কথাটা শুনেই হকচকিয়ে গেলো।
তন্ময় আর চারু একি ব্যাচের, ক্লাসমেট। মোবাইলে স্ট্যাটাস দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলো তন্ময়। কিন্তু হঠাৎ জ্যামে আটকে থাকা, রিক্সায় তারই পাশের বসে থাকা চারুর মুখে এইরকম একটা কথা শোনার প্রস্তুতি তার মোটেও ছিলোনা।
তন্ময় চারুকে বললো, তোর মাথা ঠিক আছে?
চারু ফুটফাতে বসা এক পাগল মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে..
মহিলাটার অবস্থা বিভৎস্য। চুলগুলো বয়কাট করা সাইজহীনভাবে, হয়তো চুরির দায়ে কোথাও ফেঁসে গিয়ে চুলের বিসর্জন দিয়েছিলো..
মুখের মধ্যে যে কোনো একসময় নিদারুণ সৌন্দর্যতার ছাপ ছিলো তার রেশ কিন্তু এখনো কাটেনি। ফর্সা মুখে এখন ছোপ ছোপ কালো দাগে ভর্তি, চোখের নিচে কালিমা, ঠোঁটের রঙে হালকা কালচে ভাব এসেছে.. তবে এখনো কিছু গোলাপী রেশ বিদ্যমান রয়েই গেছে। কি আর করা? আল্লাহর দান এভাবেতো ঘষে মেজে ছাপ করে দেওয়া যায়না, তাইনা?
নোংরা কাপড়- চোপড় জড়ানো ঐ মহিলার গায়ের কাপড়-চোপড়ের বিবরণ দেওয়াও টাফ। কোনোভাবে এক টুকরো কাপড় পেয়ে সেটাকে মাথায় জড়িয়ে রাখলেও কানকে পুরো ডাকতে পারেনি, ব্যর্থ ঘোমটা দেওয়ার প্রচেষ্টা বলা যায়..এই শীতে কি দিয়ে কান ডাকবে বেচারি? আমাদের সভ্য সমাজে কি তাদের জন্য কাপড় -চোপড়ের হাট আছে?
সালোয়ারটা হাঁটুর একটু নিচে, পিছনে-সামনে আছে হালকা হালকা ছোপ ছোপ দাগ.. দাগগুলো লাল, কালো আরো নানান বাহারি রঙের মিশ্রণ। বেশিরভাগ অংশই ছেঁড়া.. পোকামাকড়ের খেয়ে ফেলা অংশ চোখে পড়ছে। বিচ্ছিরি, নোংরা সেই জামা-কাপড়ের দিকে তাকালে হয়তো ধনীদের আদরের দুলালীদের একবেলা খাবার হবেনা ঘৃণায়।
তন্ময় বিরক্তি নিয়ে বললো,
" রাস্তায় একজন পাগল মহিলাকে নিয়েও তোর গবেষণার শেষ নাই। এগুলো কিন্তু বাড়াবাড়ি চারু। বিরক্তিকর। "
চারু মোবাইল বের করলো। বের করে সবার আড়ালে বেশ গোপণীয়তা রক্ষা করেই মহিলাটির ছবি তুললো, যুম করে।
তন্ময় অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে!
তান্ময়ের মায়ের কড়া নিষেধ আছে চারুর সাথে না মেশার। কিন্তু এত দিনের বন্ধুত্ব এভাবে খোয়াতে চায়না তন্ময়। যদিও তান্ময়ের মনে মনে চারুর এসব পাগলামি বেশ ভালো লাগে। সে সর্বদা চারুকে মনে মনে সাহায্য করে যায়..
তন্ময় জিজ্ঞেস করলো,
- ছবি তুললি কেন? ফেবুতে ট্রল করবি? আবার দরদ দেখাস ক্যাঁন?
