ইচ্ছাপূরণ

0 3

নীল রঙের নোনা ধরা দেওয়ালে হলদে হয়ে যাওয়া টিউব বাতির নীচে টানানো ঘড়িতে বাজে বারোটা চল্লিশ। রাত বারোটা চল্লিশ। না, এবার একটু বিশ্রাম নিতে হবে। কাল খবরের কাগজের অফিসে ইন্টার্ভিউ।

সকাল সকাল উঠতে হবে। ছবিটা ইজেল থেকে নামিয়ে সুব্রত সেটা খোলা জানালার দিকে মুখ করে একটা বেতের চেয়ারে ঠেশ দিয়ে রাখল। তারপর তুলি, প্যালেট, রঙের শিশি, জলের বাটি, ন্যাকড়া সব ধুয়ে রেখে, সাবান দিয়ে হাত থেকে রঙ উঠিয়ে, দাঁত মেজে সুব্রত শুয়ে পড়ল।

নিভে গেল ঘরের বাতি। অন্য সব ঘরের মতো। পাশের ঘরে মা ঘুমচ্ছেন। অসুস্থ, দুর্বল। বাবা নেই। বছর দুয়েক হল চলে গেছেন হৃদরোগে। তারপর সংসারে বাবার জায়গাটা পূরণ করার চেষ্টায় সুব্রতর বন্ধ করে দিতে হয়েছিল তার ইংরাজিতে স্নাতকোত্তরের পড়াশুনা সম্পূর্ণ করা। শেষ হয়ে গিয়েছিল স্বপ্ন দেখা।

একজন শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন। সামান্য কেরানির ঘরে তার জন্ম, সংসারে অভাব তার কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু যে মূল খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে ছিল তাদের সামান্যতম সুখটুকু, আজ সে খুঁটি নেই। নিজের পায়ে দাঁড়াবার সময় এসেছে এবার, বাপের মুখাগ্নি করতে গিয়ে বুঝেছিল সেদিন সুব্রত।

আর কাল তার পরীক্ষা। চাকরির পরীক্ষা। সুব্রতর মন খারাপ হয় না এখন। প্রথম প্রথম হত। কান্না পেত। এখন আর পায় না। খালি যখন সারা দিন চাকরির সন্ধানে টোটো করে ঘুরে ব্যর্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসে সুব্রত, তখন তার ছোট্ট ঘরে ছড়ানো ছেটানো তার হাতে আঁকা ছবিগুলর দিকে তাকালে সেগুলোর প্রতি খুব মায়া হয় তার। কি হবে আর ওগুলোর? হয়তো একদিন টাকার জন্য বেচে দিতে হবে সব। সঙ্গে আকার সরঞ্জামগুলোও।

নিজের অঙ্কন ক্ষমতার উপর যথেষ্ট বিশ্বাস আছে সুব্রতর। কিন্তু একজনের কাছে যা সুন্দর, তা তো আরেকজনের কাছে সুন্দর নাও হতে পারে। যা হোক, ওগুলোকে যে সুব্রতকে একদিন ফেলে দিতে হবে, সেটা সুব্রত জানত। এবং তার সাথে ফেলে দিতে হবে তার শিল্পী সত্ত্বাটাকেও। তাই মায়া হয় তার সন্তানদের উপর সুব্রতর আজকাল। দুঃখ হয় না।

কিন্তু এই ছবিটা এঁকে সেটাকে দেখে কিন্তু সুব্রতর মায়া হওয়ার চেয়েও লোভ হয়েছিল অনেক বেশি। লোভ হয়েছিল ছবির বিষয়বস্তুর উপরে। এবং সেই লোভ থেকেই সুব্রত সেই রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বার কিছু আগে আবার মনে মনে ভেবেছিল, ‘ঈশ, সত্যি যদি এরকমটা হত…’।

3
$ 0.00

Comments