আমার আর শ্রাবণীর বিয়ের ঠিক ৪দিন পর খেয়াল করি আমাদের বাসার কাজের মেয়েটা আর আসছে না। আমি তখন মাকে বলি,
-- মা, শেফালী অসুস্থ নাকি? দুইদিন ধরে ওকে দেখছি না
মা উত্তর দিলো,
- কাজের মেয়ের আর দরকার নেই। শুধু শুধু মাস গেলে এতগুলো টাকা দিতে হয়। তাছাড়া এখন তো বউমা আছে।
আমি আর মাকে কিছু বলি নি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে শুধু ভাবতে লাগলাম, আমার বিয়ের পর মা কাজের মেয়ে বিদায় করে দিলো অথচ আমার ছোট বোনকে বিয়ে দেওয়ার সময় উপহার সামগ্রীর সাথে সাথে একটা কাজের মেয়েও দিয়েছিলো।
এইসব কথা যখন ভাবছিলাম তখন শ্রাবণী আমার পিছনে দাঁড়িয়ে বললো,
- তোমায় একটা কথা বলবো?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
-- হুম, বলো
শ্রাবণী তখন মাথা নিচু করে বললো,
- আমার একজোড়া স্যান্ডেল লাগবে। হিল জুতা পরে চলাচল করতে সমস্যা হচ্ছে।
শ্রাবণীর মুখ থেকে কথাটা শুনার পর নিজের খুব লজ্জা লাগছিলো। আমার বউ ৪দিন ধরে হিল জুতা পরে চলাচল করছে আর আমি সেটা খেয়াল করি নি। আমার উচিত ছিলো বিষয়টা খেয়াল করা। আমি তখন শ্রাবণীকে বললাম,
--ঠিক আছে আজকে আমি এনে দিবো।
সন্ধ্যার পর বাসায় যখন ফিরি তখন শ্রাবণীর জন্য একজোড়া স্যান্ডেল কিনে আনি। কাগজে মুড়ানো স্যান্ডেলগুলো নিয়ে যখন বাসায় ঢুকি তখন খেয়াল করি মা পাশের বাসার আন্টির সাথে কথা বলছে। মা আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
- কিরে, তোর হাতে কি এটা?
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই পাশের বসার আন্টি ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলতে লাগলো,
~কি আর আনবে, বউয়ের জন্য নিশ্চয়ই লুকিয়ে সন্দেশ মিঠাই এনেছে। এখন জামাই বউ মিলে দরজা বন্ধ করে খাবে। মাকে দেওয়ার কথা মনেও করবে না।
আমি কাগজটা সরিয়ে আন্টিকে বললাম,
--বউয়ের জন্য ৬৫ টাকা দিয়ে একজোড়া বাটা স্যান্ডেল এনেছিলাম। এখন আপনার কাছে যদি এটা সন্দেশ মিঠাই মনে হয় তাহলে চায়ের সাথে বসে বসে এটাও খেতে পারেন।
এইকথা বলে আন্টির কোলের উপর স্যান্ডেলজোড়া রেখে রুমের ভিতর ঢুকলাম। তারপর শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললাম,
--আন্টি যদি স্যান্ডেলগুলো না খায় তাহলে আন্টি চলে গেলে স্যান্ডেলগুলো পায়ে লাগিয়ে দেখো ঠিকঠাক মত হয় কিনা
শ্রাবণী চাপা হাসি হেসে বললো,
-ঠিক আছে।
হাসিটা চেপে রাখার জন্য শ্রাবণীর কপালের রগটা নীল হয়ে গিয়েছিলো। আমি মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখে ভাবছিলাম, একটা মেয়ে এতটা সুন্দর হয় কি করে...
---
----
ছোট বোনের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য আমি ৩ কেজি মিষ্টি নিয়েছিলাম বলে মা রাগে বলেছিলো,
"৩ কেজি মিষ্ট নিয়ে গেলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার মেয়েকে নানা রকম কথা শুনাবে "
তাই আমি সেদিন ৬ কেজি মিষ্টি ২কেজি দই আর ১ কেজি রসমলাই নিয়ে গিয়েছিলাম। অথচ আজ আমি যখন শ্রাবণীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবো তখন মা বললো,
- শ্বশুরবাড়ি এতকিছু নিবার দরকার নেই। দুইকেজি মিষ্টি আধা কেজি আধা কেজি করে ৪টা প্যাকেটে নিয়ে গেলেই হবে।
আমি মার কথা শুনে কোন উত্তর দেই নি শুধু একটু মুচকি হেসেছিলাম আর শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে দেখি ও ওর চোখের জলটা লুকানোর চেষ্টা করছে।
বাসের মধ্যে শ্রাবণী আমার সাথে একটা কাথাও বলেনি। শুধু বাসের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিলো। বাস থেকে নেমে যখন রিকশায় উঠলাম তখন শ্রাবণীকে বললাম,
-- তোমাদের এইখানে ভালো মিষ্টি কোথায় পাওয়া যায়?
