Friendship
প্রায় বারো বছর হয়ে গেল, ভুতো আর রনির মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই। ভুতো কেমন আছে , কোথায় আছে , বিয়ে-থা করেছে কিনা … কোন তথ্যই জানা নেই রনির। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ভুতোর কথা আর মনেই পরে না ওর। আজ অনেক বছর বাদে পুরণ স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎই মনে পরল ভুতো কে। ছিপ ছিপে লম্বা, শ্যামলা গড়ন, বড়বড় ঝাঁকড়া ছুল- চোখ বন্ধ করলে এখনও স্পষ্ট ভাসে ছেলেটার চেহারা।
ভুতো মানেই দম ফাটা হাসি, বেঞ্চ বাজিয়ে হেঁড়ে গলায় গান, ক্লাসের ফাঁকে অবিকল এঁকে দেওয়া সোম নাথ সারের মুখ। লাস্ট বেঞ্চি ভবিতব্য ছিল তাদের দুই বন্ধুর। লেখাপড়ায় তো লবডঙ্কা। শুধুই গুলতানি আর শয়েতানি। সারদের মারধোরও কি কম খেয়েছে? কোনোক্রমে ফেল করতে করতে পাশ করে যাওয়ার পর অঙ্কের সার মৃদুল বাবু গার্জিয়ান কল অবধি করেছিলেন ওদের ।রনির রাশভারী বাবা গম্ভিরমুখে শুনেছিলেন ছেলের গুনপনা। বকাবকির একশেষ হয়েছিল বাড়িতে । তবু তাদের বন্ধুত্য অটুট থেকেছে। ক্লাসের অন্য ছেলেরা বলত হরিহর আত্মা। ভুতোকে রনির বাড়িতে যতটাই অপছন্দ করতো, ভুতোর বাড়িতে ঠিক তার উলটটা । সেই কারনে, মনে মনে দারুন অপরাধ বোধ ছিল রনির। বাড়িতে না বলেই কতবার যে ওদের বাড়িতে গেছে রনি। ভুতোর মা, ভবানী কাকিমা রনিকে খুব ভালোবাসতেন। কতরকম রান্নাকরে খাওয়াতেন । ওর বাবা রেলে কাজ করতেন, বাইরে বাইরে পোস্টিং, মাসে একবার কি দুবার বাড়ি আসতেন। মা ছেলেরই সংসার। রনির শান্ত স্বভাবের জন্য কাকিমা ওকে ভরসা করতেন। প্রায়ই বলতেন, ভুতো ভয়ানক বাউন্দুলে, তুই ওকে এক্টু দেখে রাখিস তো বাবা।
মাধ্যমিকের রেজাল্টের দিন কাকিমা এসেছিলেন স্কুলে। সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছিল ভুতো। আর রনি ফার্স্টডিভিশন। ভুতো দারুন আনন্দ করেছিলো রনির মার্ক সীট দেখে। স্কুলের বাইরে ভজুদার দোকানে ওকে গরম গরম জিলিপিও খাইয়েছিল।
ভুতোর থেকে বেশী নম্বর পাওয়ায় রনিরই মন খারাপ লাগছহিল, কিন্তু ভুতো একবারও তা বুঝতে দেয়নি তাকে। কাকিমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, অনেক বড় হোস বাবা। চোখটা যেন একটু ভিজে ছিল কাকিমার। তারপর আর খুব বেশী দেখা হওয়ার অবকাশ ছিলনা, রনির অনেক অনিছহা সত্তেও ওকে কলকাতার কলেজে ভরতি করে দিয়েছিলেন বাবা।
কলকাতায় বড়পিসির বাড়িতে থেকেই এগার বার ক্লাস্ পাশ করেছিল রনি। তখন সে পুরপুরি শহুরে। সাহিত্যেই ইন্টারেস্ট ছিল বরাবর। তাই বাংলায় অনার্স নিয়ে স্কটিশ কলেজে পড়ল সে।
কানাঘুষয় শুনেছিল ভুতো উচ্চমাধ্যমিক এর পর আর লেখাপড়া করেনি। কোথায় যেন ছোটখাটো চাকড়িতে ঢুকেছে। তারপরের দিনগুলো খুব দ্রুত কেটে গেছে।
বি এ পাশ করার পর প্রথম কয়েক বছর টিউশানি, স্কুলে পার্ট টাইম টিচার এর চাকড়ি আর অল্প সল্প লেখালেখি করার পর অবশেষে একটা পত্রিকায় এডিটরিয়াল বিভাগে চাকড়ি করছে রনি। মাইনে মন্দ নয়, আর সঙ্গে এক্টু আধটু লেখার অভ্যেস তো রয়েইছে। পারিবারিক দিক দিয়েও অনেক পরিবর্তন এসেছে।
