আজ প্রায় পনেরো দিন পর অফিসে ফিরেছে জাহানারা। দাফনের কাজ শেষে ঢাকায় ফিরে আসার পরদিনই জাহানারা হাজির হয়েছিল ম্যানেজার সাহেবের কাছে।
শুকনো গলায় বলেছিল, “স্যার, আমার মা মারা গেছে।”
“ইনাল্লিলাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। কবে ঘটল?”
“গত পরশু রাতে।”
“তিনি আপনার সাথেই থাকতেন?”
“হুঁ।”
“আহারে! মন খারাপ করবেন না। মনোযোগ দিয়ে কাজ করুন, এতেই তার আত্মা শান্তি পাবে।”
“স্যার মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারবো না বলেই তো আপনার কাছে এসেছি। আমার ছুটি লাগবে।”
সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজার সাহেবের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো।
তিনি অস্পষ্ট স্বরে বললেন, “ছুটি লাগবে? কেন?”
“কারণ কাজ করার মতো মানসিক অবস্থায় আমি নেই।”
“কয়দিনের ছুটি চাইছেন?”
“সাত দিনের।”
“দেখুন জাহানারা, আপনি তো জানেন আমাদের কোম্পানির অবস্থা। এরমধ্যে যদি একজন কর্মচারী সাত দিন অনুপস্থিত থাকে, তাহলে যে কী বাজে অবস্থা দাঁড়াবে সেটাও আপনি জানেন। তবুও আপনার দিকটা বিবেচনা করা হবে। সাত দিন না হলেও পাঁচ দিনের ছুটির ব্যবস্থা করছি।”
জাহানারা পাঁচ দিনের ছুটিই পেলে। ছুটি শেষ হয়ে গেল, তবুও অফিসে যাওয়ার প্রতি কোনো প্রকার উৎসাহ খুঁজে পেল না। আজ এতদিন পর হয়তো পেয়েছে। তাইতো সকাল-সকাল সেজেগুজে অফিসে হাজির সে।
নিজের কেবিনে ঢুকেই দেখতে পেল, অর্থ গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছে। তবে তার চোখ-মুখ হাসিখুশি।
জাহানারাকে দেখে স্বাভাবিক গলায় বলল, “কেমন আছো জাহানারা?”
কী নির্বিকার ভঙ্গিতেই না মানুষটা ‘তুমি’ করে ডাকছে তাকে। জাহানারা কেন যে আগে, তুমি করে ডাকতে বলেননি, কে জানে!
জাহানারা বলল, “এইতো! আপনি?”
“ভালো আছি।”
মজার ব্যাপার হলো, অর্থ জাহানারাকে তুমি করে ডাকলেও জাহানারা এখনো সেই আপনিতেই পড়ে আছে। তবে সে ঠিক করে রেখেছে, ভালো একটা দিন দেখে ভুলের অজুহাতে ‘তুমি’ করে ডাকবে তাকে।
এর ঠিক পরপরই বলবে, “স্যরি, ভুলে তুমি করে ডেকে ফেললাম।”
এই কথা শুনে অর্থ নিশ্চয়ই বলবে, “কোনো অসুবিধা নেই। এখন থেকে আমাকে তুমি করেই ডাকবে।”
জাহানারা গিয়ে বসলো নিজের ডেস্কে। যে ডেস্ক সবসময় ফাইলপত্রে বোঝাই থাকে, সেই ডেস্ক আজ ফাঁকা। অবশ্য এতে তেমন অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই।
এই ক’টা দিনের মধ্যেই বেশ অনেকগুলো পরিবর্তন এসেছে কেবিনটাতে। ছোট ছোট সেই পরিবর্তনগুলো চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনি জাহানারার। নতুন পর্দা টানানো হয়েছে। আগের পর্দাগুলোর রং ছিল হালকা খয়েরি। তবে নতুন এই পর্দার রং কটকটে লাল। বিশ্রী একটা ব্যাপার! যে এই রংয়ের পর্দা কিনেছে, তার রুচি অত্যন্ত খারাপ।
স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, কেবিনে নতুন ফ্যান লাগানো হয়েছে। সেই কচ্ছপের গতিতে ঘোরা ফ্যানের জায়গায়, এখন এসেছে ঘূর্ণিঝড়ের গতিতে ঘোরা ফ্যান।
জাহানারা নিচু গলায় বলল, “আপনার বাবা-মা ফিরে এসেছে?”