শ্রাবণী তখন আমায় বললো,
- পিয়াস, তুমি আমাদের বাসায় শূন্য হাতে গেলেও তোমার যত্নের এতখানি কমতি হবে না।
আমি তখন শ্রাবণীর হাতটা শক্তকরে ধরে মুচকি হেসে বললাম,
-- পাগলি...
দুইরাত শ্বশুরবাড়ি থাকার পর ৩দিনের দিন যখন শ্রাবণীকে নিয়ে বাসায় ফিরি তখন মা দরজা খুলে প্রথম কথাটা বলেছিলো,
- শ্বশুর শ্বাশুড়ির আদর যত্ন পেয়ে মাকে তো ভুলেই গেলি। তা শ্বশুর শ্বাশুড়ি তোর কানে কি কি মন্ত্র শিখিয়ে দিলো?
আমি তখন ক্লান্ত চোখে মার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-- মা, অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছি। তোমার সাথে পরে কথা বলছি...
খাবার টেবিলে বসে মা শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললো,
- বউমা, তোমায় না বলেছিলাম শুটকি আলু দিয়ে রান্না করতে। তুমি তা না করে বেগুন দিয়ে রান্না করলে কেন?
শ্রাবণী তখন বললো,
- মা, আমাদের এইখানে শুটকি বেগুন দিয়ে হালকা ঝুল করে রান্না করে। আপনি একবার খেয়ে দেখেন ভালো লাগবে
মা তখন হেসে দিয়ে বললো,
-এখনি শ্বাশুড়ির কথা না শুনে নিজের মত কাজ করা শুরু করেছো। বাকিদিন তো পরেই আছে।
মা'র খোচা দেওয়া কথাটা শ্রাবণী ঠিকিই বুঝতে পেরেছিলো তাই ও মাথা নিচু করে বললো,
- পরের বার এমন ভুল হবে না মা...
---
-----
শ্বাশুড়ির সাথে ঝগড়া করার পর ১৩ দিন ধরে ছোট বোন মালিহা আমাদের বাসায়। অবশ্য সায়েম( মালিহার স্বামী) দুইবার এসেছিলো মালিহাকে নিতে কিন্তু মা সায়েমকে সরাসরি বলেছে মালিহাকে দিবে না। যদি সায়েম আলাদা ফ্ল্যাট নেয় তবেই মালিহাকে যেতে দিবে। শ্বাশুড়ির হুকুম মেনে তার মেয়ে চলতে পারবে না।
আজকে আবারও সায়েম এসেছে। ড্রয়িংরুমে বসে সায়েম মাকে বললো, সে আলাদা ফ্ল্যাট নিয়েছে। এখন সে মালিহাকে নিয়ে আলাদাভাবেই থাকবে। আড়াল থেকে কথাগুলো শুনে আমি ড্রয়িংরুমে গেলাম। সায়েমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
-- যাক, অবশেষে তোমার সুবুদ্ধি উদয় হলো।
মা'র চোখে মুখে তখন ঈদের খুশি। মা হাসতে হাসতে বললো,
- যাক বাবা, এইবার আমি চিন্তামুক্ত। মেয়েকে নিয়ে আমার আর চিন্তা হবে না। আরে এটা কি আশির দশক নাকি, যে শ্বশুর শ্বাশুড়ি সবাইকে সাথে নিয়ে একসাথে সংসার করতে হবে? এটা ২০২০ সাল। এইযুগের মেয়েরা সবসময় চায় নিজের মত করে সংসারটা সাজাতে। আজকাল শ্বশুর শ্বাশুড়ির হুকুম মত চলার দিন আছে নাকি?
এমন সময় শ্রাবণী নাস্তা নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকলো। আমি তখন শ্রাবণীকে বললাম,
-- যাও, তাড়াতাড়ি কাপড় চোপড় গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে যাও
শ্রাবণী অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
- মানে!
