরি যথার্থ।
আবার বলা হয়ে থাকে --"জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র।”
মায়ের পেট থেকে পৃথিবীতে মানুষ নামে ভূমিষ্ট হলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হতে হলে মনুষ্যত্ব থাকতে হয়।আর এই মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয় শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে।শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি মেরুদণ্ডহীন। আর শিক্ষা অর্জনের জন্য চাই বই।
জ্ঞানহীন মানুষ আর পশুতে কোনো পার্থক্য নেই। আর এই জ্ঞান অর্জনে বইয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভেদাভেদ বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক মনোভাব বর্জন করতে শেখায় বই।
বইয়ের জ্ঞান মানুষকে সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করায়।
'বই' মানুষের অন্তরকে জ্ঞানের আলোকবর্তিকায় আলোকিত করে।
সকালের সূর্য যেমন পৃথিবীকে আলোকিত করে। বই তেমনি মানুষের মনোজগতে আলোর স্ফুরণ ঘটায়।
পুষ্পের প্রস্ফুটনে যেমনি চারিদিক মোহমোহ করে এবং সুগন্ধের আকর্ষণে মধুকর,বিহঙ্গকে আকৃষ্ট করে তেমনি বইয়ের জ্ঞানে জ্ঞানী, বিদ্বান ব্যক্তি সকলের প্রিয় হয়।তার ব্যবহার,চালচলন, বিনম্র শ্রদ্ধায় উদ্ভাসিত হয়।
কিন্তু, বই পড়া আর শিক্ষা অর্জন করলেই কি প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায়??
না।যায় না।
কথায় বলে-- "দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।”
আজকাল আমরা দেখি,শুধু আজকাল নয় সৃষ্টির আদি থেকে আজ অবধি,শিক্ষিত মানুষ হয়ে,অনেক বই পড়া ব্যক্তি সমাজের নিন্দনীয় কাজ করছে।পেপার,পত্রিকা, বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল, গনমাধ্যমগুলোতে চোখ দিলেই আমরা প্রত্যক্ষ করি মানুষের অপকর্মের মাত্রা। সবচেয়ে ব্যথিত হই তখন,যখন শুনি কোনো মাদ্রাসার প্রধান তার ছাত্রীকে ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট কাজ করে। খুন করে,গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয় । যখন শুনি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী খুন হয় তার সহপাঠীদের হাতে, বড় ভাইদের হাতে। যখন শুনি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের দ্বারা তার ছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হয়। যখন শুনি বড় অফিসার হয়ে দশতলা ফ্লাটে থাকলেও মায়ের জায়গা হয়না সেই ফ্লাটে।
বড় বড় চেয়ারে বসা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সব উঁচু উঁচু অপরাধ করে। ডাক্তার নামক মহান পেশায় অধিষ্ঠিত হয়ে চরম জালিয়াতি করে। মিথ্যা আশ্বাস আর অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা।
অনেকে গরীবের অর্থ সম্পদ লুটে নিয়ে তাদেরকে পথে বসিয়ে ছাড়ে,মিথ্যা মামলায় ফাসিয়ে জয়ের পিশাচী আনন্দ করে। জ্ঞানকে অপব্যবহার করে আরও যে,কত অন্যায়,অপরাধ, অবিচার, খুন,চাঁদাবাজি, রাহাজানি করে সেগুলো লিখতে গেলে অন্তত কয়েকশ পেজের খাতা ভরে উঠবে।
আমার প্রশ্ন এরাও তো শিক্ষিত,অনেক বই পড়েছে।তবে,কোনধরনের বই যে পড়েছে সেটা ভাববার বিষয়। তাদের এই বই পড়ে শিক্ষা অর্জনে সমাজের কোনো উপকার তো হচ্ছে না উল্টো তারা তাদের শিক্ষাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে পাতিহাঁস থেকে রাতারাতি রাজহাঁস হয়ে যাচ্ছে।
একটা কথা আছে -- "তোমার জীবনে যে শিক্ষা কাজে আসেনি সেই শিক্ষা কাউকে দিও না।”
তাই আমি বলবো শুধু যেকোনো ধরনের বই পড়লেই শিক্ষিত হওয়া যায় না। যদি তাই হতো তাহলে আজ শিক্ষিত মানুষের দ্বারা এসব কুকর্ম সাধিত হতে পারতো না।
