ইচ্ছাপূরণ

0 4

‘সুব্রত… সুব্রত, সুব্রত… পদবি কি বললেন? বোস?’

‘হ্যাঁ, প্লিজ একটু দেখুন, কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে।’

‘সুব্রত,… সুব্র-… সুব্রত দত্ত আছেন একজন… আর… আর তো… উঁহু, আর তো কোন সুব্রত নেই।’

‘মানে?’

‘মানে আর কি মশাই? আপনার নাম নেই এখানে। বিশ্বাস না হয় আপনিই দেখে নিন।’

পিওনের হাত থেকে প্রকাণ্ড রেজিস্টার খাতাটা নিয়ে সেদিনের তারিখের নীচে সব কটা লাইন তিন থেকে চার বার করে পড়ল সুব্রত। সত্যিই তো, ‘সুব্রত বোস’ বলে কোন ব্যাক্তির নামই সেখানে নেই।

অথচ গত বুধবার সে ডাকে এই পত্রিকার অফিস থেকে চিঠি পেয়েছে তার পড়াশুনার যাবতীয় কাগজপত্র সমেত ইন্টার্ভিউতে উপস্থিত থাকবার জন্য। এরকম কোন পরিস্থিতিতে পড়লে স্বাভাবিক ভাবেই যে কোন মানুষ যা ভেবে থাকেন, সেটাই সুব্রত ভাবল- অফিস কর্তৃপক্ষদের তরফ থেকেই কোন গোলমাল হয়েছে।

ইচ্ছাপূরণ

‘দেখুন আমি গত সপ্তাহে চিঠি পেয়েছিলাম এখানে আসবার, আমার আজ ইন্টার্ভিউ আর এখন আপনারা দেখাচ্ছেন যে…’

‘এই আস্তে আস্তে, এক্ষুনি ওই ঘর থেকে বাবুরা এসে পড়বেন’, পিওন হাত তুলে বললেন।

‘আরেবাবা আমি…’

পিওন আবার হাত তুলে আস্তে কথা বলার ঈশারা করলেন। ভদ্রলোকের কিন্তু সত্যিই কোন সাহায্য করবার ইচ্ছা ছিল না। বরঞ্চ উনি শুধু মজাটাই দেখছিলেন।

সুব্রত এবার একটু আস্তে বলতে লাগল, ‘আরে আমি আপনাকে বলছি তো, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আমি অ্যাপ্লাই করে চিঠি পেয়েছি ইন্টার্ভিউতে আসবার আজকে।

আমি কেন আপনাকে মিথ্যে বলতে যাব? আপনার এই রেজিস্টার বাদে সিস্টেম–এর রেকর্ড নেই?’

পিওন ঠাণ্ডা মাথায় এবার একটা উল্টো প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার ওই চিঠিটা আছে?’

‘এই তো’ কথাটা বলে সুব্রত তার ডান হাতের ফাইল থেকে কাগজটা বার করতে গেল। ফাইলে সুব্রত আজ সকালে তার পড়াশুনার সমস্ত দরকারি কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়েছে। সব কাগজ কালানুসারে গুছিয়েছে সে, সেই মাধ্যমিক থেকে গ্রাজুয়েশন অবধি সব আছে সেখানে।

এবং আছে সেই চিঠিটি, যার কথা সে এতক্ষন ধরে বলে চলেছে। সেগুলো সব আছে সুব্রতর সেই সবুজ রঙের কভার ফাইলে। অন্তত সুব্রত তাই জানত।

‘একি!’ কথাটা ইন্টার্ভিউ রুমের বাইরে বসে থাকা আর সকলকে আকর্ষণ করেছিল। কথাটা সুব্রত বলল তার সেই হাতে ধরা ফাইল থেকে বেড়িয়ে আসা কাগজগুলো দেখে। কোনটা মোটা, কোনটা বেশ পাতলা, কোনটা একটু হলদে, কোনটা একটু নীলচে, আবার কোন কোন কাগজ ধব-ধবে সাদা।