চারু কেমন তা খুব ভালো করেই জানে তন্ময়। তাও এভাবে কথা বলে সে.. কারন সে চায় চারুই তাকে ছেড়ে চলে যাক।
কিন্তু দুবছর যাবৎ কেউই যায়নি কাউকে ছেড়ে।
চারুর সংস্পর্শে আসলেই তন্ময়ের অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে.. কেন তা জানা নেই তন্ময়ের।
মাঝে মাঝে বইয়ের মধ্যে মুখ লুকিয়ে তন্ময় ভাবে,
" চারুর ও কি আমার মতই ফিলিংস হয়? "
___________
ক্লাস শেষে প্রতিদিন চারু কোথাও চলে যাচ্ছে তন্ময়কে না বলে। অথচ দুজন রোজ একসাথে যাওয়া আসা করে ক্লাসে। চারু ইদানিং টিফিনও খায়না। অথচ প্রতিদিন তারা একসাথে খেত। শপিং ও করেনা আজকাল। দশটা বুক লিস্টের মধ্যে ওর পাঁচটা তন্ময়ের পাঁচটা কিনার কথা কিন্তু চারু একটা কিনে ঐটাই পড়ছে। জিজ্ঞেস করলে বলে,
-আগে এইটা মাথায় নিয়ে নেই।
রিক্সায় ও উঠেনা। তন্ময় একা একা যেতে পারবেনা তাই সেও উঠেনা কিন্তু এতদূর হেঁটে গিয়ে ওর পায়ের অবস্থা ঠিক না থাকলেও মনের অবস্থা কিন্তু ভালোই থাকে। চারুর সংস্পর্শে অনেকক্ষন থাকা যায়, অনেক বিষাক্ত আর অদ্ভুত কথাও জানা যায়..
একদিন ফলো করে দেখে চারু সেই নোংরা মহিলার পাশে ফুটফাতে বসে আছে।
কি সব যেন আলোচনা হচ্ছে..
চারুর এই অবস্থা দেখে তন্ময় রেগে যায়।
তন্ময়ের মাও প্রমিস করিয়ে নেয় তাকে,
যাতে চারুর সাথে কোনোদিন না মেশে।
কারন উনি বুঝতে পারতেছিলেন,
তন্ময়ের দূর্বলতা আছে চারুর প্রতি।
চারুর বাবা নিম্ন আয়ের মানুষ, সামান্য একটা এন.জি.ও-তে চাকরী করে।
তাইজন্যই বিশেষ করে চারুকে পছন্দ করেনা তন্ময়ের মা।
তন্ময়ের একদিকে রাগ,অভিমান অন্যদিকে মায়ের কড়া নিষেধাজ্ঞা..
ক্লাসে চারু ওর পাশে এসে বসলেও কথা বলেনা সে। চারু নিজে আগ বাড়িয়ে কোনোদিন কারো সাথে কথা বলেনা। তাই তন্ময়ের সাথেও মাস দেড়েক এভাবে কথা না বলেই কাটিয়ে দিলো।
কোনোদিন এক বারের জন্যও জানতে চায়নি চারু যে তন্ময়ের কি হলো বা কিসের জন্য এই দুরুত্ব।
অথচ তন্ময় কিন্তু কোনোভাবেই ভালো ছিলোনা এই দীর্ঘসময়ে। এমন কোনো রাত যায়নি যে রাতে ও চোখের জল বিসর্জন না দিয়ে ঘুমিয়েছে।
তন্ময় জানে না কেন বা কিসের জন্য এই কান্না।
চারুর প্রতিটা স্টেপ চুপি চুপি ফলো করতো তন্ময়।
এবং মাস দেড়েক যাবৎ-ই চারুকে সে একটা বস্তির ঘরে, সপ্তাহে দুবার প্যাকেট হাতে নিয়ে এবং সাজগোজ করে যেতে দেখেছে..
আর ফুটফাতের ঐ মহিলাকেও সে আর দেখেনা ঐ জায়াগাতে। এখন অন্য একজন বসেছে ঐ জায়গায়।
চারুও ঐ পথ দিয়ে আর যায়না..
চারু বস্তিতে প্রতি সপ্তাহে এই দুদিন গিয়ে কি করে?
কোনো খারাপ কাজের সাথে যুক্ত হয়ে যায়নি তো?
ভাবছে তন্ময়..
চলবে?(আপনাদের ভালো লাগা না লাগা সব মতামতের ভিত্তিতেই পরবর্তী পর্ব পোস্ট করা হবে, ইনশাল্লাহ্। ধন্যবাদ।)
#কলঙ্ক