Friendship
দু-বার কলিং বেল টেপার পর ছিটকিনি খোলার শব্দ হল। দরজার পাল্লার ফাঁকে যে মুখটি উঁকি দিল, সে ভুতো কিংবা কাকিমা নয়, একটি বছর পঁচিশেকের মেয়ে।, ছোটোখাটো চেহারা, রোগা, পান পাতার মত মুখ। আধ ময়লা নাইটি পরনে। জিজ্ঞাসু চোখে রনির দিকে তাকাল সে। ভুতোর ভাল নামটা যেন কি?
ধুস, মনেই পড়লনা। খানিক ইতস্তত করে রনি জিজ্ঞেস করল, ভুতো আছে? দু-তিন সেকেন্ড মেয়েটি তাকিয়ে রইল ওর দিকে। রনি খেয়াল করল, রোগা, কালো কোল চেহারাটা যতই অকিঞ্চিৎকর হোক না কেন, চোখ দুটো বেশ অন্যরকম, টলটলে, কালো, গভীর। মনে হয়, এ মেয়ের মনের মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। দরজা ছেড়ে সরে দাড়াল মেয়েটি, মৃদু গলায় বলল, ভেতরে আসুন। জুতো ছেড়ে ভেতরে ঢুকল রনি।বাইরের ঘরটা প্রায় একি রকম রয়েছে। একটা ডাইনিং টেবিল, তিনটে চেয়ার, বড়সড় একটা সোফা, যার কভারটা বেশ পুরনো এবং আকাচা। ঢুকেই ডানদিকে যে বেডরুম টা ছিল, তার দরজায় ভারী পরদা ঝুলছে, এটাই যা নতুন। ওই ঘরটাই ছিল ভুতোর। খাটের উপর আধশোয়া হয়ে কাকিমার হাতে বানানো ডাল বড়া খেতে খেতে কত আড্ডা মেরেছে তারা। বাইরে ডাইনিং টেবিলের পাশে একটা ছোট টুলে সেলাই এর মেশিন চালাতেন কাকিমা, ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় আওয়াজ হত থেকে থেকে। সোফাটা ছিল কি? পাশের বেডরুম টার দরজার পরদা গোটান। সিলিং ফ্যান চলার আওয়াজ আসছে। মানে কেউ আছে। মেয়েটি রনিকে সোফায় বসতে বলে সেই ঘরেই গেল।
ভেতর থেকে ক্ষীণ পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল, কে এসেছে? মেয়েটির গলা, তোমায় খুঁজছে একজন, আগে দেখিনি। -কি দরকার জিজ্ঞেস করে এস, পুরুষ কণ্ঠ টি তিক্ত। এটা কি ভুতোর গলা? আবার মেয়েটির মুখ দরজায়, কি দরকার ওর সাথে? প্রশ্নের মধ্যে যেন নিহিত আছে, কি বা দরকার আর থাকতে পারে ওর সাথে। রনি বেশ বিব্রত বোধ করল। কেন যে ঝোঁকের মাথায় আসতে গেল এখানে? অস্বস্তি গোপন করে ও বেশ জোরেই বলল, দরকার কিছু নেই, আমি ওর স্কুলের বন্ধু রনি। এমনিই দেখা করতে এসেছিলাম।
মেয়েটি চোখ নামিয়ে আবার ঢুকে গেল ঘরে। এরপর আর কোন কথা শোনা গেলনা ভেতরে। খানিক্ষন পরে একটা ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ এল ঘর থেকে, চাকা গড়িয়ে নিয়ে চলার মত। আওয়াজটা ক্রমশ স্পষ্ট হল।
দু মিনিট পরে ঘরের দরজায় যে মুখটি দেখা গেল, অনেক চেষ্টা করেও নিজের ছেলেবেলার বন্ধুটির সাথে তার কোন মিল পেলনা রনি। মধ্য তিরিশের একটি লোক, ঢ্যাঙ্গা মতন রোগা, ক্ষয়াতে চেহারা।
মাথায় পাতলা হয়ে আসা চুল, কানের দু পাশে রুপোলী আভা, আ কামানো কাঁচা-পাকা দাড়ি, গর্তে বসা চোখদুটোর তলায় গভীর কালো ছোপ। সবুজ চেক চেক লুঙ্গির উপরে ছাই রঙের ফতুয়া। হাড় গিল গিলে হাত দুটো দিয়ে ধরা আছে ওয়াকার। পিছনে মেয়েটি, কাঁধের উপর হাত রেখেছে ক্ষীণজীবী মানুষটির।
একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। অস্থির হয়ে উঠল রনি। এ কিছুতেই ভুতো হতে পারেনা। অসম্ভব। জোর করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল রনি। এখুনি এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্তু কে যেন ওর পা দুটো মেঝের সাথে আটকে রেখেছে। নিশ্চল, নির্বাক শরীরটা নিয়ে পুতুলের মত বসে রইল রনি।
আধবুড়ো লোকটা দু-তিন সেকেন্ড অপলক চেয়ে রইল রনির দিকে। ঠোঁটের কোনে ভেসে উঠল এক অমলিন হাসি। রনি দেখতে পেল, সামনের পাটীর গজ দাঁতটা।
-‘উঃ, হাসলে যেন ঠিক উত্তম কুমার’- মনে পড়ল ড্রিল সার অর্জুন মল্লিকের কথাটা। খুব পেছনে লাগার অভ্যেস ছিল সারের। ক্ষিপ্র শরীর ছিল ভুতোর, ড্রিলে তুখোড়। সার প্রায়ই পরামর্শ দিতেন ওকে সিনেমায় নামার জন্য। আজ যদি সার দেখতেন ভুতোকে… ওয়াকার ঠেলে ঠেলে সামনে এল ভুতো। মেয়েটি ওকে সাহায্য করল চেয়ারে বসতে।