ছুঁতে সেগুলো সত্যিকারের মানপত্রের মতই মনে হয়। কিন্তু প্রতিটি কাগজে একটাই জিনিস বাদ। সেগুলতে কোন কালি নেই। সেগুলতে কোন লেখা নেই। ফাঁকা সেগুলো, শুন্য। ঠিক সুব্রতর মুখের মতো, যেটা হাঁ করে চেয়ে আছে কাগজগুলোর দিকে। সেই কাগজগুলোর সাথে বেড়িয়ে পড়ল আরও একটি কাগজ। ছোট, ভাঁজ করা।

সেটা ওই পত্রিকার অফিসের চিঠি বলেই জানত সুব্রত। কিন্তু সেটারও ভাঁজ খুলতে দেখল সেই কাগজেও সেই একই অভাব। সেটাও সম্পূর্ণ ফাঁকা। এমনকি তাতে কোন লেখার ছাপও নেই। অথচ সুব্রত জানত যে সেই চিঠি তাকে টাইপরাইটারে লিখে পাঠানো হয়েছিল। প্রতিটি অক্ষরের ছাপ পাতার উল্টোদিকে সে অনুভব করেছিল তার আঙুল দিয়ে আজ সকালেও। কিন্তু এখন কিচ্ছু নেই। যেন কখনো কিছু ছিলই না।

পিওন ভদ্রলোক ঘটনাটা দেখে মনে মনে বেশ উপভোগ করেছিলেন। বাইরে শুধু মুচকি হাসলেন, বললেন না কিছু। সুব্রত সেই ফাঁকা কাগজগুল আবার তার ফাইলে পুরে বেড়িয়ে এল অফিস থেকে। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার আওয়াজ তার অসহ্য লাগছে। কীভাবে এরকম হল? এতটা ভুলো মন তার? কোথায় রেখে এসেছে সেই কাগজগুলো সে? তার ঘরে? বিছানার উপর? খাবার টেবিলে? নাকি এখনো সেগুলো আলমারিতে বন্দি? তাহলে আজ সকালে কোন কাগজগুল নিল সে ফাইলে?

ঘণ্টা খানেক পর তার শুকিয়া স্ট্রীটের বাড়ির ছোট্ট ঘরটি লণ্ডভণ্ড করে ফেলল সুব্রত। সব দেখল সে। সব। কোথাও সেই মানপত্রগুলো নেই। নেই সেই ছাপা চিঠি। কোথাও নেই। মা তার শয্যা ছেঁড়ে ছেলের উন্মত্ত ব্যবহার দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি রে? কি হারালি? আর এত তারাতারি চলে এলি যে? হয়ে গেল ইন্টার্ভিউ?’

মেঝেতে বসেছিল সুব্রত মাথায় হাত দিয়ে। তার মাথা ধরে গেছে।

এর কোন অর্থ বুঝতে পারছে না সে। মাকে দেখে সে মার হাত ধরে তাকে আবার শুইয়ে দিয়ে এল মার ঘরে। বলতে লাগল, ‘কেন তুমি উঠে এলে বল তো? তোমার না রেস্ট নেওয়া দরকার?’ বৃদ্ধা মাও ভুলে গেল তাতে। আবার তার ঘরে ফিরে সুব্রত বসে পড়ল মেঝেতে। খোলা জানালার পাশে চেয়ারে ঠেশ দিয়ে রাখা ছবিটার দিকে চোখ চলে গেল তার।

উঠে গেল সে ছবিটার দিকে। ডান হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে ক্যানভাসটা আলত করে ছুঁল। শুকিয়ে গেছে। অল্প হাসল সুব্রত। তার এই সঙ্কট-পূর্ণ সময়ে, যখন তার মানপত্র খুঁজে না পেলে তার অন্য সব চাকরির রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তখনও সুব্রতর গতকাল রাতে তার হাতে আঁকা ছবিটা দেখে হাসি পেল।

আবার সে অনুভব করল সেই গতকাল রাতের লোভ। মায়া নয়। আবার সে মনে মনে ভাবল, ‘ঈশ, এরকমটা কি আর হবে…?’

