উনার সাথে যখন বিয়ে হয়, তখন আমার বয়স ১৪। যখন আমার কাছে বিয়ে মানে আনন্দ উৎসব ছাড়া কিছইু না। যখন আমি ‘বিয়ে’ মানে কেবল দুইটা অক্ষরকে বুঝি। গ্রামের মেঠো পথে ধরে দুই বেনী ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় যখন আমার।
আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই সেদিনও গ্রামের হাইস্কুলের দৈনন্দিন পাঠ্যকার্য শেষ করে বাড়ি ফিরি। মা তখন বারান্দায় ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে খোলা বারান্দায় বসে মুড়ি চিবুচ্ছেন। আমাকে দেখে চোখ মুখ শক্ত করে বললেন,
‘মহারাণীর কলেজ শেষ হইলো তাইলে। এহন কি কাজে হাত দেওন যায়?’
মন খারাপের রেশ নিয়েও খানিক হেসে স্কুলের কাপড় ছাড়তে গেলাম। বুক চিরে বেরিয়ে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ভাবলাম, নিজের মা টা থাকলে হয়তো আমিও তাদের পাতে ভাগ বসাতে পারতাম। কিন্তু সত্যি বলতে আমার প্রতিদিনের রুটিনে পরিবারের সাথে আনন্দ করার কোনো জায়গা নেই।
আব্বা আসার আগে কাজকর্ম শেষ করে পড়ায় বসতে হবে। তাই জলদি ঘর ঝাঁট দিয়ে রান্না বসাতে যাই। কথায় আছে, তাড়াতাড়ি করা শয়তানের কাজ। শয়তানের কাজ করতে গিয়ে বড়সড় একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলি। রান্নার জন্য ডিম সিদ্ধ করতে গিয়ে হাত থেকে ফেলে সবগুলো ডিম ভেঙে ফেলি।
তড়িৎ গতিতে মা এসে ধুমধাম পিঠে কিল বসালেন। গাল মুচড়ে টেনে ধরে বললেন,
‘অলক্ষ্মী রাক্ষুসী মাইয়া! নিজের মায়রে তো খাইলি। এহন আমার ঘরের নষ্ট করতেছস? বের হো বাড়ি থিক্কা।’
সৎ মা সেদিন মেরে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেন। মন খারাপ করে গ্রামের বড় রাস্তায় হাঁটতে থাকি, আব্বা কাজ থেকে না আসা পর্যন্ত বাড়িতে আমার জায়গা হবে না এই ভেবে। কিন্তু সৎ মায়ের হাতে মার খেয়ে আমার অবস্থা কাহিল। সর্ষে ফুল দেখছিলাম চোখে। শুধু সর্ষে ফুলই না, মনে হচ্ছিল সামনে হয়তো সাদা রঙের কোনো গাড়িও ছিল। অস্পষ্ট চোখে গাড়িটা কে সামনে দেখতেই পড়ে যাই মাথা ঘুরে।
যখন আমি চোখ খুলি তখন আমার সামনের পরিবেশ বদলে গেছে। চোখ মেলার পর মনে হলো আমি বুঝি কোনো রূপকথার দেশে চলে এসেছি। সামনের সুদর্শন যুবক টা বুঝি এই দেশের রাজপুত্র। কিন্তু রাজপুত্ররা কি চোখে চশমা লাগায়?