“না! সত্যি সত্যিই সারা জীবনের জন্য গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে।”
“একা একাই আছেন তাহলে?”
“হুঁ। আমি যে একা একা আছি এ নিয়ে অবশ্য তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।”
“কেন?”
“বাবা আমাকে রেখে গেছে বাড়ির পাহারাদার হিসেবে। পাহারাদারের কাজটা মোটামুটি ভালোই করছি। আর কী লাগে!”
জাহানারা হাসল। অর্থ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। আজ বহুদিন পর মেয়েটাকে হাসতে দেখছে সে।
“তোমার মামা ঢাকায় ফিরে এসেছে?”
“জানি না। তার সঙ্গে আর কথা হয়নি।”
“ও।”
“অর্থ?”
“হুঁ?”
“কাজকর্মের কী অবস্থা?”
“ভালো অবস্থা।”
“আমি এতদিন না আসায় আপনাদের কাজের চাপ করে বেড়ে গেছে না?”
“না, না।”
“আসলে আমি এতদিন অফিসে এসে কাজ করার মতো মানসিক বল পাচ্ছিলাম না। শরীরের অসুস্থতাকেই আমরা শুধু বড়ো করে দেখি। মনের অসুখ কি কোনো অসুখ নয় বলুন?”
“অবশ্যই অসুখ। তুমি ঠিক কাজ করেছ জাহানারা।”
“একেবারেই যে ঠিক কাজ করেছি, তা কিন্তু না। এতগুলো দিন অফিস কামাই দিয়ে বাসায় বসে থাকাও ঠিক না।”
“ঠিক একই কথাটা ম্যানেজার সাহেবও বলেছেন।”
জাহানারা অবাক গলায় বলল, “তাই না-কি?”
“হুঁ।”
“আমি কি একবার গিয়ে ম্যানেজার স্যারের সাথে দেখা করে আসবো?”
“যেতে পারো। তবে আগেভাগেই বলে রাখি, তিনি কিন্তু তোমার ওপর বেশ ক্ষেপে আছেন।”
জাহানারা আবারও বলল, “তাই না-কি?”
“হুঁ।”
জাহানারা অসহায় গলায় বলল, “তাহলে আমি এখন কী করবো?”
“স্যারের কাছে গিয়ে নিজের সব ভুল স্বীকার করে নাও। সাহসী গলায় বলবে, স্যার আমি অন্যায় করেছি! আমাকে ক্ষমা করে দিন। পারবে না বলতে?”
“ঠাট্টা করছেন?”
“ঠাট্টা করছি না বরং ঠাট্টাচ্ছলে সৎ পরামর্শ দিচ্ছি।”
“তাই করবো তাহলে?”
“অবশ্যই করবে!”
জাহানারা মনে সাহস সঞ্চয় করে রওনা দিলো ম্যানেজার সাহেবের কেবিনের দিকে। যাওয়ার পথে হঠাৎ মনে হল, অফিসের সব লোকজন করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
জাহানারাকে কেবিনে ঢুকতে দেখে ম্যানেজার সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, “বসুন জাহানারা।”
জাহানারা বসতে বসতে বলল, “স্যার আমি...”
তাকে থামিয়ে দিয়ে ম্যানেজার সাহেব বললেন, “জাহানারা আপনার ছুটি শেষ হয়েছে কত তারিখে?”
“সাত তারিখে।”
“আর আজ কত তারিখ?”
“আঠারো। স্যার আমার ভুল হয়ে গেছে।”
“এমন ভুল এর আগেও আপনি করছেন। মনে করে দেখুন তো!”
“আর এমন ভুল হবে না স্যার।”
“সেই সুযোগ আপনাকে আর দেওয়া হচ্ছে না। এর আগেও যখন এমন ভুল হয়েছিল তখন আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া হয়েছে।”
“কী বলতে চাইছেন আপনি?”
“দেখুন কোম্পানির কিছু নিয়ম-কানুন আছে। আমরা সবাই সেই নিয়ম-কানুনে বাঁধা। আপনিও বাঁধা, আমিও বাঁধা। সেই নিয়ম বলে কোন কর্মচারী যদি কারণ না জানিয়ে সাত দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে...”