****

সুব্রতর এক বন্ধু ছিল। ইস্কুলের বন্ধু, অমিত। একই পাড়ায় বাড়ি তাদের। বাস্তব জগতের কঠিন সত্যিগুল যখন খুব নিষ্ঠুর বলে মনে হত, তখন সুব্রত চলে যেত ওর বাড়ি। কথা বলত, গলা ছেঁড়ে গান করত দুজনে। অমিতের মা-বাবা কিছু মনে করতেন না। সুব্রতকে ওদের ভালোই লাগত। এই করে মনকে শান্তনা দিত সুব্রত। অমিত বিজ্ঞানের ছেলে। এখন ফিজিক্সে মাস্টার্স করছে প্রেসিডেন্সি থেকে। তবে তারো সুব্রতর মতো শিল্পের দিকে একটা ঝোঁক আছে। অবশ্য সেটা ঝোঁকের থেকে বেশি কিছু না। সুব্রতর মতো প্রতিভা তার নেই। তবে সে ভালো কাজের কদর করতে পারে। রুচিবোধও আছে বেশ ভালোই। সুব্রতর এই দুর্দশায় অমিতই ওকে ওর আঁকাটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দেয়। দুজনের বেশ একে-অপরের সাথে মেলে। তাই আজ মানপত্রের ঝামেলা থেকে একটু বিরতি নিয়ে সুব্রত ভাবল সে যাবে তার এই বন্ধুটির বাড়িতে সন্ধ্যাবেলায়। পরে এসে আবার খুঁজে দেখবে সে। হয়তো মনটা একটু হাল্কা হলে সে খুঁজে বের করতে পারবে কাগজগুলো। কোথায় আর যাবে? ওইটুকু তো ঘর।

সুব্রতর বাড়ি থেকে দুটো বাড়ি পরে অমিতের বাড়ি। ওদের নিজেদের বাড়ি, সুব্রতদের মতো ফ্ল্যাটবাড়ি নয়, আর বেশ সুসজ্জিত। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে একবার আর তারপর খুব তারাতারি পর পর দুবার বেল টিপল সুব্রত। ওটাই ওর ‘সংকেত’। ওটা শুনলেই অমিত বুঝে যায় যে কে এসেছে, এবং কেন। মিনিটখানেক পর এক বছর চব্বিশ-পঁচিশের ছেলে বাড়ির ভিতর থেকে এগিয়ে এল গেটের দিকে। গেটের তালা খুলে সুব্রতকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে চাই?’

‘তোর ঠাকুরদাকে চাই রে শুয়ার! ন্যাকামি হচ্ছে। নে চল, একটু বসব।’ এইভাবে ঠাট্টা-গালিগালাজ সব বন্ধুদের মধ্যে হয়, সুব্রত-অমিতের মধ্যেও হত। অবশ্য বাড়িতে নয়, বাইরে। কিন্তু আজকের ঠাট্টাটা যে শুধুমাত্র ঠাট্টা নয়, সেটা সুব্রত বুঝতে পারেনি। তাই তার গালিগালাজটাকেও ঠাট্টা হিসেবে নিতে পারল না অমিত। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে, আজকালের সব ছেলে-মেয়েদের মতই ইংরাজিতে বলে উঠল সে, ‘এই who the hell are you? What’s your problem, coming to my house and cussing me?’

‘এই ভাই, কীরে? কি হল তোর? আরে আমি তোর বন্ধু সুব্রত…কেন এরকমটা করছিস…?’

কিন্তু ইংরাজির চাবুক মারা বন্ধ হল না।

ইচ্ছাপূরণ

‘Oh so now it’s a joke is it? Cuss me first, and then play the fool, that your game?’

‘এই ভাই come on… কি হয়েছে তোর? চল না, একটু গিয়ে বসি। কেন এরকম করছিস তুই?’

‘আমি করছি? আমি? সালা, কোথাকার কোন ঠকবাজ, এখানে এসে… এই, বেরোও তো, অনেক হয়েছে, মানে মানে কেটে পড়। না হলে কিন্তু পুলিশ ডাকব বলে দিলাম।’

‘তুই কি বলছিস এসব…?’


3
$ 0.00

Comments