বিষয়টা বুঝার জন্য হাতে ভর দিয়ে শোয়া থেকে উঠার চেষ্টা করতেই রাজপুত্র টা খপ করে আমাকে ধরে ফেলে। আমি ভীত চোখে তাকাতেই সে মুচকি হেসে বলল,
‘ঘাবড়াবে না মেয়ে। আমি এখানকার হাসপাতাল পরিদর্শনে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার গাড়ির সাথে ধাক্কা খেলে।’
আমি চোখ বুলিয়ে চারপাশটা দেখে পূর্বের মতোই চোখে ভয় নিয়ে তাঁর দিকে তাকাই। এবার সে শব্দ করে হেসে ফেলে। সম্মোহন করার মতো গলায় বলে,
‘ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এটা সরকারি গেস্ট হাউস। পুলিশ কেস হয়ে যাবে বলে এখানে নিয়ে এসেছি। যদিও খুব একটা ব্যাথা পাও নি। পায়ে সামান্য চোট লেগেছে। কিন্তু শরীরে অনেক আঘাতের দাগ। এর জন্য আমি ফেঁসে যেতাম। তাই এখানে আনতে হলো।’
এইটুকু বলে সে আমাকে ছেড়ে দূরে সরে যায়। আমি ড্যাবড্যাব করে তাকাই উনার দিকে। কি সুন্দর কথা বলার ধরণ উনার! ডাক্তার না হয়ে নায়ক হলে উনি নিশ্চয়ই খুব সহজেই মহানায়ক পদবী পেয়ে যেতন।
‘বাই দ্য ওয়ে তোমার নাম কি?’
‘জি দুলী।’
উনি ভ্রু কুঁচকালেন। চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললেন,
‘দুলী? এমন আবার নাম হয় নাকি?’
‘না হইলে আমার নাম রাখছে ক্যান আব্বায়?’
‘হা হা। আচ্ছা বলো তোমার বাড়ি কোথায়? পৌঁছে দিয়ে আসি।’
‘আমি একা যেতে পারব।’
‘পারবে না। কারণ এখন রাত হয়ে গেছে।’
উনার কথায় আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। বলে কি! রাত হয়ে গেছে! আমি তড়িঘড়ি করে উঠতে গেলে উনি আবার আমাকে ধরে ফেলেন। ধমকে বলেন,
‘তোমার গায়ে জ্বর। আমি ওষুধ দিয়েছি। চুপটি করে শুয়ে থাকো। জ্বর কমলেই তোমাকে দিয়ে আসবো। আর আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।’
উনি চলে গেলেন। আমি আর চোখ খুলে রাখতে পারলাম না। খুব জ্বলছিল। সম্ভবত জ্বরের কারণেই। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল। চোখ দুটো আবারো আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়।
পরের বার যখন চোখ খুলি তখন শুধু আমার আশেপাশের পরিবেশই না, সম্পূর্ণ জীবনটাই বদলে গিয়েছিল। সেদিনের পুরো রাতটাই আমি উনার সাথে এক ছাদের নিচে একা একটা বাড়িতে কাটিয়ে দেই। আর অজপাড়া গাঁয়ে এ-ই ঘটনার ভয়াবহতা নিদারুণ অপমান, লাঞ্চণার। সেই লাঞ্চণা থেকে আমাকে বাঁচাতে এবং অপমান থেকে নিজে বাঁচতে আমাকে বিয়ে করেন।
হ্যাঁ, অনেকটা নাটকীয় ভাবেই উনার সাথে আমার বিয়েটা হয়। উনার সাথে ঢাকা আসার সময় একটা কথাও উনি বলেননি। বিশাল একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামলে মুখ খুলেন। বলেন,
‘শোনো দুলী! আজ থেকে তোমার নাম কায়নাত। এই ধরনের নাম এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। বুঝছো?’
আমি মাথা দুলাই। মনে তখন খুশির জোয়ার। তার মানে উনি আমায় মেনে নিবেন। উনার মতো গড়ে তুলতে চাইছেন। ইশশ! এমন একটা রাজপুত্তুরের মতো ছেলে আমার বর। লজ্জায়, খুশিতে আমার অবস্থা মরি মরি। কিন্তু সেই অবস্থা টা টিকেনি বেশিক্ষণ। দরজা খোলার পর একজন পৌঢ়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
‘এই মেয়েটা কে প্রণব?’
উনি তখন মুখ কুঁচকে উত্তর দেন,
‘গ্রাম থেকে এসেছে মা। কাজের খোঁজে। এই বয়সে তো কোনো কাজ পাবে না। তাই বাড়িতে নিয়ে এসেছি।’
ছলছলা চোখে উনার দিকে তাকালেও বলিনি কিছুই। শ্বশুর বাড়িতে কাজের মেয়ের পরিচয়ে জায়গা হয়।
.
.