সোদপুরের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন রনির বাবা বেশ কিছু বছর আগে। সপরিবারে ওরা এখন কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকে। রনির বড়দা ব্যাঙ্গালরে চাকড়ি করছেন একটি উচ্চমানের বহুজাগতিক সংস্থায়।
সামনেই বড়দার বিয়ে। কাকা জেঠা দের বিয়ের নেমন্তন্ন করতেই এসেছে রনি ও তার বাবা। শরিকি গণ্ডগোলে এই বাড়ির আত্মীয়দের সাথে খুব একটা সম্পর্ক নেই আর রনিদের। তবে বিয়ে থার ব্যাপারে না এলেও নয়। তাই আজ পিতাপুত্রের আগমন সোদপুরে। পুরনো স্কুলের সামনে এক দাদার বাড়ি ছিল।
সেখানেই বিয়ের কার্ড দিতে এসেছিলো রনি। ফেরার পথে একরাশ নস্টালজিয়া যেন ঘিরে ধরল ওকে। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে দু-এক জনের সঙ্গে ফেসবুক বা টুইটার এ যোগাযোগ আছে। তারা প্রত্যেকেই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের মাধ্যমে বাকিদের কারো কারো কথাও জানতে পারে রনি।
কিন্তু ভুতো নামের মানুষটা যেন হারিয়েই গেছে রনির মন থেকে। এই ক’বছরে একবারও কেন ভুতোর কথা মনে হয়নি? একবার দেখা করলে কেমন হয়… হঠাৎ ঝোঁক চেপে গেল রনির। ভুতো দের বাড়ি টা ষ্টেশনের ওপারে, রেল কোয়ার্টারে। যদিও প্রায় বারো বছর হল ও বাড়িতে যায়নি রনি, তবু ঠিকানাটা এখনও স্মৃতিতে স্পষ্ট। হনহন করে হেঁটে মেন রোডে এসে অটো ধরল ও।
সাত আট মিনিটের রাস্তা। গল্প করতে করতে শীতের বিকেলে দু বন্ধু হেঁটেই চলে গেছে কতবার। ভুতোর পছন্দ ছিল খোসাওয়ালা চীনে বাদাম। এক ঠোঙ্গা কিনে কাড়াকাড়ি করে খেত দুজনে। পকেটে কতই বা পয়সা ছিল আর তখন। ভুতোর জন্য চীনে বাদাম কিনে নিয়ে গেলে কেমন হয়!!
নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলল রনি। এখনকার ভুতো আদৌ চীনে বাদাম খায় কিনা কে জানে। অটো রেল কোয়ার্টারের সামনে নামিয়ে দিল রনিকে। বড়সড় লোহার গেট।
সবুজ ঘাসে ঢাকা রাস্তা চলে গিয়েছে ভেতরে। গেটের সামনেই একটা মিষ্টির দকান, এটা আগে ছিলনা। খুব বড় নয় দোকানটা, কাঁচের র্যাক গুলো সবই প্রায় খালি।
অল্প বয়সি একটি ছেলে মেঝেতে বসে রেকাবিতে কাজু বরফি কেটে কেটে তুলে রাখছে। রসগোল্লা গুলোই যেন একটু ফ্রেশ। পনেরোটা কিনল রনি। এখন ওদের বাড়িতে কত লোক আছে কে জানে। আছছা… ভুতোরা যদি আর না থাকে এখন এখানে। নিজের মধ্যেই একটু দমে গেল রনি।
নাহ। না ভেবে চিন্তে এতগুলো মিষ্টি কিনে ঠিক করেনি সে। যাকগে, দেখাই যাক না গিয়ে। নাহয় দেড়শ টাকা পুরনো বন্ধুর নামে নষ্টই হল। মিষ্টির বাক্সটা হাতে ঝুলিয়ে কোয়ার্টারের মধ্যে ঢুকল রনি। ভেতরটা প্রায় একি রকম আছে। ঘেঁষা ঘেঁষি করে দাড়িয়ে থাকা অনেকগুলো চারতলা বাড়ি, বহুদিন সংস্কার না হওয়া। মাঝখানে ছোট ছোট মাঠ, ঘাসে ঢাকা, দু পাশে বড়বড় গাছ। ভেতরটা শান্ত, চুপচাপ।
দুএকটা বাচ্চা ছুটোছুটি করছে মাঠে। ভুতোর বাড়িটা বি ব্লকে। এ টা পেরিয়ে ডানদিকে ঘুরতে হবে, একটা জলের ট্যাঙ্ক আছে সামনে। ওই তো দেখা যাচ্ছে বাড়িটা। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ির তলায় ঢুকল রনি।
বাঁ দিকে এক সার দেওয়া লেটারবক্স। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান বাঁ দু দিকেই দুটো ফ্ল্যাট। দরজা বন্ধ। আর একটা তলা। বাঁ দিকের ফ্ল্যাট টাই ওদের। দরজায় তালা নেই। নিঃশ্বাস বন্ধ করে কলিংবেল টিপল রনি। যা থাকে কপালে।