“তাহলে তাকে ছাঁটাই করা হয়। তাইতো?”
“হ্যাঁ তাই।”
জাহানের গায়ের উপর দিয়ে প্রবল স্রোত বয়ে গেল। মনটা যেন বড়োসড়ো ধাক্কার মতো খেল। দৌঁড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এখান থেকে। কেন যে সে উপায়টা নেই!
ম্যানেজার সাহেব পরিষ্কার গলায় বললেন, “আপনার জায়গাটা নিতে পারে এমন ক্যান্ডিডেটদের ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু হয়ে গেছে।”
জাহানারা চুপ করে রইলো।
মেজর সাহেব সাদা রঙের একটা খাম তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এটা ধরুন।”
“কী এটা?”
“টার্মিনেশন লেটার। পুরো চিঠিতে মনোযোগ দিয়ে পড়ে, সাইন করে আমার কাছে দিয়ে যাবেন।”
“কখন দিতে হবে?”
“আজকের মধ্যে দিতে পারলে ভালো হয়। তবে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। আপনি চাইলে এটাকে সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন।”
জাহানারা উঠে দাঁড়ালো। কী একটা লজ্জার বিষয়! অফিসের সবার চাকরি আছে। এমনকি পিয়ন মতিন মিয়ারও আছে। অথচ তার নেই। আচ্ছা অফিসের কেউ কি এ ব্যাপারে জানে? না জানলেও নিশ্চয়ই আজকের মধ্যে জেনে যাবে।
চাকরি চলে যাওয়া, ব্যাপারটার সঙ্গে দুঃখ, ভয়, আতঙ্ক, আনন্দ - সব ধরনের অনুভূতিই জড়িয়ে আছে। চেনা-পরিচিত অফিসটাতে এখন থেকে আর আসতে হবে না, এই ভেবে দুঃখ হচ্ছে। আবার সামনের দিনগুলোতে জাহানারা চলবে কী করে, এ নিয়ে কাজ করছে ভয় ও আতঙ্ক। আবার, বিরক্তিকর এই ম্যানেজার সাহেবের চেহারা প্রতিদিন দেখতে হবে না, নিয়ম করে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে না, এই ভেবে হচ্ছে আনন্দ।
টার্মিনেশন লেটার হাতে কেবিনে ফিরে গেল জাহানারা। নিজের ডেস্কে না গিয়ে, অর্থের ডেস্কের দিকে পা বাড়ালো।
তার মুখোমুখি থাকা চেয়ারটাতে বসতে বসতে বলল, “চাকরিটা আর নেই অর্থ।”
অর্থ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “মানে?”
“ম্যানেজার স্যার এটা ধরিয়ে দিলেন। টার্মিনেশন লেটার। আমার চাকরি চলে গেছে।”
“কী বলছো এসব? কেন?”
“পাঁচ দিনের জায়গায় পনেরো দিন করেছি তো, তাই। এগুলো না-কি, কোম্পানির নিয়মের বিরুদ্ধে।”
“উনি বললেন, তার তুমি বিশ্বাস করে নিলে।”
জাহানারা কিছুটা হেসে বলল, “কী আর করা?”
“অবশ্যই করার আছে! আমরা সিইওর কাছে যাবো! কোন কারণ ছাড়া একটা মানুষের চাকরি চলে যাবে?”
“অর্থ, ব্যস্ত হবেন না প্লিজ! এমনিতেই চাকরি করা নিয়ে মনের দিক থেকে কোনো সায় পাচ্ছিলাম না। চলে গিয়ে ভালোই হয়েছে।”
“এই কথাগুলো অভিমান থেকে বলছো তুমি। তাই না?”
“না, আমার কোনো অভিমান নেই। আপনি চিঠিটা পড়ে আমাকে সারমর্ম বলুন তো! আমার আবার এখন পড়তে-টড়তে ইচ্ছে করছে না।”
অর্থ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে জাহানারার দিকে। কঠিন পরিস্থিতিতে জাহানের মন ভেঙে পড়ে, তবুও নিজেকে সামলে রাখতে হাজার চেষ্টা তার। কেন যে এই চেষ্টা করে কে জানে!
(চলবে)