সব বই যে শুধু জ্ঞান অর্জনের শক্তিশালী বস্তু--সেটা ভাবলে মস্তবড় ভুল হবে।
কিছু বই আছে যেগুলো পড়লে আপনি শিক্ষিত হবেন কিন্তু সেই ধরনের শিক্ষিত যাতে আপনি সব ধরনের অপরাধ নির্দ্বিধায় করতে পারবেন। অবশ্য এতে বেচারা জড় বইটার দোষ কি! দোষ তো সেইসব পাবলিকেশন্স এবং মূর্খ লেখকদের।বই আপনাকে বিপথে চালিত করতে পারে, বই আপনাকে অবাধ যৌনতার জ্ঞান দান করতে পারে, কিছু কিছু বই আছে যেগুলো আপনার মধ্যে অপসংস্কৃতির বীজ বুনে দেয়। এজন্য তো বইও নিষিদ্ধ হয়।কারাগারে যেতে হয় অনেক লেখককে।(তবে, যারা অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে লিখেছেন তাদের বিষয় অন্য।)
আজকাল দু'কলম লিখতে পারলেই লেখক বনে যায়। এই মূর্খের আবার ইচ্ছা হয় বই ছাপাবে।আবার কিছু কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আছে শুধুমাত্র টাকা কামাতে বইয়ের ভালো, মন্দ বিবেচনা না করে ছাপিয়ে দেয়।যার ফলে আজ পাঠকের চেয়ে লেখকের সংখ্যা বেশি হওয়ার জোগাড়। সেই মূর্খের বই পড়ে আবার অনেকে নিজেকে জ্ঞানী দাবি করে। আর প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি এসব তামাশা দেখে মুচকি হাসে।এ সম্পর্কে বনফুল যথার্থ বলেছেন --
"ছাপাখানার কল্যাণে আজকাল ভাল বই খারাপ বই একইভাবে সজ্জিত হইয়া বাহির হয়। তৃতীয় শ্রেণির পুস্তকও সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করে এবং বিজ্ঞাপনের কৌশলে প্রথম শ্রেণির পুস্তকের পাশে সমগৌরবে স্থান পায়। ”(বনফুল)
আজকাল অনেকে সাহিত্যের অর্থ ভুলে তাকে অপদার্থে পরিণত করেছে। যার জন্য দু'লাইন হাবিজাবি লিখেই মনে করে বাহ্ আমি তো কবি,সাহিত্যিক হয়ে গেছি।অনেকে আবার আহ্লাদে গদোগদো হয়ে,অতিরিক্ত শ্রদ্ধার তেল মেরে,আলগা পিরিত দেখিয়ে বলে--অসাধারণ লিখেছেন ভাইয়া,আপু।
নারীদেহের সৌন্দর্য আর অবাধ যৌনতা সম্পর্কে লিখতে পারলে তো আপনি সুপার হিট।সবাই বাহবা দিয়ে তাকে খ্যাতির এভারেস্টে উঠিয়ে দেবে।
এরা জানে না এদের জন্যই ধর্ষক তৈরি হয়,খোলামেলা সম্পর্ক সমাজে প্রাধান্য পায়।আর যা পড়ে উজ্জীবিত হয়ে মানুষ খারাপ কাজে লিপ্ত হয়।সেই পাপের ভাগীদার সেও প্রায় বিনাকষ্টে হয়ে যায়। পাপ করতেও অনেক কষ্ট করা লাগে।কিন্তু, এরা বিনাকষ্টে শুয়ে বসে পাপের মর্যাদা পায়।
তাই বলি- অন্যকে শুধু বই পড়,বই পড় করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলবেন না।।পারলে দশটা ভালো বই সাজেস্ট করে দিয়ে এগুলো পড়তে উৎসাহিত করে উপকার করেন।ভালো কিছু শিখলে তার সওয়াবের ভাগীদার আপনিও হতে পারবেন।
আর মানুষ শুধু যে পড়ে শিখে এমন কিন্তু না।দেখে,শুনে,বুঝে অন্যকে অনুসরণ করেও পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষিত না হয়েও ভালো কিছু শেখা যায়। অনেক সময় একজন বকলম মানুষের শিক্ষার কাছে ক থেকে ঁ (চন্দ্রবিন্দু) পর্যন্ত শেখা সাহেবও হার মানে।
তাই, সুশিক্ষা অর্জন করার মতো বই পড়ুন, স্বশিক্ষিত হোন।।
আর পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম, সর্বোৎকৃষ্ট বই হলো ধর্মগ্রন্থ।
তাই সবারই উচিত নিজ ধর্মগ্রন্থ খুব ভালোভাবে,অর্থসহ পড়া।নিজের বাপ দাদার গড়া মতবাদ অনুযায়ী না চলে ধর্মগ্রন্থ পড়ে, বুঝে সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করুন। আশা করি আপনি কতটা ভুল আর মূর্খের দুনিয়ায় বাস করেন সেটা বুঝতে পারবেন।।
এই লেখার মধ্যে ভালোকিছু থাকলে গ্রহণ করবেন আর খারাপটা বর্জন করবেন।
এর পর ও যদি বলেন কেনো বই পড়ব,তাহলে আমি বলবো,কে বলছে আপনাকে বই পড়তে?
আর কিছু লিখলাম না।ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।
ধন্যবাদ সবাইকে।