আমি তখন কিছুটা রাগ দেখিয়ে বললাম,
-- মানেটা হলো তুমি এখন বাপের বাড়ি যাবে। আর আমি যখন তোমায় নিয়ে আসতে যাবো তখন তুমি সোজা বলে দিবে আলাদা ফ্ল্যাট নিলে তবেই তুমি আমার সাথে আসবে তার আগে আসবে না। আরে তুমি এই যুগের মেয়ে। তোমারও তো ইচ্ছে হয় স্বামীকে নিয়ে আলাদা ভাবে থেকে সংসারটাকে নিজের মত গোছাতে। আজকাল শ্বাশুড়ির হুকুম মত চলার দিন আছে নাকি?
শ্রাবণী তখন কেঁদে দিয়ে বললো,
-পিয়াস! প্লিজ
আমি তখন ওরে জোরে ধমক দিয়ে বললাম,
--যা বলছি তাই করো গিয়ে।
শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতে অন্যরুমে চলে গেলো। মা ছোট বোন আর ছোট বোনের স্বামী সবাই আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। আমি তখন মাকে বললাম,
--বিয়ের আগে যদি আমার বাসায় কাজের মেয়ে রাখতে পারি তাহলে বিয়ের পর কেন আমি কাজের মেয়ে রাখতে পারবো না? তুমি তো বিয়ে করিয়ে ছেলের বউ এনেছো কাজের মেয়ে তো আনো নি।
আমি যদি ছোট বোনের বাসায় ৩ কেজি মিষ্টি নিয়ে যায় তাহলে সবাই ছোটবোনকে কথা শুনাবে। আর আমি যদি শ্বশুর বাড়ি ২কেজি মিষ্টি নিয়ে যায় তখন কি শ্রাবণীকে ওর বাড়ির লোক কথা শুনাবে না?
নিজের মেয়ে শ্বাশুড়ির হুকুম মত চলতে পারবে না অথচ প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ছেলের বউ তোমায় জিজ্ঞেস করে, মা আজ রুই মাছ কি দিয়ে রান্না করবো।
আচ্ছা মা তোমাদের শ্বাশুড়িদের সমস্যাটা কি? তোমরা কেন ছেলের বউকে নিজের মেয়ের মত দেখতে পারো না। আজকাল যে ছেলেরা বাবা মার থেকে আলাদা হয়ে যায় এতে কি শুধু ছেলের বউয়ের শুধু দোষ থাকে? শ্বশুর শ্বাশুড়ির কি কোন দোষ থাকে না?
মা আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে চুপচাপ শুধু শুনলো। আমি তখন সায়েমের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-- তোমায় আমি ভালো ছেলে ভাবতাম। আমি যদি জানতাম তুমি মেরুদণ্ডহীন তাহলে কখনোই তোমার কাছে নিজের বোনের বিয়ে দিতাম না৷ বউয়ের সাথে শ্বাশুড়ির টুকটাক ঝগড়া হবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু এর জন্য বাবা মাকে ছেড়ে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকতে হবে নাকি? বউ রাগ করে বাপের বাড়ি এসে পড়েছে।বউকে একদিন বুঝাবে দুইদিন বুঝাবে তিন দিনের দিন গালে একটা থাপ্পড় মেরে নিয়ে যাবে। তবুও যদি না যায় তাহলে বললে, সারাজীবনের জন্য এইখানে থাকো আমি তোমায় ডিভোর্স দিবো। ডিভোর্সের কথা শুনলে আর কিছু করা লাগবে না এমনিতেই সুরসুরিয়ে যাবে।
সায়েম মাথা নিচু করে বললো,
- দুঃখিত ভাইয়া আমার ভুল হয়ে গেছে।
ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-- তোরা কেন পারিস না নিজের শ্বাশুড়িকে মার চোখে দেখতে। মনে রাখিস একদিন তুইও শ্বাশুড়ি হবি তখন ছেলের বউ তোর সাথে এমন করলে বুঝবি কতটা কষ্ট হয়...
---
----
বাস ছেড়ে দিবে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতে আমায় বললো,
-পিয়াস, আমি যাবো না
আমি তখন মুচকি হেসে বললাম,
-- মা'র মন থেকে ছেলের বউ আর নিজ মেয়ের মধ্যকার পার্থক্যটা দূর হলেই মাকে সাথে নিয়ে তোমায় নিতে আসবো।
বাসটা চোখের সামনে থেকে কিছুক্ষণের মধ্যে আড়াল হয়ে গেলো। শ্রাবণীর জন্য মনটা কেমন কেমন জানি করছে। তবুও নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম, সারাজীবন সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার জন্য কয়েকদিন নাহয় কষ্টে রইলাম।